টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে বাংলাদেশের অগ্রগতির স্বীকৃতিস্বরূপ ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক’ পুরস্কার প্রদান নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য অনেক গর্ব ও আত্মমর্যাদার। এই পুরস্কার জনগণকে উৎসর্গ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকারান্তরে জাতিকে এসডিজি অর্জনের সামনের রাস্তা পার হওয়ার রসদ জুগিয়েছেন। আর জাতিও তাই এসডিজি অর্জনের বাকি পথ পাড়ি দিতে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, বাকি পথ একদিকে যেমন লম্বা, অন্যদিকে তেমন অমসৃণ। তা ছাড়া হাতে সময় আছে মাত্র আট বছরের কিছু বেশি। তাই আমাদের আরও পরিশ্রমী, দক্ষ ও সংহত হতে হবে। পাশাপাশি মানসিক প্রশস্ততাও বাড়াতে হবে। নয়তো এসডিজি অর্জনের গতি শ্লথ হয়ে যেতে পারে।
দেশের বড় একটি শ্রেণি রাজনীতিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে টেন্ডার-বাণিজ্য ও দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্র ও জনগণের অর্থ লুট করে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। এর কারণে একদিকে যেমন দুর্বল অবকাঠামো গড়ে উঠছে, অন্যদিকে সমাজে আয়বৈষম্য বাড়ছে। আবার প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি বড় অংশের মধ্যে দাপ্তরিক কাজে অমনোযোগিতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। উল্টো, যারা সঠিকভাবে দাপ্তরিক দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করে, তাদের নানা ভুলত্রুটি ঊর্ধ্বতনের সমীপে পেশ করাতে ব্যস্ত থাকে। ফলে পারস্পরিক রেষারেষি ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। আর ওয়ার্কশপ ও সেমিনারে পারিতোষিক প্রথার প্রচলন থাকায় একদিকে যেমন এগুলোর সংখ্যা অত্যধিক পরিমাণে বেড়েছে, অন্যদিকে এগুলোয় উপস্থিত থাকার জন্য দাপ্তরিক কাজের গতি কমে যাচ্ছে। আর এসবের কোনোটিই এসডিজি অর্জনের সঙ্গে মানানসই নয়।
তাই সব দুর্নীতিকে কবর দিয়ে সংকীর্ণতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার পাহাড় চুরমার করে প্রশস্ত হৃদয়ে সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এসডিজি অর্জনের চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে আনতে হবে। আর এই সমন্বিত প্রচেষ্টার গতি বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন খাতে কর্মরত জনবলের মধ্যে সুযোগ-সুবিধাসংক্রান্ত বৈষম্য কমাতে হবে। বর্তমানে সরকারি চাকরিতে বিভিন্ন পেশাজীবীরা (যেমন শিক্ষক, চিকিৎসক, কৃষিবিদ ও প্রকৌশলী) পদোন্নতিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধায় অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে আছে। অথচ পৃথিবীর উন্নত দেশের দিকে তাকালে দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে পেশাজীবীদেরই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। পেশাজীবীদের সঙ্গে বৈষম্য তৈরি করে একদিকে যেমন উন্নয়নের বৈতরণি পার হওয়া যায় না, অন্যদিকে পেশাজীবীরা ক্রমে ক্রমে হীনম্মন্যতায় ভুগে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে, যার লক্ষণ তো আজ বেশ স্পষ্ট। আর পেশাজীবীরা, বিশেষ করে শিক্ষক ও চিকিৎসকেরা হীনম্মন্য হলে কিংবা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লে জাতির জীবনে আশা-ভরসার কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না।
পৃথিবীর উন্নত দেশের দিকে তাকালে দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে পেশাজীবীদেরই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। পেশাজীবীদের সঙ্গে বৈষম্য তৈরি করে একদিকে যেমন উন্নয়নের বৈতরণি পার হওয়া যায় না, অন্যদিকে পেশাজীবীরা ক্রমে ক্রমে হীনম্মন্যতায় ভুগে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে, যার লক্ষণ তো আজ বেশ স্পষ্ট। আর পেশাজীবীরা, বিশেষ করে শিক্ষক ও চিকিৎসকেরা হীনম্মন্য হলে কিংবা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লে জাতির জীবনে আশা-ভরসার কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না।
এসডিজির সব অভীষ্টই গুরুত্বপূর্ণ। তবে ‘গুণগত শিক্ষা’ এবং ‘সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ’ হচ্ছে প্রধান লক্ষ্য, যা অন্যান্য অভীষ্ট অর্জনের টেকসই বনিয়াদও বটে। তাই এ দুই অভীষ্ট অর্জনে এগিয়ে থাকতে পারলে এসডিজি অর্জনের বাকি পথ পাড়ি দেওয়া সহজতর হবে। শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে শিখনের ওপর জোর দিয়ে তৈরি নতুন শিক্ষাক্রম আশার আলো দেখাচ্ছে। যদিও তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই শিখনপদ্ধতি কার্যকরভাবে পরিচালনা ও মূল্যায়নের জন্য একদিকে যেমন উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে, অন্যদিকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে তাঁদের নিরপেক্ষ ও সৎ থাকতে উপযুক্ত বিধান প্রণয়ন করতে হবে। শিক্ষকের কাছে শিক্ষার্থীরা যেন শারীরিক, মানসিক, আর্থিক কিংবা যৌন নির্যাতনের শিকার না হয়, তার জন্য শক্তিশালী প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা থাকতে হবে। সর্বোপরি, শিক্ষার সব ক্ষেত্রে মেধাবীদের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে এবং তাদের ধরে রাখতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
সম্প্রতি শিক্ষকতা পেশা কারা বেছে নেন, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলের কিছু উক্তি সমালোচিত হয়েছে। মর্যাদাহীন কোনো পেশা যে মেধাবীদের প্রথম পছন্দ হবে না, সেটি কি স্বাভাবিক নয়? মানুষের মর্যাদা পরিমাপের ক্ষেত্রে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। মানুষের মর্যাদা এখন আর সততা ও নীতিনৈতিকতার নিক্তিতে মাপা হয় না। টাকাকড়ি, প্রভাব-প্রতিপত্তি, দামি গাড়ি আর আগে-পিছে পাইক-পেয়াদা যার যত বেশি, সমাজের চোখে সে তত বেশি মর্যাদাবান। শিক্ষকতা পেশায় এসবের তো কিছুই নেই। পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে মর্যাদার আসনে বসাতে হলে হয় সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে, তা না হলে শিক্ষকতা পেশায় চলমান বৈষম্য দূর করতে হবে। আমাদের দৃঢ় আশা, সব বৈষম্য দূর করে সরকার শিক্ষকদের মর্যাদা পুনরুদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে এবং শিক্ষকতা পেশাকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে প্রয়াসী হবে। প্রয়োজনে এ ক্ষেত্রে করণীয় নির্ধারণে জাতীয় কমিশনও গঠন করা যেতে পারে।
শিক্ষার পাশাপাশি স্বাস্থ্যের অভীষ্ট অর্জনেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। অতীতের অসামান্য ভূমিকায় দেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে এবং ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পুরস্কারও পেয়েছে। এসডিজির ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত অভীষ্টের বহুমুখী দিক (সবার জন্য গুণগত মানের প্রয়োজনীয় সব স্বাস্থ্যসেবা বিনা খরচে বা সহনীয় খরচে দেওয়া) থাকায় এই গোল অর্জন অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং, তবে অসম্ভব নয়। কিন্তু গতানুগতিক পরিবর্তন বা জোড়াতালি দিয়ে স্বাস্থ্যের অভীষ্ট অর্জনে কিছুটা এগিয়ে থাকলেও তা তো টেকসই হবে না। আর এই ধারা অব্যাহত থাকলে স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত অভীষ্ট অর্জন করতে না পারার জন্য সামগ্রিক এসডিজি অর্জনে পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
কর্মক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিবেশের অভাব, সহায়ক জনবলের তীব্র সংকট, প্রমোশনবঞ্চনা কিংবা প্রমোশনে ধীরগতি, সিন্ডিকেট, দালাল চক্রের হাতে জিম্মি হওয়াসহ নানাবিধ সংকটে স্বাস্থ্য খাত জর্জরিত। গুণগত স্বাস্থ্যসেবার ক্রমবর্ধমান প্রয়োজন এবং চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে মানুষের উন্নত সেবাপ্রাপ্তির যে প্রত্যাশা বেড়েছে, তা এ খাত পূরণ করতে পারছে না। আর এ প্রভাব পড়ছে চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্কের ওপর। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্কের একটি উদ্বেগজনক চিত্র ফুটে উঠেছে। দেশের বেশির ভাগ মানুষের চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে, যা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। অন্য কথায়, স্বাস্থ্যব্যবস্থার নানা সীমাবদ্ধতার জন্য জনগণ-চিকিৎসক সমাজ আজ মুখোমুখি, যা দেশের জন্য মোটেও সুখকর নয়; আর এসডিজি অর্জনে তো নয়ই। তাই সময় থাকতেই স্বাস্থ্য খাতের কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নই জাতির প্রত্যাশা।
● ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়