স্থানীয় সরকার নির্বাচন যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অন্তর্দলীয় ক্ষমতার লড়াইয়ের রক্তক্ষয়ী রূপ নিয়েছে, তার সবচেয়ে বড় নজির ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন। তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদের কথায়, বিদ্রোহীদের বিজয়ও আওয়ামী লীগের জয়। এক দশকের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিকে মামলা ও হামলার দাপটে মাঠছাড়া করে ফেলার পর এমনটিই যে ঘটবে, তা যে দলটির নেতারা বুঝতে পারেননি, তা নয়। তাঁরা জেনেশুনেই দলকে আরও শক্তিশালী করার মানসে অন্যান্য দল থেকে বিপুলসংখ্যায় নেতা-কর্মীকে ভাগিয়ে এনেছেন। নবাগতদের দাপটে যখনই কোনো সমস্যা হয়, তখনই তাই তাঁরা বলেন, দলে অনুপ্রবেশকারীরাই এগুলোর জন্য দায়ী। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলটির অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এক নতুন মাত্রা পেয়েছে।
বাংলাদেশের অন্য জেলাগুলোয় দাপুটে এমপিরা যে ধরনের এমপিরাজ প্রতিষ্ঠা করেছেন, নারায়ণগঞ্জ বহুদিন ধরেই তার অগ্রভাগে। অজস্র বিতর্কের জন্ম দিলেও সেখানকার স্থানীয় সাংসদকে কেউ কিছু বলেন না। তাঁর দাপটকে একমাত্র চ্যালেঞ্জ করতে পেরেছিলেন মেয়র নির্বাচনে এককালের বিদ্রোহী প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী। তথ্যমন্ত্রীর ফর্মুলামতে, বিদ্রোহীরাও যে আওয়ামী লীগ, তা প্রমাণিত হয়েছে আইভীর গত নির্বাচনে যখন তিনি দলীয় মনোনয়ন আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এবারও তাঁর আর কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু দলের মনোনয়ন পেতে সমস্যা না হলেও দলের স্থানীয় এমপির সমর্থন তাঁর জন্য সমস্যা হয়েই ছিল। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। স্থানীয় এমপির সমর্থন পেলেও সমস্যা, না পেলেও সমস্যা। তিনি যাঁকে এক যুগের বেশি সময় ধরে নারায়ণগঞ্জের সব অন্যায়-অপরাধের জন্য দায়ী করে এসেছেন, তাঁর সমর্থন নেওয়ার মানে হচ্ছে অন্যায়ের সঙ্গে আপসরফা। আবার এই আপস ছাড়া দলীয় ভোটের সবটা পাওয়া তাঁর জন্য অনিশ্চিত।
নীরবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের চাপে সমস্যাটির সমাধান যে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল, তা বোঝা গেল আইভী যখন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী তৈমুর আলম খন্দকারকে কথিত গডফাদারের প্রার্থী হিসেবে অভিহিত করলেন। অভিযোগটা না করলে স্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমান কারও পক্ষে মুখ খুলতেন কি না, সে প্রশ্ন নাকচ করে দেওয়া যায় না। তাঁর অভিযোগের পরই শামীম ওসমান ও তাঁর অনুসারীদের ওপর দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের চাপের বিষয়টিতে আর কোনো রাখঢাক থাকেনি। দলীয় প্রার্থী আইভীর পক্ষে ওসমান পরিবারের সমর্থন আদায়ের জন্য তাই কেন্দ্রের প্রতিনিধি খোলামেলাই বলে দিয়েছেন, ‘এমপি হয়েছেন নেত্রীর দয়ায়’। এমপির অনুসারী ছাত্রলীগের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে এবং সেই কমিটির নেতাদের বাসায় পুলিশও হাজিরা দিয়েছে।
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনে নেই। কিন্তু তৈমুর আলম খন্দকার বিএনপির সাবেক নেতা। বিএনপি তাঁকে দলীয় পদ থেকে অপসারণ করলেও বহিষ্কার করেনি। বিএনপির অবস্থানটি কৌশলী, কিন্তু সুবিধাবাদী। নির্বাচনী লড়াইয়ে সাফল্য পেলে ধরে নেওয়া যায় দলটি তাঁকে তাঁর মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়ে দলে স্বাগত জানিয়ে আওয়ামী লীগের মতোই বলবে, উনি তো বিদ্রোহী হলেও বিএনপি।
দয়া হারানোর ঝুঁকির মুখে তাই সাংসদ শামীম ওসমান তাঁর ‘জীবনের সবচেয়ে কষ্টের সংবাদ সম্মেলনে’, ‘অনেক চাপা কষ্ট নিয়ে’ আমাদের জানালেন, ‘যেভাবে নামা উচিত, সেভাবে নামতে পারিনি। আজ থেকে নামলাম।’ তাঁর বক্তব্যের আরেকটি ইঙ্গিতপূর্ণ অংশ হচ্ছে, ‘এখানে কে প্রার্থী, হু কেয়ারস। কলাগাছ, না আমগাছ—সেটা দেখার বিষয় না। এটা বঙ্গবন্ধুর নৌকা, শেখ হাসিনার নৌকা, এর বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।’ এসব বক্তব্যে স্পষ্টতই স্বীকারোক্তি মেলে, তিনি নিরুপায় হয়েই দলীয় প্রার্থীর পক্ষে সমর্থন ঘোষণা করেছেন।
আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমস্যাটি অবশ্য এখানেই। আইভীকে মানুষ এত দিন সরকারের লোক মনে করেনি। বরং এমপিরাজের বিরুদ্ধে সাহসের প্রতীক বিবেচনা করেছে। সেই ভাবমূর্তির এখন ইতি ঘটেছে। অথচ তিনি দূরত্বটা বজায় রাখতে চান। সম্ভবত সেই কারণেই তিনি বলেছেন, ‘বিধি মোতাবেক তিনি (শামীম ওসমান) নির্বাচনী প্রচারণায় নামতে পারবেন না।’ সাংসদ হিসেবে শামীম ওসমান নিজে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে না পারলেও তাঁর সহযোগীদের উপস্থিতিও তাঁর জন্য বিড়ম্বনার কারণ হতে পারে। যে কৌশলগুলো এত দিন বিরোধীদের হেনস্তা করায় ব্যবহৃত হয়েছে, সেই একই হাতিয়ার এখন বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে শুরু করেছে। ফাঁস হওয়া দুটি টেলিসংলাপ—একটি চাঁদাবাজির এবং অন্যটি খুনের দায়ে ফাঁসির আসামি নূর হোসেনের জেলের ভেতর থেকে তাঁর ভাইয়ের নির্বাচনের জন্য ভীতি প্রদর্শনের খবর—নির্বাচনের ওপর কিছুটা প্রভাব ফেলেছে। নূর হোসেনের ভাই ক্ষমতাসীন দলেরই একজন কাউন্সিলর প্রার্থী।
নগরটিতে নাগরিক সেবা কতটা ভালো হয়েছে অথবা হয়নি, ভবিষ্যতে কে কী করবেন, তার জন্য কর বাড়বে, নাকি কমবে, সেসব বিষয়ে কোনো জোরালো বিতর্ক নেই। ওসমান পরিবার এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল রাজনৈতিক-সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর গতিবিধিতেই যেন সবার আগ্রহ, তাদের ঘিরেই সব আলোচনা।
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনে নেই। কিন্তু তৈমুর আলম খন্দকার বিএনপির সাবেক নেতা। বিএনপি তাঁকে দলীয় পদ থেকে অপসারণ করলেও বহিষ্কার করেনি। বিএনপির অবস্থানটি কৌশলী, কিন্তু সুবিধাবাদী। নির্বাচনী লড়াইয়ে সাফল্য পেলে ধরে নেওয়া যায় দলটি তাঁকে তাঁর মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়ে দলে স্বাগত জানিয়ে আওয়ামী লীগের মতোই বলবে, উনি তো বিদ্রোহী হলেও বিএনপি। বিএনপি দলীয়ভাবে এই নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় তৈমুর আলম কিছুটা বাড়তি সুবিধা পেতে পারেন এবং সেই লক্ষ্যে তাঁর সর্বাত্মক চেষ্টা লক্ষণীয়। তিনি নিজেকে এখন বিদায়ী মেয়রের বিপরীতে সর্বদলীয় প্রার্থী হিসেবে জাহির করছেন। তৈমুর আলম একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন আশা করলেও নির্বাচন কমিশনের রেকর্ড এবং আলামত থেকে মনে হয় না যে ব্যতিক্রমী কিছু হবে। ঘুঘুর ফাঁদ দেখা শুরু হয়েছে বলে তিনি যে মন্তব্য করেছেন, তার আলোকে তাঁর কর্মী-সমর্থকদের গ্রেপ্তার, গায়েবি মামলা এবং ভোটের দিনে সম্ভাব্য হাঙ্গামা ঠেকাতে কমিশন ও প্রশাসন কতটা উদ্যোগী হবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনের খবরাখবর এবং বিশ্লেষণগুলো দেখে বোঝা যায় যে গণমাধ্যমও এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের রাজনীতির কিছুটা প্রভাব যে রাজধানীতে পড়বে, সেটাই স্বাভাবিক। তার প্রতিফলন গণমাধ্যমেও মোটামুটি বোঝা যেত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে দাঁড়ানোর জন্য আইভীর প্রতি একাংশের সহমর্মিতা লক্ষ করা যেত। সেই সহানুভূতি কি অক্ষুণ্ন থাকছে? আবার গণমাধ্যমের একটি অংশ মালিকদের ব্যবসায়িক স্বার্থের কারণে দীর্ঘদিন ধরেই স্থানীয় সাংসদের পক্ষ অবলম্বন করে আসছিল। তারাও কি এখন আইভীকে সমর্থন দেবে?
নারায়ণগঞ্জে ক্ষমতাসীন দলের অন্তর্দলীয় ক্ষমতার লড়াইয়ের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি হচ্ছে সিটি করপোরেশনের নাগরিকদের নাগরিক সুযোগ-সুবিধার ইস্যুগুলোর জায়গা নিয়েছে ওসমান পরিবার ও আইভীর সম্পর্কের হিসাব-নিকাশ। নগরটিতে নাগরিক সেবা কতটা ভালো হয়েছে অথবা হয়নি, ভবিষ্যতে কে কী করবেন, তার জন্য কর বাড়বে, নাকি কমবে, সেসব বিষয়ে কোনো জোরালো বিতর্ক নেই। ওসমান পরিবার এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল রাজনৈতিক-সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর গতিবিধিতেই যেন সবার আগ্রহ, তাদের ঘিরেই সব আলোচনা।
ইউপি নির্বাচনগুলোতেও আমরা এই অন্তর্দলীয় কোন্দল, রেষারেষি ও সংঘাত প্রত্যক্ষ করেছি। সাংসদেরা নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টায় হেন কাজ নেই, যা করেননি। দলের মনোনয়ন নয়, তাঁদের কথাই তাঁদের নির্বাচনী এলাকায় শেষ কথা। সেই লড়াই বন্ধে নির্বাচন কমিশন ছিল কার্যত দর্শকের ভূমিকায়। প্রথম আলোর হিসাবে ইউপি নির্বাচনের সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন ৯৩ জন। অন্যান্য হিসাবে এই সংখ্যা শতাধিক। অতীতের পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিলে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রাণঘাতী নির্বাচন হলো এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। এর আগেরটি, অর্থাৎ ২০১৬ সালের নির্বাচন ছিল রেকর্ড, যাতে নিহত মানুষের সংখ্যা ছিল ১৪৫। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বহীনতা, অযোগ্যতা ও ব্যর্থতা নিয়ে এর আগে অনেকবারই বলেছি বিধায় তার পুনরুল্লেখ করছি না। উন্নয়নের রূপকল্প বাস্তবায়নে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দোহাই দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর দমননীতি প্রয়োগে দেশকে বিরাজনীতিকরণের পথে ঠেলে দেওয়ার পরিণতি হচ্ছে অন্তর্দলীয় সংঘাত। নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন যেমনই হোক, তার ফল যা-ই হোক, ক্ষমতাসীন দল কোনোভাবেই এই সংঘাতের দায় এড়াতে পারে না।
কামাল আহমেদ সাংবাদিক