বাংলাদেশ বাণিজ্য ঘাটতির দেশ। অর্থাৎ আমরা যা রপ্তানি করি, তার চেয়ে অনেক বেশি আমদানি করি। এরপরও আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শূন্য হয়ে যায় না। বরং অনেক সময়ই সেটা বাড়ে। কারণ, আমাদের প্রবাসী কর্মীরা বেশ বড় অঙ্কের একটা টাকা দেশে পাঠান। এ ছাড়া আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যুক্ত হয় বৈদেশিক অনুদান, ঋণ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের (ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট, এফডিআই) অর্থ। ওদিকে আমদানি ছাড়াও বিদেশি ঋণের সুদ এবং আসল পরিশোধে আমাদের রিজার্ভ থেকে বিদেশি মুদ্রা বেরিয়ে যায়।
দীর্ঘকাল থেকে আমাদের লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষায় প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আমরা জানি, প্রবাসীদের যে অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে আসে, সেটাই সরাসরি দেশের রিজার্ভে যুক্ত হয়। এর বাইরে অনেকে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠান। দেশের অভ্যন্তরে এটার বড় অর্থনৈতিক প্রভাব থাকলেও এই টাকা আমাদের রিজার্ভে যুক্ত হয় না।
সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যপতন হচ্ছে খুব দ্রুত। এই সংকটে সরকার সম্ভবত সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়তে যাচ্ছে রেমিট্যান্স দেশে আনা নিয়ে। এই লেখা যখন লিখছি, তখন সরকারের নির্ধারিত ডলারের মূল্য প্রায় ৮৮ টাকা। অথচ ব্যাংকেই এটা ৬ থেকে ৮ টাকা বেশি দামে কেনাবেচা হচ্ছিল।
এদিকে সম্প্রতি সরকার নতুন কতগুলো পদক্ষেপ নিয়েছে, যাতে ব্যাংকগুলোকে সরকারের নির্ধারিত দামে ডলার কেনাবেচা করতে হবে। এটা একেবারেই ভুল পদক্ষেপ, অনেক সমস্যার সঙ্গে এতে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো অনেক কমে যাবে। ব্যাংক আর খোলাবাজারে ডলারের বিনিময় মূল্যের পার্থক্যের তুলনায় ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় প্রেরণের জন্য আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা অনেক কম। গত রোববার প্রথম আলোর রিপোর্টে দেখা যায়, প্রবাসী আয়ে সর্বোচ্চ ৮৯ টাকা ৮০ পয়সা দর দিতে পারবে ব্যাংকগুলো। হুন্ডিতে এলে মিলবে ৯৫ থেকে ৯৬ টাকা।
ডলার নিয়ে সংকটের শুরুর দিকেই হুন্ডি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় সরকারের পক্ষ থেকে প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে, তাঁরা যেন তাঁদের অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠান। সঙ্গে আমাদের কেউ কেউ প্রবাসীদের ‘নসিহত’ করার চেষ্টা করেন তাঁরা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠালে সেটা টাকা পাচারকেই উৎসাহিত করে।
টাকা পাচার নিয়ে বাস্তবতাটা আগে দেখা যাক। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) বিভিন্ন দেশের ব্যাংকিং চ্যানেলে পাচারকৃত টাকার হিসাব দেয়। ২০১৫ সাল পর্যন্ত হিসাবে দেখা গিয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো পাচার হয় ব্যাংকিং চ্যানেলে। অর্থাৎ এসব টাকা পাচার হয়েছে আমদানি করা পণ্যের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্য দেখিয়ে আমদানির সময় টাকা বাইরে পাঠিয়ে (ওভার ইনভয়েসিং) আর রপ্তানি মূল্য কম দেখিয়ে কম টাকা দেশে এনে অনেক টাকা বাইরে রেখে দেওয়ার (আন্ডার ইনভিয়েসিং) মাধ্যমে।
মজার ব্যাপার, ব্যাংকিং চ্যানেলের এই পাচার হওয়ার পেছনে সরকারের প্রত্যক্ষ সহায়তা এবং যোগসাজশ আছে। কিছুদিন আগে জিএফআই আবার টাকা পাচারের তথ্য দিয়েছে। সেখানে তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে তথ্য দিয়েছে ২০১৫ সালের আগের ডেটার ওপরে নির্ভর করে। সংস্থাটি জানায়, ২০১৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘে তার আমদানি-রপ্তানি নিয়ে তথ্য দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। একটি শিশুও বুঝবে এই হিসাব দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ার কারণ কী।
সম্প্রতি দেশের ডলারের চাহিদা বৃদ্ধির পেছনে আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্য সংকটকে সবাই দেখাচ্ছেন। আমি বিশ্বাস করি, এর পেছনেও টাকা পাচারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। গত কয়েক মাসে বাংলাদেশে গড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি হয়েছে। আর গত মাসে এটা পৌঁছেছিল ৮ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে। ওই মাসে রপ্তানি বেড়ে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন হয়েছিল, কিন্তু তবু পার্থক্যটা খুব বড়।
গত কয়েক মাসে বাংলাদেশ থেকে আসলে বড় অঙ্কের টাকা আমদানির নামে পাচার হয়েছে। নির্বাচন কাছে এলে দেশের টাকা পাচারের পরিমাণ বেড়ে যায়, এটা আমরা জিএফআইয়ের পূর্ববর্তী রিপোর্টে দেখেছি। ২০১৪–এর নির্বাচনের আগে পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছিল। আরেকটি নির্বাচন সামনে রেখে এখন আবার পাচার বাড়ারই কথা।
প্রশ্ন হচ্ছে এত আমদানি কেন? করোনার সংকটে পড়ে মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অনেক কমে গেছে। তাতে মানুষের ভোগ করার ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে নানা পণ্য, পণ্য তৈরির কাঁচামাল কিংবা পণ্য উৎপাদনকারী ‘ক্যাপিটাল মেশিনারি’ আমদানির পরিমাণ অনেক বেড়ে যাওয়ার তো কোনো কারণ নেই। তৈরি পোশাকশিল্পে প্রবৃদ্ধির কারণে তার আনুষঙ্গিক আমদানি বেড়েছে নিশ্চয়ই। এ ছাড়া বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার সংকটের কারণে জ্বালানি তেলসহ নানা পণ্যের মূল্য বেড়েছে, বেড়েছে জাহাজভাড়া। তাতে আমদানি করা পণ্যের পরিমাণ না বাড়লেও ডলারের অঙ্কে বাড়ার কথা। কিন্তু এসব তথ্য কি বাংলাদেশের মাসিক আমদানি ৪ বিলিয়ন ডলার থেকে ৭ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলারে চলে যাওয়াকে ব্যাখ্যা করে?
আমরা এ কথা অনেকেই বলছি না, বললেও বলছি খুব নিচু স্বরে যে গত কয়েক মাসে বাংলাদেশ থেকে আসলে বড় অঙ্কের টাকা আমদানির নামে পাচার হয়েছে। নির্বাচন কাছে এলে দেশের টাকা পাচারের পরিমাণ বেড়ে যায়, এটা আমরা জিএফআইয়ের পূর্ববর্তী রিপোর্টে দেখেছি। ২০১৪–এর নির্বাচনের আগে পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছিল। আরেকটি নির্বাচন সামনে রেখে এখন আবার পাচার বাড়ারই কথা।
ওদিকে এই রিজার্ভের টাকা খরচ করে নানা প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে ভয়ংকর দুর্নীতি হয়। বলাবাহুল্য, বর্তমানে যেনতেন দুর্নীতি করার একটা বড় শক্তি, সাহস হিসেবে কাজ করে একটা স্বাস্থ্যবান রিজার্ভ। এই রিজার্ভের টাকা নিয়ে প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষাসফরের নামে সরকারি আমলারা প্রমোদভ্রমণ করে বেড়ান নানা দেশে। দুই দেশে শিক্ষাসফর শেষ করে ফেরার পরদিন অবসরে গেছেন, এমন একজন সচিবের গল্প মাত্র কয়েক দিন আগেই আমরা দেখেছিলাম প্রথম আলোতে। ক্ষতি স্বীকার করেও ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে পাঠানো টাকা এভাবেই নয়ছয় হতে দেখেন প্রবাসীরা।
আমাদের এই প্রশ্ন খুব জোর দিয়ে করা দরকার, প্রবাসী কর্মীদের জন্য সরকার কী করে? বছর তিনেক আগে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের একটি রিপোর্ট অনুসারে, বিদেশ যেতে পৃথিবীতে বাংলাদেশি শ্রমিকদেরই সবচেয়ে বেশি টাকা গুনতে হয়। রিপোর্টটি বলছে, ভারতীয় শ্রমিকদের বিদেশ যেতে খরচ হয় ১ লাখ ৮০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা। নেপালের ক্ষেত্রে যেটা এক লাখের নিচে। আর ফিলিপাইন সরকার তো ঘোষণাই দিয়েছে অভিবাসন ব্যয় শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার। অথচ বাংলাদেশের একজন শ্রমিকের বাইরে যেতে সাড়ে ৭ লাখ থেকে ৮ টাকা পর্যন্ত গুনতে হচ্ছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, সর্বোচ্চ খরচ করে সর্বনিম্ন বেতন পাচ্ছেন বাংলাদেশিরাই।
যেসব কারসাজির কারণে মানুষকে এই অকল্পনীয় পরিমাণ বেশি টাকা খরচ করতে হয়, সেগুলোর ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা সরকার কখনো নেয়নি। এর একটাই ব্যাখ্যা—সব কারসাজি থেকে অর্জিত টাকা আর একটা হিস্যা বণ্টিত হয় সরকারের উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত। বিদেশে যাওয়ার জন্য জমি, এমনকি ভিটে বিক্রি করে, ঋণগ্রস্ত হয়ে নাভিশ্বাস উঠে যাওয়া ভীষণ প্রান্তিক লাখ লাখ মানুষের টাকায় পরিপুষ্ট হয় হাতে গোনা কিছু মানুষ।
প্রবাসী কর্মীরা চরম কোনো সংকটে পড়লেও সকারকে পাশে পান না। করোনার সময় দেশে ফেরত আসা প্রবাসীরা কেমন আছেন, সেটা জানতে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম গত বছরের এপ্রিল ও মে মাসে একটি জরিপ পরিচালনা করে। সে জরিপে জানা যায়, কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির সময় দেশে ফেরত আসা অভিবাসী কর্মীদের ৮৭ শতাংশেরই কোনো আয়ের উৎস নেই। ৭৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁরা এখন প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও ভীতির মধ্যে রয়েছেন। ৩৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁদের নিজেদের সঞ্চয় বলতে এখন আর কিছু নেই। সবচেয়ে বড় কথা, ৯১ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা সরকারি বা বেসরকারি কোনো সহায়তা পাননি।
এই দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি বৈদেশিক কর্মীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন তো আছেই, সঙ্গে তাঁদের পাঠানো এই টাকা এ দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙা রাখে। প্রাথমিক দৃষ্টিতে তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানির অঙ্কটা বড় মনে হলেও এটা থেকে বাদ যাবে পোশাকের এই সব পণ্য তৈরি করার জন্য আমদানির পরিমাণ। তাতে তৈরি পোশাকের বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত আয় রপ্তানির ২০ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশের বেশি হওয়ার কথা নয়। অর্থাৎ প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের নিট আয় তৈরি পোশাকের চেয়ে বেশি, এটা নিশ্চিত।
সমাজের উঁচুতলার একটা শক্তিশালী গ্রুপ হওয়ার কারণে তৈরি পোশাকমালিকেরা খুব জোরগলায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রপ্তানির মূল খাত হিসেবে নিজেদের দাবি করেন এবং সরকার থেকে বাগিয়ে নিতে পারেন নানা সুবিধা। ওদিকে সমাজের অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ হওয়ার কারণে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসী কর্মীরা সংগঠিত নন এবং তাঁদের আর্থসামাজিক অবস্থানের কারণেই এ রাষ্ট্র তাঁদের প্রাপ্য ন্যূনতম স্বীকৃতিটুকু দেয় না।
এমন একটি দেশে বর্তমানের অতি উচ্চ মূল্যস্ফীতির (সরকারের হিসাবের চেয়ে অন্তত দ্বিগুণ) বাজারে পরিবার কিছু বেশি টাকা পাবে, সেটাই তো ভাবার কথা প্রবাসীদের। সেটা যেভাবে পাওয়া যাবে, সেভাবেই স্বজনদের কাছে টাকা পাঠানোর কথা তাঁদের। বলা বাহুল্য, দেশে থাকা পরিবারের সদস্যরা তাঁদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষার তেমন কিছুই পায় না এই রাষ্ট্রের কাছে। খেয়ে–পরে বাঁচার সঙ্গে সঙ্গে পড়াশোনা, চিকিৎসার জন্য তাঁদের হাতে টাকা থাকতে হবে, এমনকি হাতে টাকা রাখতে হবে তাঁদের করের টাকায় পোষা সরকারের সেবাপ্রাপ্তির জায়গায় ঘুষ দেওয়ার জন্যও।
ডা. জাহেদ উর রহমান ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক