১৭ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের লক্ষ্যে একটি আইনের খসড়া মন্ত্রিসভা অনুমোদন করে, পরবর্তী সময়ে ২৩ জানুয়ারি যা বিল আকারে সংসদে উত্থাপন করা হয়। নয়টি ধারাসংবলিত প্রস্তাবিত আইনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
১. আইনে প্রধান বিচারপতির মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির সভাপতিত্বে ছয় সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠনের বিধান রয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতির মনোনীত দুজন বিশিষ্ট নাগরিক। ২. কমিটি রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে কমিশনে নিয়োগের জন্য নাম আহ্বান করবে এবং ১০ জনের নাম ১০ কার্যদিবসের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে। ৩. সুপারিশকৃত ব্যক্তিরা বাংলাদেশের নাগরিক, ন্যূনতম ৫০ বছর বয়স্ক এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি পদে অন্যূন ২০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হবে। ৪. সরকারের বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা থাকবে এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবে। ৫. আগে গঠিত ‘অনুসন্ধান কমিটি ও তৎকর্তৃক সম্পাদিত কার্যাবলি এবং উক্ত অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ বৈধ ছিল বলিয়া গণ্য হইবে এবং উক্ত বিষয়ে কোনো আদালতে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’
আইনের খসড়াটি নিয়ে এরই মধ্যে অনেক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে: প্রথমত, আমাদের সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে আইনের ‘বিধানাবলি সাপেক্ষে’ নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেওয়ার বিধান থাকলেও গত ৫০ বছরে এ আইন প্রণীত হয়নি, যার জন্য অনেক দিন ধরেই সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) পক্ষ থেকে আমরা সোচ্চার ছিলাম। এ লক্ষ্যে একটি আইনের খসড়া আমরা আইনমন্ত্রীর কাছে গত ১৮ নভেম্বর হস্তান্তরও করেছিলাম। সে সময়ে মন্ত্রী বলেছিলেন, আইনটি প্রণয়নের জন্য পর্যাপ্ত সময় নেই। কিন্তু এখন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষের মাত্র এক মাস আগে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই মন্ত্রিসভা আইনটির খসড়া অনুমোদন করে, যার ফলে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে অনেকেরই মনে গুরুতর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, আইনমন্ত্রী আমাদের বলেছেন, সংসদকে পাশ কাটিয়ে আইনটি প্রণয়ন করা ঠিক হবে না। কিন্তু প্রস্তাবিত বিলে অনুসন্ধান কমিটিতে সংসদের কোনো প্রতিনিধিত্ব রাখা হয়নি এবং নামগুলো যাচাই-বাছাইয়ের জন্য প্রচলিত প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে কোনো বিশেষ সংসদীয় কমিটির কাছে প্রেরণেরও বিধান নেই। আমাদের প্রস্তাবিত খসড়ায় তিনজন সাংসদ রাখার বিধান রয়েছে, যার মধ্যে একজন হবেন সংসদ নেতার, একজন বিরোধী দলের নেতার এবং অন্যজন সংসদের তৃতীয় বৃহত্তম দলের মনোনীত, যার ফলে আইনটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রথাগত ভূমিকার বাইরেও সংসদের গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ সংশ্লেষ থাকবে।
তৃতীয়ত, আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘এই আইনটা এমন একটি আইন হওয়া উচিত, যেটা গ্রহণযোগ্য হবে সবার কাছে। শুধু এক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হলে তো এটা সর্বজনীন আইন হলো না’ (প্রথম আলো, ২০ জানুয়ারি ২০২২)। কিন্তু বাস্তবে সরকারের বাইরের কোনো অংশীজনের সঙ্গে কোনোরূপ আলাপ-আলোচনা ছাড়া সম্পূর্ণ গোপনে মন্ত্রিসভা বিলটি অনুমোদন করে, যা সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নের উদ্রেক করেছে।
একটি আইন করে পুরোনো অস্বচ্ছ প্রক্রিয়াকে নতুন মোড়ক দিলে সে উদ্দেশ্য তো পূরণ হবেই না, উল্টো আরও বিতর্কের সৃষ্টি করবে, যা এরই মধ্যে ঘটেছে এবং আস্থার সংকট আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মধ্যে আলাপ-আলোচনা ও একটি রাজনৈতিক সমঝোতা।
চতুর্থত, আইনের খসড়াটি পর্যালোচনা করলে মনে হয় যে এটি প্রণয়ন করা হয়েছে আগের মতো গঠিত অনুসন্ধান কমিটিকে আইনের আবরণে আনার এবং অতীতের দুটি অনুসন্ধান কমিটির কাজের বৈধতা দেওয়ার লক্ষ্যে। বস্তুত, এটি ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতির জারি করা প্রজ্ঞাপনেরই সামান্য চুনকাম করা রূপ, যা–ও বিতর্ক সৃষ্টি করে।
পঞ্চমত, বিলটি আগে গঠিত অনুসন্ধান কমিটির কার্যক্রমকে হেফাজত প্রদানের মাধ্যমে রকিবউদ্দীন কমিশন ও নূরুল হুদা কমিশনের নিয়োগের বৈধতা দিয়েছে। কিন্তু তারা আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে এবং আমাদের ভোটাধিকার হরণ করেছে, যার সুরক্ষা দিতেই স্বাধীন সাংবিধানিক পদে তঁারা নিয়োগপ্রাপ্ত। আমরা ৪২ জন নাগরিক বর্তমান কমিশনের বিরুদ্ধে গুরুতর অসদাচরণ ও দুর্নীতির অভিযোগে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তদন্ত করার জন্য রাষ্ট্রপতির শরণাপন্ন হয়েছিলাম। রাষ্ট্রপতি আমাদের অভিযোগের প্রতি কোনোরূপ কর্ণপাত করা তো দূরের কথা, আমাদের দুটি চিঠির প্রাপ্তিস্বীকারও করেননি।
ষষ্ঠত, প্রস্তাবিত বিল এবং প্রজ্ঞাপনে অন্তর্ভুক্ত অনুসন্ধান কমিটির কাঠামো একই। উভয়তেই দুজন বিচারক, দুজন অন্য দুই সাংবিধানিক পদাধিকারী এবং বাকি দুজন রাষ্ট্রপতির মনোনীত ব্যক্তি। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সাংবিধানিক পদাধিকারীরাও দলীয়করণের ঊর্ধ্বে নন। এ ছাড়া অনুসন্ধান কমিটির দুজন বিশিষ্ট নাগরিক, সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশেই নির্ধারিত হবেন। এভাবে স্বাধীনচেতা বা ভিন্নমতাবলম্বী ব্যক্তির পরিবর্তে ‘পরীক্ষিত’ ব্যক্তিরাই অনুসন্ধান কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হবেন, যা অতীতে ঘটেছে। একই ধরনের ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ভিন্ন চরিত্রের হবেন এবং মেরুদণ্ড প্রদর্শন করবেন, তা আশা করাও দুরাশা। প্রসঙ্গত, সুজনের প্রস্তাবিত অনুসন্ধান কমিটিতে তিনটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরাই শুধু থাকবেন না, এতে অন্তর্ভুক্ত নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদ্বয় রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে অন্য সদস্যদের দ্বারা মনোনীত হবেন, যেখানে প্রধানমন্ত্রীর কোনো ভূমিকাই থাকবে না।
সপ্তমত, বিলটিতে বলা হয়েছে যে অনুসন্ধান কমিটি কমিশনে নিয়োগের জন্য ‘যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অনুসন্ধান করিবে এবং এতদুদ্দেশ্যে রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী সংগঠনের নিকট হইতে নাম আহ্বান করিতে পারিবে।’ গণমাধ্যমের সুবাদে আমরা জেনেছি যে রাজনৈতিক দলের দেওয়া তালিকা থেকে বর্তমান নূরুল হুদা কমিশনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফলে বর্তমান কমিশনারগণের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই দলীয় সংশ্লেষের অভিযোগ উঠেছে। তাই কমিশনে নিয়োগের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল থেকে নাম আহ্বান করা হবে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
অষ্টমত, প্রস্তাবিত খসড়ায় রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে নাম আহ্বান করার মধ্যেই অনুসন্ধান কমিটির ‘অনুসন্ধান’ সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে, যা সত্যিকারভাবে কোনো অনুসন্ধানই নয়। উপরন্তু, কমিটিকে মাত্র ১০ কার্যদিবস সময় দেওয়াও কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। সুপারিশ তৈরির ক্ষেত্রে অনুসন্ধান কমিটির জন্য কোনো নারীকে বিবেচনায় রাখার বাধ্যবাধকতার অনুপস্থিতিও অগ্রহণযোগ্য।
নবমত, প্রস্তাবিত আইনে নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের যে ছকবাঁধা যোগ্যতার মাপকাঠি দেওয়া হয়েছে—যেমন নাগরিকত্ব, বয়স, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ এবং এগুলোর পক্ষে দালিলিক প্রমাণ পাওয়া সম্ভব। তবে নির্বাচন কমিশনের মতো সংবেদনশীল প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্তির জন্য, যে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব শত প্রতিবন্ধকতার মুখে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান, আরও গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা হলো সততা, সাহসিকতা ও নিরপেক্ষতা, যার কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া অসম্ভব। আর এ জন্যই অনুসন্ধানের প্রয়োজন। সুপারিশকৃত নামগুলো প্রকাশ করলেও এগুলো পাবলিক স্পেসে আলোচনার মাধ্যমেই এ সম্পর্কে তথ্য বেরিয়ে আসবে এবং বিতর্কিত অতীতসম্পন্ন ব্যক্তিরা অনাগ্রহী হবেন বা বাদ পড়ে যাবেন। প্রসঙ্গত, নিয়োগের আগে নূরুল হুদার নাম প্রকাশিত হলে তিনি যে অতীতে বিএনপির রোষানলে পড়েছিলেন এবং আওয়ামী লীগের আনুকূল্য পেয়েছিলেন, তা বেরিয়ে আসত।
দশমত, নিয়োগপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আরেকটি কারণেও গুরুত্বপূর্ণ। অনুসন্ধান কমিটি সুপারিশকৃত নামগুলোর তালিকা প্রকাশ করলেই জানা যাবে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এই তালিকা থেকে এসেছেন কি না। যদি না হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে সংবিধানের ৪৮ (৩) আলোকে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশেই নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে, যার ফলে পুরো প্রক্রিয়াই হবে বিভ্রান্তিকর একটি অর্থহীন আনুষ্ঠানিকতা।
পরিশেষে, আমরা বহুদিন থেকেই নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়াকে বিতর্কমুক্ত রাখা এবং স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সঠিক ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়নের দাবি করে আসছি, যাতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে। একটি আইন করে পুরোনো অস্বচ্ছ প্রক্রিয়াকে নতুন মোড়ক দিলে সে উদ্দেশ্য তো পূরণ হবেই না, উল্টো আরও বিতর্কের সৃষ্টি করবে, যা এরই মধ্যে ঘটেছে এবং আস্থার সংকট আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মধ্যে আলাপ-আলোচনা ও একটি রাজনৈতিক সমঝোতা।
● ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক