ইউক্রেনের সীমান্তে রাশিয়ার বিপুলসংখ্যক সেনা মোতায়েন ইতিহাসে নতুন নজির সৃষ্টি করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যদি ক্রেমলিন ট্রিগার টানে, তাহলে তারা নিজেরাই এমন এক বিপদের মুখে পড়তে পারে, যার মুখে আগে কখনো কোনো আক্রমণকারী বাহিনীকে পড়তে হয়। এ বিপদ সৃষ্টি করবে ইউক্রেনের চারটি এলাকায় বসানো চারটি পরমাণু জ্বালানি চুল্লি, যেগুলো থেকে উৎপাদিত জ্বালানি দেশটির মোট চাহিদার অর্ধেক উৎপন্ন করে থাকে।
পারমাণবিক চুল্লি একটি ভয়ংকর জিনিস। আঘাত হানা হলে এ স্থাপনাগুলো কার্যকরভাবে রেডিওলজিক্যাল মাইনে পরিণত হতে পারে। আর ইউক্রেনের এ চুল্লিগুলো যদি সে ধরনের কিছু হয়ে বসে, তাহলে রাশিয়া নিজেই দুর্ঘটনা-পরবর্তী বায়ুবাহিত তেজস্ক্রিয় ধ্বংসাবশেষের শিকার হবে। এ কারণে ইউক্রেনের পারমাণবিক চুল্লিগুলোর নাজুক অবস্থা এবং যুদ্ধে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা মানব সম্প্রদায় ও পরিবেশের ওপর যে ভয়ানক প্রভাব ফেলবে, তা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে বিবেচনায় নিতে হবে। এসব দিক ভেবে তাঁকে ঠিক করতে হবে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ইউক্রেন যুদ্ধের যোগ্য কি না।
আধুনিক যুদ্ধে জ্বালানি কেন্দ্রগুলো সাধারণভাবে প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়ে থাকে, কারণ কোনো দেশের জ্বালানি কেন্দ্র ধ্বংস করতে পারলে তা সেই দেশের যুদ্ধ চালানোর ক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়। কিন্তু পারমাণবিক চুল্লি অন্যান্য সাধারণ জ্বালানি শক্তি উৎসের মতো নয়। এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে তেজস্ক্রিয় উপাদান থাকে। এসব তেজস্ক্রিয় উপাদান যেকোনোভাবে অবমুক্ত হয়ে যেতে পারে। যেমন বিমান থেকে ফেলা বোমা কিংবা কামানের গোলায় চুল্লির রাসায়নিকের গুদাম ভেঙে দিতে পারে। যে কুল্যান্ট লাইনগুলো পারমাণবিক চুল্লিকে স্থিতিশীল রাখে বোমা কিংবা কামানের শেলে তা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। সুতরাং, এমনকি সাইবার হামলার মাধ্যমেও পারমাণবিক চুল্লির কাজ বাধাগ্রস্ত করা যেতে পারে।
কোনো কারণে যদি একটি চুল্লির কোর গলে যায়, তাহলে বিস্ফোরক গ্যাস বা তেজস্ক্রিয় ধ্বংসাবশেষগুলো কন্টেনমেন্ট কাঠামো থেকে বেরিয়ে যাবে। তা বায়ুমণ্ডলে ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আণবিক বর্জ্যগুলো হাজার হাজার মাইলজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে। শহুরে এবং গ্রামীণ এলাকায় অতি বিষাক্ত তেজস্ক্রিয় উপাদান দীর্ঘ মেয়াদে বসে যাবে। আর যদি পারমাণবিক জ্বালানির মজুতে যদি আগুন ধরে যায়, তাহলে আরও অনেক বড় ধ্বংসের কারণ হতে পারে।
এসব দিক বিবেচনায় নিলে ক্রেমলিনের পক্ষে ইউক্রেনে যুদ্ধ চালানো সম্ভব হবে না। পুতিন ভালো করেই জানেন, সর্বাত্মক যুদ্ধ লেগে গেলে ইউক্রেনের পরমাণু চুল্লি থেকে রেডিওলজিক্যাল দুর্যোগ বাধার ঝুঁকি আছে। ইউক্রেনের কোনো চুল্লি যদি দুর্ঘটনার মুখে পড়ে, তাহলে শুধু ইউক্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, সেই ক্ষতির অভিঘাত রাশিয়াকেও দীর্ঘ মেয়াদে ছুঁয়ে যাবে।
এ ধরনের বিপর্যয় মানবদেহের জন্য কতটা ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনে, তা সংশ্লিষ্ট এলাকার জনসংখ্যা এবং তেজস্ক্রিয় উপাদানগুলোর বিষাক্ততার ওপর নির্ভর করবে।
সাবেক সোভিয়েতভুক্ত ইউক্রেনের প্রিপিয়াত শহরের কাছের চেরনোবিল পারমাণবিক চুল্লিতে ১৯৮৬ সালে যে দুর্ঘটনা ঘটেছিল, তার অভিঘাত মানবদেহ এবং পরিবেশের ওপর দীর্ঘ মেয়াদে কতটা প্রভাব ফেলেছে, তা গবেষণা করে দেখার জন্য জাতিসংঘের চেরনোবিল ফোরাম গঠিত হয়েছে। ওই ফোরামের গবেষণা বলছে, ওই দুর্ঘটনাজনিত কারণে ৫০ বছরে ক্যানসারে সাধারণভাবে যত লোক মারা যাবে, তার চেয়ে অতিরিক্ত আরও পাঁচ হাজার লোক ক্যানসারে মারা যাবে। প্রকৃতপক্ষে, দুর্ঘটনার পর কয়েক বছর ধরে ইউক্রেন ও আশপাশের এলাকায় হাজার হাজার থাইরয়েড ক্যানসার দেখা দিয়েছে।
কোভিড মহামারিতে লাখ লাখ মানুষ মারা যাওয়ায় পারমাণবিক চুল্লির দুর্ঘটনাজনিত এ প্রাণহানিকে তুচ্ছ মনে হতে পারে। কিন্তু এ ঝুঁকিকে তুচ্ছ হিসেবে গণ্য করলে তা বড় ধরনের ভুল হবে। মনে রাখতে হবে, চেরনোবিলের দুর্ঘটনার পর মাটিতে বসে যাওয়া তেজস্ক্রিয় উপাদানের বিধ্বংসী ক্ষমতা কমাতে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষকে হাজার হাজার লোককে সরিয়ে নিতে হয়েছিল এবং কয়েক দশক ধরে বিস্তীর্ণ এলাকার কৃষিজমিতে ফসল উৎপন্ন করার বন্ধ রাখতে হয়েছিল। দুর্ঘটনার পর চুল্লির ভেতরের পরিবেশ এবং আশপাশ পরিষ্কার করার জন্য ওই সময় ‘লিকুইডেটর’ হিসেবে ছয় লাখ লোক মোতায়েন করা হয়েছিল। আরও বিষাক্ত পদার্থ যাতে নির্গমন লাভ করতে না পারে, সে জন্য প্রকৌশলীরা চুল্লি ভবনের ওপরে একটি অতিকায় কফিনের মতো ‘সারকোফ্যাগাস’ তৈরি করেছিলেন। ওই দুর্ঘটনায় লাখ লাখ মানুষ মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল এবং সরকারকে প্রায় ৭০ লাখ লোককে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল। এতে অর্থনৈতিক ক্ষতি হাজার হাজার কোটি ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল। ২০১১ সালে ফুকুশিমা বিপর্যয়ের পর জাপানকে এখনো শত শতকোটি ডলারের ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে।
এসব দিক বিবেচনায় নিলে ক্রেমলিনের পক্ষে ইউক্রেনে যুদ্ধ চালানো সম্ভব হবে না। পুতিন ভালো করেই জানেন, সর্বাত্মক যুদ্ধ লেগে গেলে ইউক্রেনের পরমাণু চুল্লি থেকে রেডিওলজিক্যাল দুর্যোগ বাধার ঝুঁকি আছে। ইউক্রেনের কোনো চুল্লি যদি দুর্ঘটনার মুখে পড়ে, তাহলে শুধু ইউক্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, সেই ক্ষতির অভিঘাত রাশিয়াকেও দীর্ঘ মেয়াদে ছুঁয়ে যাবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
বেনেট র্যামবার্গ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যুরো অব পলিটিক্যাল-মিলিটারি অ্যাফেয়ার্সের সাবেক বিদেশ সংক্রান্ত কর্মকর্তা