পদ্মা সেতু: আমাদের ইচ্ছাশক্তির জয়

বাংলাদেশের আর কোনো প্রকল্পকে এত নিবিড়ভাবে এ দেশের মানুষ অনুসরণ করেনি
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশের ছোট–বড় অনেক প্রকল্প নিয়ে সন্তুষ্টি যেমন আছে, সমালোচনাও আছে। অনেক প্রকল্পে নকশাগত ত্রুটি বা কারিগরি দুর্বলতা আছে। তৈরির কিছুদিনের মধ্যে সেতু ভেঙে পড়ার ঘটনাও আছে। এমন ফ্লাইওভারও আছে, যেগুলো যানজট কমানোর পরিবর্তে বাড়াচ্ছে বরং। প্রকল্পে বরাদ্দকৃত অর্থ সঠিকভাবে খরচ না করা বা নয়ছয় করার অভিযোগ আছে। এসবই বাংলাদেশের বাস্তবতার অংশ। দুর্নীতি নির্মূলে আন্তরিকতার অভাব দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে নিয়ে ব্যক্তি পর্যায় পর্যন্ত সর্বত্র। বস্তুত যে সমাজে সততার একটি সংজ্ঞা হচ্ছে ‘সুযোগের অভাব’, সেখানে নানা নয়ছয়ের অভিযোগ ওঠাটা স্বাভাবিক। প্রকল্পের খরচের সঙ্গে প্রকল্প থেকে পাওয়া লাভের হিসাবের গরমিলও আছে। বাংলাদেশে বাস্তবায়িত
অনেক প্রকল্পের খরচের তুলনায় উপকার বা সুবিধা পাওয়া গেছে কম। দু–একটি প্রকল্প পরিবেশের যে ক্ষতি করবে, তা দীর্ঘ মেয়াদে এদের থেকে পাওয়া লাভকে পেছনে ফেলে দেবে।

পদ্মা সেতু নিয়ে আলোচনার শুরুতে এই কথাগুলো বলার কারণ হচ্ছে, এই বিশাল প্রকল্প নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা এবং কারও কারও সমালোচনা। কিন্তু পদ্মা সেতু এমনই এক প্রকল্প, যা নিয়ে মানুষের সন্তুষ্টি শুধু নয়, আছে গর্ব এবং স্বপ্নও। বাংলাদেশের আর কোনো প্রকল্পকে এত নিবিড়ভাবে এ দেশের মানুষ অনুসরণ করেনি। সেই ২০১২ সাল থেকে নিয়ে সেতু নির্মাণ শেষ হওয়া পর্যন্ত নিয়মিত এর অগ্রগতির খোঁজ মানুষ নিয়েছে। সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন না করার ঘোষণায় মানুষ হতাশ হলো। অনেকেই এটিকে অনুন্নত একটি দেশের ভবিতব্য বলে মেনে নিল। কিন্তু যেদিন প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন, বাংলাদেশ নিজের পয়সায় সেতুটি করবে, মানুষ উদ্বেলিত হলো। অনেকেই প্রশ্ন তুললেন, এটি আদৌ সম্ভব কি না? কিন্তু নানা চড়াই-উতরাই শেষে যখন নির্মাণকাজ শুরু হলো, মানুষ প্রচুর উৎসাহ নিয়ে কাগজে-টিভির পর্দায় চোখ রাখতে শুরু করল। যখন প্রথম স্প্যানটি দৃশ্যমান হলো, দেশের মানুষ উচ্ছ্বাস দেখাল। এরপর থেকে শুরু হলো শতাংশের হিসাব। সেতুর কাজ শেষ হলে শুরু
হলো সেতুর সম্পূর্ণ কাজের অগ্রগতি শতাংশে গোনা। এই জুনের মাঝামাঝিতেও দেখলাম, সেতুর ২ শতাংশ কাজ বাকি। আমরা জানি, সেতুতে রেলপথ চালু না হওয়া পর্যন্ত এর শতভাগ পূর্ণতা আসবে না। তবে সেদিনও বেশি দূরে নয়।

এই বিশাল প্রকল্প নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা এবং কারও কারও সমালোচনা। কিন্তু পদ্মা সেতু এমনই এক প্রকল্প, যা নিয়ে মানুষের সন্তুষ্টি শুধু নয়, আছে গর্ব এবং স্বপ্নও। বাংলাদেশের আর কোনো প্রকল্পকে এত নিবিড়ভাবে এ দেশের মানুষ অনুসরণ করেনি।

আর সবার মতো আমিও পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ নিয়মিত অনুসরণ করেছি। যেদিন বিশ্বব্যাংককে জানিয়ে দেওয়া হলো এই প্রকল্প তাদের অর্থায়ন ছাড়াই হবে, আমি একটা স্বস্তি পেয়েছিলাম। এতে কিন্তু লাভটা হলো আমাদের। আমরা শক্তিশালীদের না বলতে শিখলাম। একটি জাতি হিসেবে এই আত্মপ্রত্যয় আমাদের পাওনা ছিল। প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তা না দেখালে, দেশীয় বিশেষজ্ঞরা সমর্থন না দিলে, মানুষ এই প্রকল্পের পেছনে না দাঁড়ালে, মিডিয়া একে স্বপ্নের নির্মাণ বলে অভিহিত করা শুরু না করলে এর প্রতি আমাদের আবেগ আর মনোযোগ এতটা গভীর হতো না।

আমার আফসোস হয়, প্রতিটা প্রকল্পকে আমরা কেন সারাক্ষণ আমাদের দৃষ্টির নিচে রাখি না। শতাংশের হিসাবে ফেলে মাপার প্রয়োজন নেই, সময়মতো শেষ হচ্ছে কি না, শেষ হওয়ার পর প্রত্যাশিত উপকার বা লাভ আসছে কি না, এসব যদি সব সময় মানুষের আলোচনায় থাকে, তবে অপচয়ের এবং নয়ছয়ের সুযোগটা কমে যাবে। আমি বলছি না প্রতিটি প্রকল্প সারা দেশের মানুষ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। সেটি সম্ভব নয়। কিন্তু যদি যে অঞ্চলে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, সে অঞ্চলের মানুষ এর ব্যাপারে শুরু থেকে সক্রিয় থাকে, তাহলে কোনো ত্রুটি নিয়ে এর যাত্রা শুরু হবে না, খরচের ঘরে ফাঁকির সুযোগ থাকবে না। তাহলে প্রশংসার পাল্লাটা ভারী হবে, সমালোচনার ঘরটা ফাঁকা হবে।

আরও পড়ুন

২.

আজ পদ্মা সেতুর উদ্বোধন। কাল থেকে এই সেতু অল্প অল্প করে আমাদের মনোযোগ থেকে, আলোচনা থেকে দূরে যেতে শুরু করবে। বছর দুয়েক পর দেখা যাবে সেতুর কোথাও বাতি না জ্বললে, অথবা কোনো বিশেষ উপলক্ষে সেতুতে কোনো আলোকসজ্জা হলে এটি সংবাদে আসবে। কিন্তু এই সেতু, যার আয়ু ধরা হয়েছে ১০০ বছর, সব সময়ই আমাদের অর্থনীতির জন্য প্রাসঙ্গিক থাকবে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এই সেতু প্রতিবছর দক্ষিণের অর্থনীতিতে জিডিপির ২ শতাংশ এবং দেশের অর্থনীতিতে ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটাবে। কিন্তু অর্থনীতির হিসাবের বাইরে আরও অনেক হিসাব আছে, যেগুলো ঠিক টাকার অঙ্কে পরিমাপ করা যায় না। ঈদযাত্রায়, বিশেষ করে ঝড়-তুফানের মৌসুমে, কত লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটেছে এই পদ্মায়, কত পরিবারের হাসি-আনন্দ শেষ করে দিয়েছে এসব দুর্ঘটনা। আজ থেকে পদ্মা সেতু প্রতিবছর অনেক মানুষকে এই বিষণ্ন পরিসংখ্যান হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দেবে।

তিন ঘণ্টা ফেরির অপেক্ষায় থেকে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যাওয়া এক নিকটাত্মীয়ের স্বজন বলেছেন, সেতু থাকলে ওই ছেলেটি বেঁচে যেত। মিডিয়াকে এক তরুণ জানাচ্ছেন, তিনি আর অল্প বেতনের চাকরি করে কষ্ট পেতে চান না। তিনি গরুর খামার দেবেন। তঁার খামারের জন্য ঋণ পেয়েও গেছেন। এই তরুণের স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার গল্পটা শুধু টাকায় গুনলে চলবে না।

কাগজে দেখলাম, পদ্মা সেতু নিয়ে পশ্চিমবঙ্গেও বেশ উৎসাহ। অনেক আগে দেশছাড়া এক পূর্ববঙ্গীয় জানাচ্ছেন, একবার হলেও তিনি পদ্মা সেতুতে উঠতে চান। সেতু থেকে প্রমত্ত এই নদী দেখতে কেমন লাগে, সেই অভিজ্ঞতাটা সঞ্চয়ের জন্য।

আরও পড়ুন

৩.

পদ্মা সেতু নির্মাণ যে কত কঠিন একটি কাজ ছিল, কতটা ঝুঁকির, তা বলতে পারবেন এর সঙ্গে জড়িত প্রকৌশলী এবং বিশেষজ্ঞরা। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন তেমনি একজন বিশেষজ্ঞ। সেতু নির্মাণের কঠিন এক সময়ে একটি কাজে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তখন সেতুটির নির্মাণে সমস্যাগুলো নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘এই সেতুটি যেকোনো প্রকৌশলীর জন্য একটা দুঃস্বপ্ন, একটি অগ্নিপরীক্ষা।’ কিন্তু আশাবাদী কণ্ঠে তিনি জানিয়েছিলেন, এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। কারণ, এর সঙ্গে পুরো জাতির আত্মসম্মান জড়িত। উত্তীর্ণ শুধু আমরা হইনি, এখন এই প্রত্যয়ও আমাদের জন্মেছে, পদ্মা সেতু থেকেও বড় প্রকল্প নিয়ে এখন আমরা ভাবতে পারি। পদ্মা সেতুকে আমরা আমাদের ইচ্ছাশক্তির একটা জয় হিসেবেই দেখব।

আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকোর আইকনিক গোল্ডেন ব্রিজ সম্পর্কে সে দেশের এক ইতিহাসবিদ ও মিশেল ফুকো-পণ্ডিত সিমিয়ন ওয়েড বলেছেন, ‘এই সেতুর প্রতীকী অর্থটি আমাদের বুঝতে হবে। কারণ, সেতুটি কাউকে শুধু আমেরিকা থেকে আমেরিকায় নিয়ে যায় না, বরং এটি আমেরিকা থেকে অনেক দূরে তাকে নিয়ে যায়।’ পদ্মা সেতুও বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে আমাদের নিয়ে যাবে, যে দূরত্ব ভূগোলের নয়, বরং সম্ভাবনার, সক্ষমতার এবং স্বপ্নের।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ