২০৩৫ সালের মধ্যে একটি বিআরটিসহ পাঁচটি রুটে মেট্রোরেল চালুর পরিকল্পনা বাস্তবায়নাধীন। ১৩ বছর পর সব রুটে যখন মেট্রোরেল চালু হবে, তখনো পরিবহনব্যবস্থার মাত্র ১৭ ভাগ চাপ সামাল দেওয়া যাবে। অর্থাৎ মেট্রোতে যানজট পরিস্থিতি পুরোপুরি যাবে না। সরকার ঢাকার মাটির নিচের ২৫ থেকে ৭০ ফুট গভীরে ৪০ লাখ যাত্রীর পারাপারের সক্ষমতার ১১টি পাতালরেল নিয়ে ভাবছে। কিলোমিটারপ্রতি যার নির্মাণ ব্যয় প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা, মোট খরচ বাংলাদেশের দুই বছরের রাজস্ব আয়ের প্রায় কাছাকাছি। ঢাকার কার্যকর ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ না করে, জলাবদ্ধতা-ড্রেনেজ সংকট ও জলবায়ু ঝুঁকির পরিপ্রেক্ষিতে এসব মেগা প্রকল্প আদৌ টেকসই কি না, এ প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাতালরেলের যাত্রীদের মাসেই ভাড়া গুনতে হবে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। খরচের বাস্তবতা, বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রতা বিবেচনায় এমন উন্নয়ন প্রকল্প আসলে মানুষের জীবনযাত্রার সার্বিক মান কতটা প্রভাব ফেলবে!
পদ্মা সেতুর রাজস্ব আয় বনাম অর্থনৈতিক উপযোগিতা
এদিকে পদ্মা সেতুতে ফেরির তুলনায় দেড় থেকে পৌনে দুই গুণ টোল প্রস্তাব করা হয়েছে, এতে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। উচ্চ টোলের কারণে পদ্মা সেতু থেকে মানুষ যেসব আর্থিক সুবিধা ও সাশ্রয়ের উপযোগ পাওয়ার কথা ছিল, সেটা পুরোপুরি নাও আসতে পারে; বরং উচ্চ হারের টোলের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সুবিধাদি জনগণকে না দিয়ে বরং সরকার জনগণের কাছ থেকে আদায় করে নেওয়ার আয়োজন করেছে। অর্থাৎ পদ্মা বহুমুখী সেতু (সড়ক ও রেল মিলে) জিডিপিতে যে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বর্ধিত প্রবৃদ্ধি যোগ করার প্রাক্কলন হয়েছে, সেটা হবে না হয়তো। সেতুকে সংযোগকারী জেলা থেকে দেশের অন্য প্রান্তে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন খরচ বাড়লে দক্ষিণের জেলাগুলোর কৃষি ও শিল্পপণ্য দেশের অন্য অঞ্চলের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না।
যেহেতু ছোট, মাঝারি ও বড় ট্রাক–লরিতে টোলের হার অসহনীয়, তাই নিশ্চিত যে এই উচ্চ পরিবহনভাড়ায় দক্ষিণাঞ্চলের শিল্পবিকাশ বিঘ্নিত হবে। এমনিতেই দক্ষিণাঞ্চল ঝড় ও দুর্যোগপ্রবণ বলে সেখানে শিল্পও বিস্তারের হার কম। এদিকে সরকার ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতেও টোল নেবে। ভূমি অধিগ্রহণে ব্যাপক দুর্নীতির কারণে প্রতি কিলোমিটারে ২০০ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়ে যাওয়ায় সেখানেও উচ্চ টোল হার পড়বে বলে ধারণা করি। ঢাকা থেকে দক্ষিণের উপকূলীয় জেলা পর্যন্ত সড়কে রয়েছে আরও দুটি টোল সেতু ও ফেরি। এতগুলো সেতু ও সড়কে উচ্চ হারে টোল দিলে সেটা দক্ষিণাঞ্চলের শিল্পবিকাশ বিঘ্নিত করবে নিশ্চিত। দিন শেষে দক্ষিণের মানুষের পকেট কাটার উপকরণ হয়ে উঠবে সড়ক ও সেতুর টোল।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জ্যামে পড়লে, ফেরিতে কারিগরি সমস্যা, কুয়াশা কিংবা ঝড়ে পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ রুটে ফেরি চলাচলে সমস্যা হলে সেখানকার যানবাহনের কিছু অংশ বিকল্প পথ হিসেবে বেশি দূরত্ব পাড়ি দিয়েও পদ্মা সেতু ব্যবহার করার চেষ্টা করবে। এতেও অর্থনৈতিক উপযোগ আসবে। কিন্তু টোল বেশি হলে এটা সম্ভব হবে না, একদিকে বেশি দূরত্বের কারণে জ্বালানি খরচ বেশি হবে, অন্যদিকে কয়েক হাজার টাকা টোল বেশি দিতে হবে। পদ্মা সেতুর প্রস্তাবিত টোলে দূরত্ব, জ্বালানি খরচ ও অর্থনৈতিক উপযোগ তৈরির ত্রিপক্ষীয় সমন্বয় নেই। গতানুগতিক বেশি রাজস্ব আয়ের ধান্দায় তৈরি হয়েছে পদ্মা সেতুর এই টোলের হার। অর্থনৈতিক বিকাশে গতি আনার জন্য বুদ্ধিদীপ্ত কোনো চিন্তাতাড়িত নয়, বরং এ যেন জাতীয় বাজেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ঘাটতির পরিপ্রেক্ষিতে ঋণগ্রস্ত সরকারের বাড়তি অর্থ আয়ের যেনতেন কৌশল। মোটরযান চলাচলের জন্য উপযোগী রাস্তা করতে সরকার অতি উচ্চহারে বার্ষিক রুট-ফি নেয়, বিগত দশকে যা প্রায় তিন গুণ হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি সেতুতেও টোল দিতে হবে কেন?
বাংলাদেশে রাস্তা ও সেতু করতে বিশ্বের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে। বুলেট ট্রেন, পাতালরেলের মতো মেগা প্রকল্প সম্ভাব্যতার নামে সরকার ৫০০ কোটি টাকার বেশি গচ্চা গেছে। অন্তত ১০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা অলস বসে থাকলেও সরকার অপ্রয়োজনীয় ভাড়ায় চালিত ৫টি কেন্দ্রের চুক্তি নবায়ন করেছে, যা বিগত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদনই করেনি। ১২ বছরে পিডিবি বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৭৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। সব মিলে উচ্চ সরকারি ব্যয় প্রতিশ্রুত অর্থনৈতিক সুবিধা তৈরি করছে না। আমরা সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার উন্নতি ও কর্মসংস্থানে অপ্রতিরোধ্য ‘উন্নয়ন’–এর প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি না।
পায়রা বন্দর আয়হীন থেকে যাবে কি
পায়রা বন্দর সমুদ্রবন্দরের সুবাস নিয়ে আসলে একটি নদীবন্দর। পায়রা সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় বাধা পলিপতিত রামনাবাদ চ্যানেল। হিমালয়বিধৌত নদীগুলো অব্যাহত পলি বহন করে আনার কারণে পায়রার মতো প্রশস্ত নদী চ্যানেল অগভীর থাকে। জাপানের সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বন্দরটি সক্রিয় রাখতে ক্রমাগত ‘ক্যাপিটাল ড্রেজিং’ প্রয়োজন। ৪০ নটিক্যাল মাইল দীর্ঘ এবং ২২০ মিটার প্রশস্ত একটা চ্যানেল নিয়মিত ভিত্তিতে ১০ মিটার পর্যন্ত নিয়মিত ড্রেজিং করে গভীর সমুদ্রবন্দর সচলে বার্ষিক ৩০০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের খরচ হয়ে যেতে পারে। এ বার্তা রাজনীতিবিদেরা উপেক্ষা করেছেন।
জাইকার প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘এমন ব্যয়ের পর পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর ফিজিবল নয়।’ বন্দর নির্মাণে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করে, ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঋণের পর সরকার সম্প্রতি বুঝতে পেরেছে যে এটি কোনোভাবেই গভীর সমুদ্রবন্দর হচ্ছে না। মনে হচ্ছে বন্দরটি কয়েক বছর আগে চীন থেকে কেনা পুরোনো সাবমেরিনের ল্যান্ডিং স্টেশন এবং তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা ব্যবস্থাপনার কেন্দ্র হবে। এমনকি পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা নিয়ে আসা জাহাজগুলো সরাসরি জেটিতে ভিড়তেও খননকাজ করে যেতে হবে নিয়মিত। ইতিমধ্যেই পায়রা বন্দরের জন্য খননকাজে রামনাবাদ চ্যানেলের খননে বরাদ্দ হয়েছে ৪৩৭ কোটি টাকা। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের স্বল্প উপযোগ তৈরির কিংবা প্রায় অবাঞ্ছিত প্রকল্পে জনগণের অর্থ অপব্যবহার করলে কি সময়মতো সুফল মিলবে? পায়রা বন্দর আগামী ২০ বছরে ঠিক কত কোটি টাকা আয় করতে পারবে?
রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র শুরু থেকেই লোকসানে?
৯০ শতাংশ রাশিয়ার ঋণে সোয়া লাখ কোটি টাকায় নির্মিতব্য রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম চুল্লি স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালন গ্রিডের নকশা তৈরি এবং নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমের আরোপিত অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং নিষেধাজ্ঞার খড়্গ প্রকল্পটিতে পড়ার ঝুঁকি আছে। অন্যদিকে, চুল্লি প্রস্তুত হয়ে গেলেও সঞ্চালন গ্রিডের অভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যথাসময়ে উৎপাদনে যেতে পারবে না, বরং অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। সুন্দরবনের পাশে বহুল বিতর্কিত রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। প্রথমত, রামপালের আশপাশে কোনো বড় শহর অর্থাৎ বিদ্যুৎ ব্যবহারের লোড সেন্টার নেই বলে একেবারে দূরবর্তী অঞ্চল থেকে অতি খরুচে সঞ্চালন লাইন করা খরুচে এবং কারিগরি ফিজিবিলিটির বাইরে থাকছে। সঞ্চালন লাইন অসম্পূর্ণ বলে রামপাল কেন্দ্রও পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদনে যেতে পারছে না, এতে উদ্বোধনের শুরু থেকেই খরুচে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে।
জলবায়ু, দুর্যোগ, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়প্রবণ অতি ঘনবসতিপূর্ণ দেশে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজ ও এতৎসংক্রান্ত অভিজ্ঞতা নেওয়ার প্রাথমিক ফেজ সম্পন্ন হয়নি। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ অভিজ্ঞতা তৈরি না হলেও সরকার নিষেধাজ্ঞায় পড়া রাশিয়ান ঋণে দ্বিতীয় আরেকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, যা দক্ষিণের উপকূলে, সুন্দরবনের ঠিক পাশেই। সুন্দরবনসংলগ্ন অঞ্চলে ক্রমাগত বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্প স্থাপনের ধারা থেকে বোঝা যায়, সরকার সুন্দরবন সুরক্ষার বিষয়ে আদৌ সচেতন নয়। জায়গাটা দেশের সবচেয়ে বড় ইলিশ প্রজনন অঞ্চলেরও অন্তর্ভুক্ত। উপরন্তু, আইলা ও সিডরের মতো ঘূর্ণিঝড় ও প্রলয়ংকরী জলোচ্ছ্বাসের প্রবাহপথের ওপর একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বসানো কোনো ছেলেখেলা নয়।
বাংলাদেশে রাস্তা ও সেতু করতে বিশ্বের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে। বুলেট ট্রেন, পাতালরেলের মতো মেগা প্রকল্প সম্ভাব্যতার নামে সরকার ৫০০ কোটি টাকার বেশি গচ্চা গেছে। প্রায় ৬০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋণে নেওয়া ভ্যাট অনলাইন প্রকল্প প্রায় পুরোটাই ভেস্তে গেছে। অন্তত ১০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা অলস বসে থাকলেও সরকার অপ্রয়োজনীয় ভাড়ায় চালিত ৫টি কেন্দ্রের চুক্তি নবায়ন করেছে, যা বিগত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদনই করেনি। ১২ বছরে পিডিবি বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৭৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। সব মিলে উচ্চ সরকারি ব্যয় প্রতিশ্রুত অর্থনৈতিক সুবিধা তৈরি করছে না। আমরা সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার উন্নতি ও কর্মসংস্থানে অপ্রতিরোধ্য ‘উন্নয়ন’–এর প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি না।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার— ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ’, ’বাংলাদেশ অর্থনীতির ৫০ বছর’, ’অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা’, ’উন্নয়ন প্রশ্নে বাংলাদেশের কিছু সংকট ও সম্ভাবনা’।[email protected]