প্রমত্ত পদ্মায় সেতু নির্মাণ বাংলাদেশের জন্য বিশাল অর্জন। এ সেতুর কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে মধ্যাংশের যোগাযোগ সহজতর হবে। শুধু দেশের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নেই না আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতেও এর গুরুত্ব রয়েছে। এ সেতুকে ঘিরে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির গতি পাল্টে যেতে পারে। এত দিন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য খেলোয়াড় ছিল। কিন্তু চীন গুটি গুটি পায়ে দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছে।
পদ্মা সেতু নির্মাণে চীনের সহায়তা এর প্রতিফলন। এ সেতু নির্মাণে সহায়তা করে চীন দক্ষিণ এশিয়ায় তার অবস্থান আরও শক্তিশালী করার সুযোগ পেল। বরং বলা যায়, পদ্মা সেতু দিয়ে চীন দক্ষিণ এশিয়ার মূল ভূখণ্ডে প্রবেশের সুযোগ তৈরি করল। এর আগে শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে বড় বড় প্রকল্পে চীনের উপস্থিতি ছিল। পাকিস্তানের গাওদার বন্দর যতটা না দক্ষিণ এশিয়ার, তার থেকে বেশি ইরানের নিকটবর্তী। গাওদার বন্দর ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্তানকে সংযুক্ত করবে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) পরিকল্পনার আওতায়। কিন্তু পদ্মা সেতু বিআরআইয়ের মাধ্যমে চীনকে ভারতের দোরগোড়ায় এনে দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় গুরুত্বপূর্ণ পালাবদলের ইঙ্গিত পদ্মা সেতু নির্মাণসংক্রান্ত পুরো ঘটনায় বিদ্যমান।
গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিপরীতে চীনকেন্দ্রিক নতুন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান আমরা লক্ষ করছি।
কূটনীতিতে পূর্বানুমান করতে হয়। এ পূর্বানুমান অনুসারে ভূরাজনীতির ঘুঁটি চালতে হয়। পূর্বানুমানের সব চাল সঠিক হয় না। তবে ঘুঁটির বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার প্রতিপক্ষের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। পদ্মা সেতু একই সঙ্গে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চীনা চাপ সৃষ্টি করবে। পদ্মা সেতুর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অত্যন্ত জটিল। তাই এ সেতু নিয়ে চীনের উচ্ছ্বাস ভিন্ন মাত্রার।
যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট পলিসি সেন্টারের হিসাব মতে, ২০০৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চীন চাইনিজ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংকের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের ৮৫৮টি প্রকল্পে ৪৬২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এ সময়ে বিশ্বব্যাংকের ব্যয় ছিল ৪৬৭ বিলিয়ন ডলার। ধারণা করা হচ্ছে, বর্তমানে চীন উন্নয়ন খাতের বিনিয়োগে বিশ্বব্যাংক পেছনে ফেলে দিয়েছে। চীন মূলত যোগাযোগ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নে বিনিয়োগ করেছে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, চীন অবকাঠামো কূটনীতি নিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। এ কারণে আফ্রিকা বা এশিয়ার অনেক দেশই অবকাঠামোর উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক বা উন্নত বিশ্বের ঋণ ও সহায়তার ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল থাকছে না। পশ্চিমের সহায়তা ছাড়াই অনেক দেশে বড় বড় অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে।
দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক, জাপানসহ বড় বড় দাতা দেশ ও সংস্থাগুলো সরে গেলেও চীন পদ্মা সেতু নির্মাণে সহায়তা করেছে। সরকার পদ্মা সেতু প্রকল্পকে দুই ভাগে দেখিয়েছে। মূল সেতুর জন্য খরচ হয়েছে ৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। এ টাকা সরকার নিজের বাজেট থেকে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের বাজেটে ঘাটতি বেড়েছে। ফলে সরকারকে বাজেট সহায়তা নিতে হয়েছে। এ জন্য বিদেশ থেকে বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকার ঋণ নেয়। এ ঋণ সরকার যে কোনো খাতে ব্যয় করতে পারে। আর পদ্মা সেতুর দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে রেল প্রকল্প। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সরকার চীনের কাছ থেকে ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে। সেই হিসেবে পুরো পদ্মা সেতু প্রকল্পের কিছু অংশ সরকারের আর কিছু অংশ চীনের ঋণের টাকায় বাস্তবায়িত হয়েছে।
পদ্মা সেতুতে যুক্ত হয়ে চীন সবাইকে একটি বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। বার্তাটি হচ্ছে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এখন আর যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের ওপর নির্ভরশীল নয়। তাদের ছাড়াও যেকোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব। চীনের হাতে প্রযুক্তি ও অর্থ দুটিই আছে। ফলে চীনা সহায়তায় শুধু পদ্মা সেতুই নয়, এ অঞ্চলে আরও কিছু বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের উদাহরণ আছে। শ্রীলঙ্কায় বিমান ও সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। মিয়ানমারের আরাকান এলাকায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের কথা শোনা যায়। আমাদের পায়রা বন্দর ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। তিস্তা নদীর নাব্যতা রক্ষায় চীনের বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহের কথা শোনা যায়।
মূলত ভূরাজনীতিতে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতকে পেছনে ফেলে নিজের অবস্থান পোক্ত করার জন্য চীন দক্ষিণ এশিয়ায় একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক রাজনীতিতে চীন প্রথমেই বিশ্বব্যাংককে হারিয়ে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের পরাজয় মানে কার্যত যুক্তরাষ্ট্রেরই পরাজয়। এতে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র চীনের থেকে পিছিয়ে গেল। পদ্মা সেতু করে দেওয়ার বিনিময়ে চীন বাংলাদেশে আরও কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে। ফলে আমাদের দেশে চীনের কৌশলগত উপস্থিতি ক্রমশই দৃশ্যমান হবে। এতে বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব আরও বৃদ্ধি পাবে।
বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে সামরিক জোট গঠন করে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকানোর চেষ্টা করছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এ নীতিতে ভারতও যোগ দিয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই চীনের উত্থানকে ঠেকাতে পারছে না। ফলে দিন দিন দক্ষিণ এশিয়া চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ছায়াযুদ্ধের ক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে। তবে এ রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতকে যতটা দিশাহীন মনে হচ্ছে, তার বিপরীতে চীন যথেষ্ট বাস্তবভিত্তিক কৌশল অবলম্বন করে এগোচ্ছে।
আবারও পদ্মা সেতুর প্রসঙ্গে ফিরে আসি। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি, ভোটারবিহীন নির্বাচন, গুম, বিনা বিচারে হত্যাসহ নানাবিধ কারণে সরকার যখন বেকায়দায়, ঠিক তখনই অর্থ সহায়তা নিয়ে হাজির হয়েছে চীন। ভাবমূর্তি সংকটে ভোগা সরকারের জন্য এই অর্থ ছিল বিশেষ সুযোগ। সরকার পদ্মা সেতুসহ বিভিন্ন বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করে জনসাধারণকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করছে। চীন বুঝতে পেরেছিল, ঠিক কোন সময়ে বাংলাদেশ সরকারকে অর্থ সহায়তার প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। বলা যায় চীন যথাসময়েই বাংলাদেশের দরজায় টোকা দিয়েছে।
চীনের এই সঠিক সময়ে সঠিক দরজায় টোকা দেওয়ার কৌশলই দক্ষিণ এশিয়ায় বিআরআই বাস্তবায়নে হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। যদিও বাংলাদেশ ও চীন সরকার উভয়েই আনুষ্ঠানিকভাবে অস্বীকার করেছে, পদ্মা সেতু বিআরআইয়ের অংশ নয়। দুই দেশই কূটনৈতিক সতর্কতা বজায় রেখেছে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। পায়রা বন্দর থেকে পদ্মা সেতু পর্যন্ত চীন রেলপথ নির্মাণ করবে। ফলে পায়রা বন্দর থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা দিয়ে যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়ে প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প প্রকল্প পর্যন্ত রেলপথে বা সড়কপথে সরঞ্জামাদি নিয়ে যাওয়া যাবে। উল্লেখ্য চীন তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহী। তিস্তা নদীতে চীনের প্রকল্প বাস্তবায়ন মানে ভারতের একদম কাছাকাছি চীনের অবস্থান নিশ্চিত হওয়া। ভারতের ‘চিকেন নেক’ থেকে আমাদের তিস্তার দূরত্ব হাতছোঁয়া। ফলে দক্ষিণ দিক থেকে চীন ভারতের আরও কাছাকাছি চলে যাবে। অরুণাচল ও ভুটান সীমান্তে চীনের আগে থেকেই উপস্থিতি আছে। এবার ভারতকে দক্ষিণ দিক থেকে চাপে রাখার সুযোগ করে দিতে পারে পদ্মা সেতু।
কূটনীতিতে পূর্বানুমান করতে হয়। এ পূর্বানুমান অনুসারে ভূরাজনীতির ঘুঁটি চালতে হয়। পূর্বানুমানের সব চাল সঠিক হয় না। তবে ঘুঁটির বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার প্রতিপক্ষের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। পদ্মা সেতু একই সঙ্গে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চীনা চাপ সৃষ্টি করবে। পদ্মা সেতুর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অত্যন্ত জটিল। তাই এ সেতু নিয়ে চীনের আগ্রহ ভিন্ন মাত্রার। তবে চীনের এ উত্থানকে স্বভাবতই যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত সহজভাবে গ্রহণ করবে না। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে পারে। যেমনটা আমরা সম্প্রতি শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে দেখেছি।
ড. মারুফ মল্লিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক