‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’—কথাটার মর্ম যখন কর্মচারী বোঝে না, কর্তার তখন ‘ঘর্ম বহে গাত্রে’। কারণ, তখন কর্তার ইচ্ছাকে বাইপাস করে ছাইপাঁশ মার্কা কর্ম সম্পাদিত হয় কর্মচারীর ইচ্ছায়। তখন কর্তা পড়ে ফাপরে। কর্তা তখন বুঝতে পারে তার ‘ইচ্ছা’র তালুকে তলেতলে কর্মচারী বাঘের মতো ভাগের থাবা বসিয়ে ফেলেছে। ওদিকে তার চাকরি খাওয়াও যায় না, কারণ তদ্দিনে কোপন কর্তার গোপন খবরভরা হাঁড়ি কর্মচারীর বগলের তলে চলে গেছে। কিছু বললে সে সেই হাঁড়ি জুতসই কোনো হাটে গিয়ে ঠাস করে ফাটিয়ে দিতে পারে। ‘না যায় কওয়া, না যায় সওয়া’ টাইপের দুর্গতিতে পড়ে কর্তার তখন ‘আমার প্যাটের ছাও, আমারেই খাতি চাও?’—বলে আছাড়িপিছাড়ি করা ছাড়া গতি থাকে না।
কিছুদিন ধরে এই কিসিমের আহাজারি কোনো কোনো এমপি সাহেবের মুখে শোনা যাচ্ছে। তাঁদের কাউকে কাউকে ‘সব গেল, সব গেল’ টাইপের ‘মর্সিয়া মাতমে’ সংসদের বর্তুলাকার কক্ষের বাতাস ভারী করে তুলতে দেখা যাচ্ছে। তাঁদের ক্ষোভ ও হতাশামিশ্রিত ভাষণের চুম্বক কথা হলো, দেশ চালানোর খবরদারি এখন দেশের মালিক ওরফে জনগণ ওরফে জনপ্রতিনিধিদের হাতে আর নেই। তা বেহাত হয়ে জনগণের কর্মচারী ওরফে আমলাদের হাতে চলে গেছে। এই কষ্টের কথা ফেসবুক বা টুইটারে শেয়ার না করে তাঁরা তা সংসদের ‘শেয়ারহোল্ডারদের’ কাছে শেয়ার করছেন।
সর্বশেষ ১৭ জানুয়ারি, ময়মনসিংহ-৩ আসনের সরকারদলীয় সাংসদ নাজিম উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘একজন এমপির মূল্যায়ন নাই। এমপি হিসেবে একজন সচিবের কাছে গেলে তাঁরা যেভাবে শ্রদ্ধা করবেন, সেই শ্রদ্ধাবোধ নাই। সচিবালয়ে পিয়ন পর্যন্ত আমাদের দাম দেয় না।’
এর আগে ২৮ জুন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সাংসদ তোফায়েল আহমেদ সংসদে বলেছিলেন, ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী সাংসদেরা সচিবদের ওপরে। এটা খেয়াল রাখতে হবে।’
ওই একই দিন সংসদে জাতীয় পার্টির সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ বলেছিলেন, ‘দেশ চালাচ্ছে কারা? দেশ চালাচ্ছেন জগৎ শেঠরা। দেশ চালাচ্ছেন আমলারা। আমরা রাজনীতিবিদেরা এখন তৃতীয় লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। এই হচ্ছে আমাদের দুর্ভাগ্য। অথচ এই দেশ স্বাধীন করেছেন রাজনীতিবিদেরা।’
করোনার ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয়ে ৬৪ জেলায় একজন করে সচিবকে দায়িত্ব দেওয়ায় ক্ষোভ ঝেড়ে তিনি তখন বলেছিলেন, ‘প্রতিটি জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সচিবদের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের সঙ্গে কথা বলেন। আর এমপি সাহেবেরা পাশাপাশি বসে থাকেন, দূরে। এরপর বলে, “ডিসি সাব, আমি একটু কথা বলব প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে।” এই হচ্ছে রাজনীতিবিদদের অবস্থা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের সঙ্গে যখন কথা বলেন, তখন এমপিদের কোনো দাম থাকে না।’
ওই জুন মাসেই পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘আমলাতন্ত্র মন্দ নয়, আমলাতন্ত্র ভালো। আমলাতন্ত্রের বিকল্পও তো নাই। (এর বিকল্প) কেউ বাইর করতে পারে নাই। সোভিয়েতও পারে নাই, চীনারাও পারে নাই; ফেরাউনও পারে নাই, খলিফারাও পারে নাই।’ তাঁর আমলাতন্ত্রের অপরিহার্যতার বর্ণনায় আমলাদের প্রশংসা যতটা না ধরা পড়ে, তার চেয়ে শ্লেষ ধরা পড়ে বেশি।
জনপ্রতিনিধিদের এই শ্লেষ কোথাও কোথাও ঝগড়াঝাঁটি, এমনকি মারামারি পর্যন্ত গড়িয়েছে। গত বছর ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের উপনির্বাচনের সময় ফরিদপুর-৪ আসনের সাংসদ নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক ও নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তাদের হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। সে সময় ইউএনও ও সাংসদের একটি ফাঁস হওয়া ফোনালাপ ভাইরাল হয়েছিল। সেখানে সাংসদকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে শোনা গিয়েছিল এবং সে ঘটনায় সরকারি কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন নিক্সন চৌধুরীকে আইনের আওতায় আনার দাবিও জানিয়েছিল।
রাষ্ট্রের মালিক অর্থাৎ জনগণের একজন প্রতিনিধি যখন বলেন, একজন পিয়নও তাঁদের ‘দাম দেয় না’, তখন বুঝতে হবে কর্তার ইচ্ছায় কর্ম হচ্ছে না। কর্ম চলে গেছে কর্মচারীর ইচ্ছার অধীনে। তার মানে, কর্তা আসলে কর্তার জায়গায় নেই। অথবা কর্মচারী মনে করছেন, চেয়ারে বসা থাকলেও আদতে তিনি কর্তাই নন।
গত ১৮ আগস্ট রাতে বরিশাল সদর উপজেলা কমপ্লেক্সের ভেতরে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ব্যানার অপসারণ নিয়ে ইউএনওর বাসায় হামলা হয়েছিল এবং সে ঘটনায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মেয়র সাদিক আবদুল্লাহকে হুকুমের আসামি করে মামলা করেছিল। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকেও ইউএনও, ওসিসহ ৪০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল।
ঘটনার পর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতিতে এই হামলার বিষয়টিকে ‘দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি’ হিসেবে উল্লেখ করে মেয়রকে গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়েছিল। পরে অবশ্য দুই পক্ষের ‘সমঝোতা’ হয়েছিল।
সব মিলিয়ে আন্দাজ করি, সচিবালয়ের একজন পিয়নের কাছেও সাংসদের ‘দাম’ না পাওয়া এবং সেই কারণে সচিবালয় ও সংসদের মধ্যকার চাপা ক্ষোভ এখন খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছে। মুজিব বর্ষের অনুষ্ঠান এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে আমলাদের যেভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে অনেক নেতা দুঃখ প্রকাশ করেছেন। করোনার ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয়ে সব জেলায় সচিবদের দায়িত্ব দেওয়ায় সাংঘাতিক বেজার হয়েছেন তাঁরা। এমনকি বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন কাকে দেওয়া হবে আর কাকে দেওয়া হবে না, তা ঠিক করার বিষয়ে সাংসদদের মতের চেয়ে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া নিয়েও আলোচনা আছে।
রাষ্ট্রের মালিক অর্থাৎ জনগণের একজন প্রতিনিধি যখন বলেন, একজন পিয়নও তাঁদের ‘দাম দেয় না’, তখন বুঝতে হবে কর্তার ইচ্ছায় কর্ম হচ্ছে না। কর্ম চলে গেছে কর্মচারীর ইচ্ছার অধীনে। তার মানে, কর্তা আসলে কর্তার জায়গায় নেই। অথবা কর্মচারী মনে করছেন, চেয়ারে বসা থাকলেও আদতে তিনি কর্তাই নন।
কিন্তু এক দিনে তো এ অবস্থা আসেনি। এ কথা ঠিক, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী, এমপিরা আমলাদের ওপরে; কারণ এমপিরা রাষ্ট্রের মালিক তথা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে চেয়ারে বসেন। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনে তো সেটা হয়নি। যে এমপি সাহেবেরা এখন ‘মান গেল সম্মান গেল’ বলে চেঁচাচ্ছেন, সরকারের মালিকদের ভোট নিয়ে তাঁদের প্রতিনিধি হয়ে যদি আজ চেয়ারে বসতেন, তাহলে পিয়ন তো দূরের কথা, গোটা সচিবালয় যথার্থ কর্মচারী হয়ে মালিককে সেলাম ঠুকতে বাধ্য থাকত। কারণ, জনপ্রতিনিধি এবং জনপ্রশাসকের সংঘাত এক সুবিদিত সত্য হলেও তার চেয়ে বড় সত্য হলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিই ক্ষমতার একমাত্র আধার; তিনিই কর্তা এবং তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছাই শেষ কথা। কপাল খারাপ, সেই সত্য এখন তড়পাচ্ছে।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]