সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যা পরিস্থিতির সূচনা হয়েছে। সিলেট, সুনামগঞ্জসহ ওই অঞ্চলে বন্যার কারণে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এবং মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে তিনটি বিষয় আমাদের মনোযোগ দাবি করে।
প্রথমত, এই বন্যার ফলে মানবিক বিপর্যয়ের সময় বন্যাপীড়িতদের সাহায্যে সারা দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ এগিয়ে এসেছেন, পাশে দাঁড়িয়েছেন। মানুষের প্রতি সহমর্মিতার এই প্রকাশ সামাজিক সংহতির ব্যাপারে আমাদের আশাবাদী করে। বিপদের সময় সাধারণ মানুষের ঐক্যই বিপদ মোকাবিলার প্রথম শর্ত। এসব কার্যক্রমকে অব্যাহত রেখেই আমাদের স্মরণ করতে হবে যে এই বিপদ মোকাবিলায় নাগরিকদের আশ্রয়ের জায়গা হওয়ার কথা রাষ্ট্রের; রাষ্ট্রের হয়ে এই কাজ করবে সরকার।
সিলেটের এই বন্যা ১২২ বছরের মধ্যে ভয়াবহ। তাহলে বন্যার পানি সরে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা ঘুরে দাঁড়াবেন কী করে, সেটা নিয়ে সরকারের ভাবনা কী। নাগরিকেরা তাঁদের সাধ্য অনুযায়ী করছেন এবং করবেন, কিন্তু তাঁরা তো সরকারের বিকল্প নয়। সরকারের দায়িত্ব কী, তা কতটুকু পালিত হলো, কেন পালিত হলো না—এ প্রশ্নগুলো তোলা জরুরি।
বন্যার ভয়াবহতার মুখে সরকারের ত্রাণমন্ত্রী যখন প্রথম ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দেন, তাতে বোঝা যায় যে এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কী। যে দেশে মেগা প্রকল্পে লাখো কোটি টাকা বরাদ্দ হওয়া কোনো বিষয় নয়, যে দেশে সরকারি কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণের জন্য অহরহ বিদেশ যান, এমনকি দিঘি পুনঃখননের প্রশিক্ষণ নিতে বিদেশ যেতে চান, সেখানে বন্যা ত্রাণের জন্য অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ নিশ্চয় নীতিগত সিদ্ধান্তের বাইরের বিষয় নয়। এটা একটা উদাহরণমাত্র। প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে মানুষেরা ভয়াবহ বিপদে পড়লেন, তাঁদের পাশে এসে সরকার দাঁড়াচ্ছে কি না। সবচেয়ে বেশি বন্যাপীড়িত এলাকা সিলেট এবং সুনামগঞ্জের সংসদ সদস্যরা, এমনকি ওই অঞ্চলের মন্ত্রীরা পর্যন্ত যে বিপদের প্রথম মুহূর্তে এলাকায় উপস্থিত হননি, সেটা নিশ্চয়ই লক্ষ করার বিষয়।
এ মুহূর্তে সরকারের দায়িত্বের অন্যতম হচ্ছে সবার জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করা, কিন্তু ত্রাণ দেওয়াই একমাত্র বিষয় নয়। ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে যে সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে। যেহেতু ইতিমধ্যে আরও অনেক এলাকাই বন্যাপীড়িত হয়ে পড়েছে, এখনই এ জন্য পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
এক হিসাবে বলা হচ্ছে যে সিলেটের এই বন্যা ১২২ বছরের মধ্যে ভয়াবহ। তাহলে বন্যার পানি সরে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা ঘুরে দাঁড়াবেন কী করে, সেটা নিয়ে সরকারের ভাবনা কী। নাগরিকেরা তাঁদের সাধ্য অনুযায়ী করছেন এবং করবেন, কিন্তু তাঁরা তো সরকারের বিকল্প নয়। সরকারের দায়িত্ব কী, তা কতটুকু পালিত হলো, কেন পালিত হলো না—এ প্রশ্নগুলো তোলা জরুরি। কেননা সরকার ও রাষ্ট্রের এই জবাবদিহির অনুপস্থিতি প্রমাণ করে যে সরকার নাগরিকের জন্য নয়, গোষ্ঠীর। বাংলাদেশে জবাবদিহির কাঠামো ও ব্যবস্থা সব সময়ই দুর্বল ছিল, গত কয়েক বছরে তা প্রায় তিরোহিত হয়েছে।
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, এ বন্যার আভাস দেওয়া এবং পূর্বপ্রস্তুতির অভাবের কারণ কী? এ কথা দীর্ঘদিন ধরেই বলা হচ্ছে যে দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু সিলেটের ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় টিআইবির একটি প্রতিবেদনের কথা। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর ২০২০ সালের ডিসেম্বরে টিআইবি বলেছিল ‘প্রাণহানি কমানো, দুর্যোগ মোকাবিলার একটি কাঠামোবদ্ধ মডেল প্রস্তুত করা এবং তা অনেক দেশ কর্তৃক অনুসরণসহ বাংলাদেশ দুর্যোগ মোকাবিলায় যথেষ্ট সুনাম অর্জন করলেও এখানে এখনো যথেষ্ট উৎকর্ষসাধনের সুযোগ আছে এবং এখনই আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই।’
সিলেট এলাকায় গত দুই মাসে এ নিয়ে তিনবার বন্যা হয়েছে। তারপর অকস্মাৎ বন্যার ঢল নামে জুন মাসের ১৬ তারিখ। ভারতের আসাম এবং মেঘালয়ে অতিবৃষ্টির কারণে এ বন্যার সূচনা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের বন্যার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল কি না। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে যে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র এ বিষয়ে সরকারকে জানিয়েছিল। নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেছেন, ‘একটা বন্যা হবে, সেটা অবশ্যই আমরা আগে আঁচ করতে পেরেছিলাম। তবে বৃষ্টির পরিমাণ যে এত বেশি হবে, সেটা আমাদের আইডিয়া ছিল না। ভারী বৃষ্টি যে হবে, সেই ইঙ্গিত পেয়েছিলাম।’ (বিবিসি বাংলা, ১৯ জুন ২০২২)। এ কথা ঠিক যে আকস্মিক বন্যার মাত্রা একেবারে সঠিকভাবে পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব কি না, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ আছে। কিন্তু যতটুকু জানা গিয়েছিল, সেই মাত্রায় প্রস্তুতি ছিল কী? এ প্রস্তুতিহীনতার দায়িত্ব কার? এ বিষয়ে কোনো ধরনের তদন্ত এবং ব্যবস্থা গ্রহণের ইচ্ছা বা আগ্রহ সরকারের আছে, এমন মনে করার কারণ নেই।
তৃতীয় বিষয় হচ্ছে, বন্যার ভয়াবহতার মাত্রা বৃদ্ধিতে এ অঞ্চলে যেসব অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে, তার ভূমিকা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলামের ভাষ্য অনুযায়ী, এ অঞ্চলের অবকাঠামোগুলো একটি বড় কারণ। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘সিলেট বিভাগে বন্যা এতটা তীব্রতা পাওয়ার কারণ, পানি নামতে বাধা পাচ্ছে। হাওরে নানা অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। এটা পানিপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি করছে। কারণ, এ অঞ্চলের পানি হাওর হয়ে নদী দিয়ে নেমে যায়। শুধু এ অবকাঠামো নয়, পাশাপাশি নদী নাব্যতা হারিয়েছে। এতে পানি দ্রুত সরতে পারছে না’ (ডয়চে ভেলে, ১৮ জুন ২০২২)।
যদিও কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন, কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, শুধু এ অঞ্চলেই নয়, সারা দেশেই অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখা এবং পরিবেশের ওপরে এগুলোর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সামান্যই বিবেচিত হয়। সিলেট অঞ্চলের খাদ্যগুদাম বা বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত বন্যা মোকাবিলা করার মতো করে নির্মাণ করা হয়নি, কিন্তু নয়নাভিরাম পথ তৈরির ব্যাপারে উৎসাহের অভাব হয়নি। এগুলো বিরাজমান ‘উন্নয়ন দর্শন’-এর বাইরের বিষয় নয়।
বন্যা এবং বন্যা-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় উদ্যোগের সময় এ তিন বিষয় বিবেচনায় নেওয়া জরুরি, নাগরিকদের দরকার এসব বিষয়ে সজাগ থাকা। চলমান বন্যাকে কেন্দ্র করে এসব প্রশ্ন, কিন্তু এগুলো কেবল বন্যা বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলার মধ্যেই সীমিত নয়।
● আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট