সিলেটে হঠাৎ এত বড় বন্যার পেছনে মূল কারণটা হলো অতিবৃষ্টি। উজানের যেসব জায়গা থেকে পানি আসে, সেখানে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। চেরাপুঞ্জিতে ৯০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হয়েছে এক দিনেই। মেঘালয়, আসামে কয়েক দিন ধরে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। সিলেট, সুনামগঞ্জেও প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। বলা হচ্ছে, ১২২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে এ অঞ্চলে। উজানের ঢল ও অতিবৃষ্টিতেই এত ভয়াবহ বন্যা হয়েছে সিলেটে।
সিলেট বা হাওরাঞ্চলের বন্যা দেশের অন্য এলাকার বন্যার চেয়ে ভিন্ন। পাহাড়ি ঢলে যেমন দ্রুত বন্যা হয়, আবার পানি দ্রুত বেরও হয়ে যায়। এখানকার প্রায় ৮৫০ বর্গকিলোমিটারের মতো জায়গা নিচু। মাঝেমধ্যে কিছু বাড়িঘর ছাড়া বর্ষাকালে পুরো এলাকা সাগরের মতো হয়ে যায়। বর্ষাকালে নদ-নদীগুলো অচল হয়ে যায়। এটা এখানকার ভূমিগত বৈশিষ্ট্য। বর্ষাকালে নদ-নদী দিয়ে যে পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি পানি প্রবাহিত হয় হাওরের ওপর দিয়ে। মেঘালয়ের পাহাড় থেকে ভূমি ঢালু হতে হতে মেঘনায় গিয়ে মিশেছে। পানির সঙ্গে হাওরে পাথর ও বালুও এসে মেশে। হাওরের ভূমির এই বৈশিষ্ট্য দেশের অন্য যেকোনো জায়গার চেয়ে ভিন্ন। হাওরের এই বৈশিষ্ট্য বিজ্ঞানসম্মতভাবে না জানলে এখানকার কোনো প্রকল্পই টেকসই হবে না। গত ১০ বছরে হাওর নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। কিন্তু সেটাকে পর্যাপ্ত বলা যাবে না।
এবারের অতিবৃষ্টির পেছনে অনেকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কথা বলছেন। সেটা থাকতেও পারে, আবার না-ও পারে। এবার যতটা বৃষ্টি হয়েছে, সে রকম বৃষ্টি যদি ঘন ঘন হয়, তাহলে সেটাকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হিসেবে বিবেচনা করার প্রসঙ্গ আসবে। তবে সেটা বলার সময় এখনই আসেনি।
হাওরের বিস্তীর্ণ এলাকা খোলা, এ কারণে বর্ষাকালে যখন বাতাস হয়, তখন প্রচুর বড় বড় ঢেউ সৃষ্টি হয়। রাস্তাঘাট, ফসল রক্ষা বাঁধ, মানুষের ভিটেবাড়ি যেগুলো থাকে, সেগুলো একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। হাওর অন্যান্য প্লাবন ভূমির মতো নয়। ফলে হাওরের সমান্তরালে সড়ক বা সেতুর মতো অবকাঠামো নির্মাণ করা যেতে পারে। কিন্তু হাওরের ভেতর দিয়ে বড় সেতু কিংবা গাড়ি চলে, এমন বড় রাস্তা নির্মাণ করা হলে হাওরের স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। আমরা দেখেছি, এ ধরনের সড়ক, সেতু করা হলে সেগুলো দু-চার বছরের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়। এসব সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে হাওরের বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনায় নেওয়া হয় না। ফলে কোথাও রাস্তা নষ্ট হয়েছে, কোথাও সেতু নষ্ট হয়েছে। কোথাও আবার সেগুলো বন্যার কারণও হচ্ছে। হাওর নিয়ে সর্বশেষ যেসব গবেষণা সেই জ্ঞান যদি আমরা ব্যবহার করতে পারি, তাহলে হাওরের অবকাঠামো বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাধা সৃষ্টি করবে না। বরং সেগুলো টেকসই হবে, মানুষের কাজে লাগবে। উড়ালসড়ক হাওরের অবকাঠামোর ক্ষেত্রে একটা ভালো বিকল্প হতে পারে।
হাওরের আচরণ অন্য নদ, নদী বা প্লাবন ভূমির মতো নয়। আবার এই অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য যোগাযোগব্যবস্থাও গড়ে তোলা জরুরি। এ ধরনের বন্যা বাঁধ দিয়ে ঠেকানো সম্ভব নয়। বন্যা ব্যবস্থাপনার দিকেই এখন মূল নজর দিতে হবে। নতুন করে অবকাঠামো নির্মাণ করার আগেও বিশেষজ্ঞদের মতামত কিংবা হাওর নিয়ে যেসব গবেষণা হচ্ছে, সেগুলো বিবেচনা করতে হবে।
এখন সিলেটের সঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চলেও প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। সিলেটের পানি আসামের বরাক নদ দিয়ে সুরমা ও কুশিয়ারায় প্রবেশ করে। এ পানি নদ, নদী ও হাওর দিয়ে মেঘনা নদীতে চলে যায়। এখন ব্রহ্মপুত্রের পানি যদি পদ্মা দিয়ে চাঁদপুরে আসতে থাকে এবং একই সঙ্গে সিলেটের পানি যদি মেঘনা দিয়ে চাঁদপুরে আসে, তাহলে বন্যা পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে সিলেটের পানি নামতে দেরি হবে। হাওরের ক্ষেত্রে সাধারণত এপ্রিল-মে মাসের আগাম বন্যার বিষয়টি বিবেচনা করা হয়। কেননা হাওরে একটাই ফসল বোরো উৎপাদিত হয়। হাওরের প্রধান ফসল। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণের ক্ষেত্রে প্রধানভাবে বিবেচনায় রাখা হয় বোরো ফসল। কিন্তু এবারের বন্যায় আমরা দেখছি, অন্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক। মানুষের ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। সম্পদহানি হয়েছে। গবাদিপশুর জন্য একটা বড় সমস্যা তৈরি হয়েছে। আবার সড়কগুলো ডুবে যাওয়ায় সেখানেও বড় ক্ষয়ক্ষতি হবে। তাই হাওরের অবকাঠামো নির্মাণে সেখানকার প্রতিবেশের বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে। পানিপ্রবাহে কম বাধাগ্রস্ত হয় সে রকম প্রকল্প নিতে হবে।
হাওরের আচরণ অন্য নদ, নদী বা প্লাবন ভূমির মতো নয়। আবার এই অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য যোগাযোগব্যবস্থাও গড়ে তোলা জরুরি। এ ধরনের বন্যা বাঁধ দিয়ে ঠেকানো সম্ভব নয়। বন্যা ব্যবস্থাপনার দিকেই এখন মূল নজর দিতে হবে। নতুন করে অবকাঠামো নির্মাণ করার আগেও বিশেষজ্ঞদের মতামত কিংবা হাওর নিয়ে যেসব গবেষণা হচ্ছে, সেগুলো বিবেচনা করতে হবে। সেগুলো করা হয়নি বলেই এখন অনেকগুলো প্রশ্ন উঠছে।
● ড. মমিনুল হক সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ও নদী গবেষক