ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের পর স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের জনগণের সংগ্রাম একটা দীর্ঘ পথ পেরিয়েছে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শান্তি অন্বেষণ এবং নিপীড়িত জাতিসত্তার অধিকার আদায়ের আন্দোলনকর্মী হিসেবে আমি ১০ বছর ধরে কাজ করছি। উগ্র জাতীয়তাবাদ, রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং সামরিক বাহিনীর দমনমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আমরা এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে ঐক্যবদ্ধ। আমার নিজস্ব মত হচ্ছে সামরিক অভ্যুত্থানের এই আট মাসে মিয়ানমারে ফ্যাসিবাদবিরোধী বিপ্লবের ধরন পাল্টে গেছে।
সাত দশকের বেশি সময় ধরে মিয়ানমারে বিভিন্ন জাতিসত্তার সশস্ত্র সংগঠন এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে সংঘাত চলছে। অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন এনএলডির শাসনামলে জাতিসত্তাগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবাধিকার হরণ নিয়ে আমি অনেকবার কথা বলেছি। সামরিক অভ্যুত্থানের পর কোন পক্ষে অবস্থান নেব, তা নিয়ে আমি দোদুল্যমান ছিলাম। যদিও সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণে আমি ভীষণ বিরক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু সংখ্যালঘু জাতিসত্তা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও আন্দোলনকর্মীদের ওপর এনএলডির যে আচরণ, সেটাকে আমি উপেক্ষা করতে পারছিলাম না। কিন্তু শিগগিরই আমার কাছে মনে হলো, জনগণের ইচ্ছা যারা জোর করে দমন করে, তাদের প্রতিরোধ করা উচিত।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি ইয়াঙ্গুনে অভ্যুত্থানবিরোধী সংগ্রাম শুরু হয়। তাতে আমি যোগ দিই। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমার নামে হুলিয়া জারি হয়। আমার বাড়ি ও কার্যালয়ে অভিযান চালানো হয়। জীবন বিপন্ন হওয়ায় স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে গ্রামে পালিয়ে আসি। মিয়ানমারের জাতিগোষ্ঠীগুলোর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে আমি সংগ্রাম করেছি। এতে আমার ভেতরে বিশ্বাসের জন্ম হয়েছিল, আমি আমাদের দেশের সংখ্যালঘুদের পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে বেশ ভালোই জানি। কিন্তু গত কয়েক মাস গ্রামে থাকায় আমি সাধারণ মানুষের জীবনের গল্পগুলো খুব কাছ থেকে দেখতে পেয়েছি। তাদের বাস্তবতা ও রোজকার জীবনসংগ্রাম দেখে আমার উপলব্ধি হয়েছে, মিয়ানমারের জাতিগত সংকট নিয়ে আমার জানাটা ছিল ভাসা-ভাসা।
সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্মি-অধ্যুষিত শহরাঞ্চলে এত দিনকার আন্দোলনের মূল বিষয় ছিল সু চির মুক্তি ও নির্বাচিতদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি। কিন্তু শহরাঞ্চলে সামরিক বাহিনী সন্ত্রাস শুরুর ফলে এখন সেখানকার মানুষের চোখ খুলে গেছে। বহু বছর ধরে সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোর ওপর যে নিপীড়ন চলে আসছে, সে সম্পর্কে তারা এখন সচেতন।
গৃহযুদ্ধকবলিত যে এলাকায় আমি থাকছি, সেখানে শিশুদের স্কুলে যেতে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত হাঁটতে হয়। কেউ অসুস্থ হলে কাছের হাসপাতালে যেতে কয়েক দিন লেগে যায়। জাতিগত সংখ্যালঘুদের এই জীবনযুদ্ধ সরাসরি দেখতে পারা আর তাদের সম্পর্কে সচেতন থাকা, এই দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান বিস্তর। অভ্যুত্থান শুরুর পর সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সংঘাতে ২ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আমি শরণার্থীশিবিরগুলোতে দেখেছি মানুষ তাদের মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে পারছে না।
মিয়ানমারের জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য এগুলোর কোনোটাই নতুন নয়। প্রকৃতপক্ষে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দশকের পর দশক তাদের ওপর ভয়াবহ পীড়ন চালিয়ে আসছে। তারা গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছে, লুটতরাজ করেছে। লোকজনকে আইনবহির্ভূত আটক ও মেয়েদের ওপর যৌন সহিংসতা চালিয়েছে। আমার আশ্রয়দাতা আমাকে বলেছেন, তাঁরা ভালো কোনো বাড়ি নির্মাণ করেন না। কেননা, যেকোনো সময় ঘরবাড়ি ছেড়ে তাঁদের পালিয়ে যেতে হয়।
সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্মি-অধ্যুষিত শহরাঞ্চলে এত দিনকার আন্দোলনের মূল বিষয় ছিল সু চির মুক্তি ও নির্বাচিতদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি। কিন্তু শহরাঞ্চলে সামরিক বাহিনী সন্ত্রাস শুরুর ফলে এখন সেখানকার মানুষের চোখ খুলে গেছে। বহু বছর ধরে সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোর ওপর যে নিপীড়ন চলে আসছে, সে সম্পর্কে তারা এখন সচেতন। বর্মি জাতিগোষ্ঠীর বাইরে রোহিঙ্গাসহ অন্যদের ওপর সামরিক বাহিনীর যে দমন-পীড়ন, এত দিন তারা তা উপেক্ষা করে এসেছে। এখন তারা এসব দমন-পীড়নের বিচার দাবি করছে। জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো এখন ভিন্নমতাবলম্বী ও আন্দোলনকারীদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। ফলে শহুরে তরুণেরা তাদের রাজনৈতিক সংগ্রাম সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছে। মার্চ মাসের শেষ দিকে সশস্ত্র সংগ্রামরত জাতিগত গোষ্ঠীগুলো সেনাবাহিনীর রচিত সংবিধান ছুড়ে ফেলে যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান প্রণয়নের দাবি জানিয়েছে।
গত ৫ মে জাতীয় ঐকমত্যের (এনইউজি) সরকার গঠিত হয়েছে। জান্তা সরকারের বিকল্প এই সরকারে নির্বাচিত আইনজীবী, আন্দোলনকর্মী এবং নির্বাসিত নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা রয়েছেন। সশস্ত্র প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে একটা কেন্দ্রের অধীনে আনার উদ্দেশ্যে তারা গণপ্রতিরক্ষা বাহিনী প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে। ৭ সেপ্টেম্বর এনইউজি দেশজুড়ে ‘গণপ্রতিরক্ষা যুদ্ধ’ ঘোষণা করে। ‘একটি শান্তিপূর্ণ দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার গঠনের প্রয়োজনীয় বিপ্লবে’ সবাইকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।
আমরা এখন বৈপ্লবিক অভিযাত্রার একেবারে সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। এনইউজিকে অবশ্যই মিয়ানমারের জাতিগত বৈচিত্র্যকে ধারণ করতে হবে। সংখ্যাগুরু বর্মিদের বাইরে সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলো থেকে নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে। রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য জাতিসত্তার ওপর যে অমানবিক দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে, সে জন্য জাতীয়ভাবে ক্ষমা চাওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। স্বাধীনতা, ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে সব জাতিসত্তাকে নিয়ে একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক মঞ্চ গড়ে তুলতে হবে
ইংরেজি থেকে অনূদিত, আল-জাজিরা থেকে নেওয়া
● থেট সুয়ে উইন মিয়ানমারের মানবাধিকারকর্মী