ইরাক আগ্রাসনের পর থেকে বিগত দুই দশকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধের পরিচালিত যুদ্ধটা ইসলাম ও মুসলমানের জীবন, সম্পদ ও সম্মানের সমূহ ক্ষতি করেছে। পরাশক্তি আমেরিকার একটা সার্বক্ষণিক শত্রু থাকার বাধ্যবাধকতার বলি হয়েছে বহু হতাশাচ্ছন্ন দিগ্ভ্রান্ত বেকার যুবক।
দেশে দেশে স্বৈরাচারী মুসলিম সরকারের সহযোগিতায় মার্কিন যুদ্ধ ও ছায়া শত্রু প্রসারিত হয়েছে। ভ্রাতৃঘাতী হিংসায় নগরসভ্যতা ধ্বংস হয়েছে। পাশাপাশি ফিলিস্তিনে নিয়মিত ভূমি দখল ও প্রাণহরণ চলেছে। বোধগম্য কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মুসলিম জনমত প্রবলতর হয়েছে দেশে দেশে। রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের পর বাংলাদেশের মানুষের যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব সুস্পষ্ট। সমাজতন্ত্রী কিংবা সাম্যবাদী কোনোটাই না হয়েও বরং নিরেট পুঁজিবাদী ও একনায়ক পুতিন সাবেক কমিউনিস্ট সোভিয়েত চিন্তার প্রভাবে এবং রাজনৈতিক হেজেমনির প্রশ্নে বাংলাদেশের বাম অঙ্গনে জনপ্রিয়ই থেকে গেছে। পাশাপাশি গুম, খুন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র হরণ প্রশ্নে বাংলাদেশের এলিট ফোর্সের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থকেরাও মার্কিনবিরোধী অবস্থানের তুঙ্গে আছেন। সব মিলে পুতিনের বাংলাদেশি সমর্থনপ্রাপ্তির ভাগ্যে যেন সোনায় সোহাগা। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা স্বার্থটা যুক্তরাষ্ট্র–ইইউ–জাপান কিংবা চীন-রাশিয়া শিবিরের কোন দিকে হেলানো?
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের হিসাবে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য মানবিক কার্যক্রমে ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা এসেছে। করোনা মহামারিতে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া মোট টিকা অনুদান সাড়ে চার কোটি ডোজ ছাড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যের বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য। ২০১৭ সালে মোট দ্বিমুখী পণ্যের বাণিজ্য ৭১০ কোটি ডলার। বাংলাদেশের রপ্তানি ৫৬০ কোটি ডলার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি মাত্র ১৪০ কোটি ডলার। প্রধান রপ্তানি খাতগুলো হচ্ছে—তৈরি পোশাক (৫০০ কোটি ডলার), টেক্সটাইল সুতা ও কাপড় (২৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার), পাদুকা (১০ কোটি ১০ লাখ ডলার), বিবিধ উৎপাদিত পণ্য (৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার) এবং হাতব্যাগ (৬ কোটি ১০ লাখ ডলার)। বিপরীতে বাংলাদেশের ক্রয় তেল ও তেলবীজ, সুতা, ধাতব আকরিক, পশুখাদ্য ইত্যাদি। যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে বাংলাদেশের রপ্তানি চার গুণ বেশি। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রথমবারের মতো এক বছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি খাতে আয় ৬০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে।
শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অংশগ্রহণে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদেশের কৌশলগত সমর্থন রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধানতম দুটি খাতের একটি তৈরি পোশাক ও রপ্তানি, যা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বাজারনির্ভর, অন্যটি প্রবাসী আয়। বাংলাদেশের রেমিট্যান্স উৎস মধ্যপ্রাচ্য। তবে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশগুলো মূলত যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশ। মার্কিন শেভরন বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় অর্ধেকটা উৎপাদন করে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র একমাত্র দৃশ্যমান পরাশক্তি যে জাতিসংঘে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে চূড়ান্ত উত্তরণ ও মধ্যবিত্ত দেশ হওয়ার পরও বাংলাদেশের গবেষণা, ওষুধ, কম্পিউটারসহ বিভিন্ন মেধাস্বত্ব সুবিধা আদায়ে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সহায়তা দরকার। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ও শিক্ষা গবেষণার চূড়ান্ত গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ।
২০১৮ সালে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায় সাড়ে সাত হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থী প্রেরণকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বে ২৪তম ও স্নাতক স্তরের শিক্ষার্থী পাঠানোর ক্ষেত্রে বিশ্বে ১০তম। আইসিডিডিআর’বি, স্পার্সো ও বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের গবেষণা পার্টনার যুক্তরাষ্ট্র। জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত শীর্ষস্থানীয় দেশ হিসেবে ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির প্রশ্নে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক বরাদ্দের ন্যায্য প্রত্যাশী।
১৯৯১ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় অপারেশন সি অ্যাঞ্জেল-১ এবং ২০০৭–এর মর্মন্তুদ সিডরে অপারেশন সি অ্যাঞ্জেল-২–তে মার্কিন মেরিনরা দক্ষিণাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষকে ত্রাণ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশি সেনাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। মার্শা বার্নিকাট বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে ‘স্পন্দনশীল, বহুমুখী ও অপরিহার্য’ বলেছেন।
বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন নীতি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ওপর জোর দেয়। ফলে ২০১৪ সালে প্রধান বিরোধী দলের বর্জন করা একদলীয় নির্বাচনের পরও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে ঠান্ডা সমর্থন দিয়েছিল।
২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসে হাজারের বেশি মৃত্যুর পর মার্কিন বাজারে শুল্কমুক্ত অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা (জিএসপি) বন্ধ হয়। বর্তমানে ‘অগ্নিনিরাপত্তা ও কাঠামোগত শুদ্ধতা–সংক্রান্ত জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনার’ অধীন জিএসপি পুনরুদ্ধারের অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নাধীন।
বাংলাদেশ-ইইউ সম্পর্ক
২০০১ সালে ইইউ-বাংলাদেশ সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা বাণিজ্যিক সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ) উদ্যোগের অধীনে ইইউ বাজারে বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার প্রদান করে। ইউনিয়নের ৩৫তম বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার বাংলাদেশ (মোট বাণিজ্যের ২৪ শতাংশ)। বাংলাদেশ থেকে ইইউতে রপ্তানির করা পণ্যের ৯০ শতাংশই তৈরি পোশাক। ইইউয়ের রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি এবং ৪৯ শতাংশ পরিবহন সরঞ্জাম। এভরিথিং বাট আর্মস স্কিমটি বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হবে বলে এখানে নেগোসিয়েশনের প্রশ্ন জড়িত।
বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগকারী ইউরোপীয় দেশ যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ইতালি। ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ কর্মসূচির মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিকায়নের উদ্যোগের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ইইউর শক্তিশালী দেশগুলোর উড়োজাহাজসহ প্রতিরক্ষাসামগ্রী ক্রয়ে আগ্রহী।
বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্ক
বৈদেশিক সহায়তাপ্রাপ্তিতে বাংলাদেশ মূলত জাপান বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ওপর নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সূত্রমতে, শীর্ষ দেশ হিসেবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে জাপানের বৈদেশিক অর্থায়ন ছাড়করণের পরিমাণ ১৯২ কোটি ডলার। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বিশ্বব্যাংক। বহুপক্ষীয় সংস্থা হিসেবে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে সহায়তা ছাড়করণ হয়েছে ১৫৭ কোটি ডলার। তৃতীয় সর্বোচ্চ এডিবির সহায়তা ছাড়করণ হয়েছে ১২৩ কোটি ডলার।
জাপান ও এডিবি বাংলাদেশের শত শত মাঝারি ও বড় প্রকল্পের অংশীদার। দেশের বৃহৎ সেতু, মহেশখালী-মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প, রিফাইনারি, সমুদ্রবন্দর, গভীর সমুদ্রবন্দরসহ বিভিন্ন ডিজিটাল প্রশাসন রূপান্তরের প্রকল্পে জাপান বাংলাদেশের ব্যাপকতর প্রত্যক্ষ উন্নয়নের অংশীদার। এডিবি প্রকল্পের মান প্রশ্নযুক্ত হলেও জাইকা প্রকল্পের বাস্তবায়ন মান খুবই সন্তোষজনক।
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। দেশের আমদানির ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ চীন থেকে হয়, ভারত থেকে হয় সাড়ে ১৩ শতাংশ। এফবিসিসিআই তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের মোট বাণিজ্য ১ হাজার ৪৬৯ কোটি ডলার। আমদানির পরিমাণ ১ হাজার ৩৮৬ কোটি ডলার, রপ্তানির পরিমাণ ৮৩ কোটি ১০ লাখ ডলার। তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমদানি করা ৫ হাজার কোটি ডলারের পণ্যের মধ্যে চীন থেকে এসেছে ১ হাজার ১০০ কোটি ডলারের বেশি পণ্য, চীনে গেছে মাত্র ৬০ কোটি ডলারের পণ্য। দুই দেশের মধ্যকার এমন বিশাল বাণিজ্য ঘাটতির মধ্যে চীন ২০২০ সালের জুলাই থেকে ট্যারিফ লাইনের আওতায় ৯৭ শতাংশ (আগের ৬১ শতাংশ) বাংলাদেশি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা চালু করেছে।
বাংলাদেশ ও চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। চীন বাংলাদেশের মেগা প্রকল্প নির্মাণে জাপানের পরই দ্বিতীয় প্রধান অংশীদার। তবে ভারত ও চীনের বিরুদ্ধে শুরুতে কম দামে দরপত্র জমা দিয়ে পরে কৌশলে প্রকল্পমূল্য বহুলাংশে বাড়ানোর সময়ক্ষেপণ ও কারসাজির অভিযোগ রয়েছে। দেশ দুটি প্রযুক্তি হস্তান্তর, কর্মসংস্থান তৈরি ও মানবসম্পদ উন্নয়নে একেবারেই অনুদার। শিক্ষা, গবেষণাসহ বিভিন্ন দুর্যোগে উচ্চ সুদের ঋণ ভিন্ন অপরাপর যেকোনো আর্থিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তায়ও দেশ দুটি একেবারেই কৃপণ।
চীন ও ভারত মূলত নিজ নিজ দেশ থেকে ৭৫ থেকে ৮৫ ভাগ নকশা, শ্রমিক, নির্মাণসামগ্রী কেনার বাধ্যবাধকতা রেখে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটে বাংলাদেশকে ঋণ দেয়। এতে স্থানীয় দক্ষতা ও কর্ম তৈরি হচ্ছে না বলে দেশের ‘জবলেস গ্রোথ’ সংকট প্রকট হচ্ছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে চীন বাংলাদেশকে প্রায় ৬০ কোটি ডলারের অর্থঋণ দিয়েছে। চীনের সঙ্গে চলমান মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল ও সড়ক নির্মাণ। পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পে চীনের বৃহৎ ঋণ রয়েছে। এ ছাড়া চীন সম্ভাব্য তিস্তা প্রকল্প, সিলেট ও সৈয়দপুর বিমানবন্দর আধুনিকায়ন প্রকল্পে আগ্রহী।
পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পে জি টু জির মাধ্যমে ২১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে চীন। আরও দেড় বছর সময় চাওয়া হচ্ছে বলে ১ হাজার ১৭৮ কোটি টাকা ব্যয় বাড়তে পারে। কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পে ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে চীন। সামনের দিনে চীনের ঋণ সহায়তার পরিমাণ আরও বাড়বে। কেননা, বড় ধরনের ঋণ প্রস্তাব বিবেচনায় রয়েছে।
২০১০–এর পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমরাস্ত্র আমদানিকারক দেশ চীন। সিপ্রির তথ্যানুসারে, ২০১৬-২০ মেয়াদে চীনের মোট অস্ত্র রপ্তানির ৩৮ শতাংশ গেছে পাকিস্তানে, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৭ শতাংশ বাংলাদেশে। বাংলাদেশ চীনের কৌশলগত বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) যুক্ত হয়ে কূটনীতিতে পূর্বমূখী উষ্ণতার একটা আভাস দিয়ে রেখেছে। করোনা মহামারিতে চীন থেকে বাংলাদেশে প্রায় আড়াই কোটি ডোজ টিকা কেনা হয়েছে, পাশাপাশি কিছু ছিল উপহার।
বাংলাদেশ-রাশিয়া সম্পর্ক
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় রপ্তানি হয়েছে ৬৬ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য, আমদানি করা হয়েছে ৪৬ কোটি ৬০ লাখ ডলারের পণ্য। ২০১৯-২০ অর্থবছরে চতুর্থ শীর্ষ ঋণদানকারী হিসেবে রাশিয়ার ঋণ সহায়তা ১০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি।
মূলত ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারে নির্মিতব্য সর্ববৃহৎ রূপপুর প্রকল্পে অর্থায়ন রাশিয়াকে এই অবস্থানে এনেছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নির্মাণকাজ তেমন এগোয়নি। সঞ্চালন লাইন সময়মতো নির্মাণ না হলে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা যাবে না। সে ক্ষেত্রে বৃহৎ এ বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অলস বসিয়ে রাখতে হবে। এতে আশঙ্কা আছে যে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে গুনতে হবে বিপুল অর্থ এবং আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
২০২০ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ রাশিয়া ইন্টারগভর্নমেন্টাল কমিশন অন ট্রেড ইকনোমিক, সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন বৈঠকে নতুন বাণিজ্য সম্পর্ক আলোচিত হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বিশেষ করে সিদ্ধিরগঞ্জ ও ঘোড়াশালে চলমান দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উন্নয়নে জড়িত রাশিয়া। জ্বালানি ও বিমান পরিবহন খাতে সহযোগিতা করবে দেশটি। রাশিয়ার নবটেক কোম্পানি স্বল্প সুদে এলএনজি আমদানির সুযোগ দেবে বলে একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নাধীন। দক্ষিণাঞ্চলে দ্বিতীয় পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং দ্বিতীয় স্যাটেলাইট প্রকল্প চুক্তির কাজ চলছে। বঙ্গোপসাগরের ব্লকে গাজপ্রমকে গ্যাস উত্তোলনে কাজ দেওয়া হয়েছে।
ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর রাশিয়াকে ‘একঘরে’ করার জন্য আন্তর্জাতিক লেনদেনের ব্যবস্থা সুইফট থেকে বাদ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইইউ। রাশান অর্থব্যবস্থার ওপর পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রূপপুরের নির্মাণকাজসহ অপরাপর প্রকল্প দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সব শেষে, বাংলাদেশের উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইইউ ও চীন প্রধানতম অংশীদার। রাশিয়ার সঙ্গেও অংশীদারত্ব বাড়ছে। তবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবায়ু কারাগার বলে বাংলাদেশের আঞ্চলিক ও ভূরাজনীতিতে মেরুকরণে যাওয়ার সুযোগ নেই। পুতিনের নেতৃত্বে স্বৈরশাসকদের নবগঠিত বলয় কিংবা কোয়াডসহ সুনির্দিষ্ট জোটভুক্ত অবস্থান বাংলাদেশের জন্য লাক্সারি। একপক্ষীয় বন্ধুত্ব বাংলাদেশের জন্য ‘বিলাসিতা’।
ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার আগ্রাসনে ক্ষমতাবান পরাশক্তিগুলোর দুর্বল প্রতিবেশী দেশের মর্যাদা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে বাঁচার অধিকার সংকুচিত হওয়ার বিরাট আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যা থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। স্বৈরাচারশাসিত মেরু ও শক্তিগুলো ছোট দেশগুলোর ওপর বহুপক্ষীয় সাম্যের বদলে এককেন্দ্রিক আধিপত্য বিস্তারে নীতি ও বলপ্রয়োগের মাত্রা তীব্রতর। ছোট দেশগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন, পরিকল্পনা, ভবিষ্যৎমুখী সামরিক কৌশল, অর্থনীতি সুরক্ষার ক্ষেত্রে তাই আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে নাগরিকের অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বচ্ছ সুশাসন, মানবাধিকার ও টেকসই গণতন্ত্র। বাংলাদেশের স্বার্থের একক কোনো শিবির নেই। মেরুহীন জোট নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার প্রধান রক্ষাকবচ সুশাসন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সুরক্ষা।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার-চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ, বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর, অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবনীয় কথামালা।