বাংলাদেশে চিত্রকলা আন্দোলনে নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল হয়ে আছেন শিল্পী নিতুন কুন্ডু। ২০০৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তিনি লোকান্তরিত হন। তাঁর প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি। নিতুন কুন্ডুর সৃষ্টি এ দেশের মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছে। তিনি জ্যামিতিক আকৃতিতে ফুটিয়ে তুলেছিলেন এ দেশের অপার সৌন্দর্য। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে বিষয় করে অজস্র চিত্রকল্প রচনা করেছিলেন, যা মুক্তিকামী মানুষকে আন্দোলিত করত।
শিল্পী নিতুন কুন্ডু বাংলাদেশের সংস্কৃতির অন্তর্ভুবনকে নানা ধরনের কর্মপ্রবাহ, উদ্ভাবনী শক্তি, সৃজন-তৎপরতা দিয়ে সমৃদ্ধ ও উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধিই করেননি, তিনি শিল্পের সব শাখায় বিচরণ করেছিলেন। নিতুন কুন্ডুর চিত্রকল্প এ দেশের মানুষের কাছে তাঁকে অগ্রগণ্য শিল্পী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তিনি জ্যামিতিক আকৃতির ভেতর দিয়ে সৌন্দর্যকে সন্ধান করেছেন। এ অন্বেষণে তিনি সফল একজন মানুষ। তাঁর শিল্পকর্মে আবিষ্কার করেছেন বিষয়ের পরিবর্তনশীল আর্তি, গতি ও রূপান্তর। এই অনুষঙ্গই তাঁকে ফর্ম ভাঙার খেলায় প্রণোদনা জুগিয়েছে। জ্যামিতি ও ফর্ম তাঁর ছবিকে বিশিষ্ট করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাঁর চিত্রভাষা। ভাস্কর্য, ফোয়ারা, মঞ্চ ও তোরণ নির্মাণেও নিতুন কুন্ডু অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। শিল্পে নতুন মাত্রা সঞ্চার করেছিলেন তিনি।
বাঙালির জীবনসংগ্রাম ও প্রকৃতির অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যেও ব্যঞ্জনা রূপায়ণের মধ্য দিয়ে নিতুন কুন্ডু নিজস্ব শৈলী ও চিত্রভাষা নির্মাণেও সমর্থ হন। বাঙালির প্রবহমান ঐতিহ্য ও ছন্দের সঙ্গে আধুনিক শৈলীর সম্মিলনে সৃষ্টির উদ্যানকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন। সমকালীন শিল্পীদের মধ্যে তাঁর এই শিল্পকুশলতা বিশিষ্ট বলে চিহ্নিত হয়েছে। ষাটের দশকে ও মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর সৃষ্টিকর্ম মানুষকে আলোড়িত করেছে। সৃজনীবৃত্তির একটি প্রবল নতুন মাত্রায় তিনি পদার্পণ করেছিলেন। তাই প্রাণের শক্তিতে তিনি মজবুত ও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন।
ষাট ও সত্তরের দশকে করা নিতুন কুন্ডুর চিত্রগুলোয় সৃজনী উৎকর্ষের স্বাক্ষর রয়েছে। তিনি ছিলেন আর্ট ইনস্টিটিউটের মেধাবী ও উজ্জ্বল ছাত্র। তাঁর ড্রয়িং ছিল শক্তিশালী। তেলরঙের কাজে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ষাটের দশকের শেষ পর্যায়ে ইউসিসে তিনি ‘ছাপাই’ ছবির যে প্রদর্শনী করেছিলেন নান্দনিক বৈভব ও চিত্রশৈলীতে, তা অভিনব বলে বিবেচিত হয়েছিল। তাই তো তিনি ১৯৬৫ সালে জাতীয় চিত্রকলা পুরস্কার ও ১৯৯৭ সালে সর্বোচ্চ জাতীয় বেসামরিক পুরস্কার ‘একুশে পদক’ লাভ করেন। চিত্রকলার পাশাপাশি শিল্পের অন্যান্য ক্ষেত্রেও সমান ভূমিকা পালনকারী শিল্পী নিতুন কুন্ডুর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পোস্টার ডিজাইন, ১৯৯২ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য ‘শাবাশ বাংলাদেশ’ এবং ১৯৯৩ সালে ঢাকায় নির্মিত ‘সার্ক ফোয়ারা’। মেধা ও মননে তিনি অটবিকে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি দীর্ঘ তিন দশক অটবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শিল্পসমালোচক মাহমুদ আল জামান তাঁর শিল্প সম্পর্কে বলেছেন, নিতুন কুন্ডু বিমূর্ততায় চিত্রসাধনা করেছেন। ষাটের দশকে এ ধারায় তিনি ছাপাই ছবি ও চিত্র রচনা করলেও পরবর্তী সময়ে স্বাধিকারের প্রমত্ত চেতনা তাঁর মানসে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছিল। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও বাঙালির স্বদেশচেতনা ও দেশভাবনা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল এক স্বপ্নময় রাষ্ট্র নির্মাণে। এ রাষ্ট্রের রুচি ও সাংস্কৃতিক প্রতিমা নিতুন কুন্ডু গড়তে চেয়েছেন। সে জন্য তাঁকে লড়াই করতে হয়েছে নিজের, পরিবেশের ও শিল্পের সঙ্গে। এ কাজ করতে গিয়ে সাময়িকভাবে তাঁর চিত্রচর্চায় ছেদ পড়েছিল সন্দেহ নেই।
৬০ ও ৭০ দশকে নিতুন কুন্ডু যে বিমূর্ত অভিব্যক্তি দ্বারা আলোড়িত ছিলেন, আশির দশকে এসে যখন চিত্রসাধনায় নিজেকে পরিপূর্ণভাবে সঁপে দিলেন, তখন তাঁর চিত্রে জ্যামিতি ও ফর্ম যেন আরও বলীয়ান হয়ে উঠল। এ জ্যামিতি তাঁর চিত্রে নবযাত্রা সংযোজিত করেছে। রেখার সম্মিলনে, রঙের নানাবিধ ব্যবহারে বিমূর্ত প্রকাশবাদী এই চিত্রগুচ্ছ বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলায় সূক্ষ্ম বোধে সংবেদনময় হয়ে উঠল। জ্যামিতিক আকৃতিগুলো শূন্য পরিসরে প্রধানত দ্বিমাত্রিক অবয়বে নতুন ইমেজ নিয়ে ধরা দিল। এই চিত্রগুলোয় বস্তুর অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যকে তিনি আশ্চর্য মমতায় উন্মোচিত করেছেন। এই উন্মোচনের মধ্যে আমরা মানবিক অনুভূতির তীব্রতা ও নিতুন কুন্ডুর সৌন্দর্যানুভূতিকে ব্যাপক পরিসরে প্রত্যক্ষ করেছি। তিনি জ্যামিতিক অবয়ব গঠন করেছেন রেখা ও রঙের বিন্যাসে। কখনো প্রকৃতির ছন্দময় রূপকেও তুলে ধরেছেন।
নিতুন কুন্ডু একাগ্রতা, লক্ষ্যভেদী দূরদৃষ্টি ও অনুপম সৃষ্টিশীলতা নিয়ে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন। শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করে তিনি বিশাল মহিরুহে পরিণত হয়েছিলেন। মূলত তিনি একজন প্রতিভাবান চিত্রশিল্পী ছিলেন। পাশাপাশি ভাস্কর্যে তাঁর ঈর্ষণীয় ক্ষমতাও প্রকাশ করেছেন। আজীবন জেদি, সংগ্রামী ও লড়াকু জীবন কাটিয়েছেন তিনি। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান ও মরমি শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদেরও প্রিয় ছাত্র ছিলেন তিনি।
শিল্পী নিতুন কুন্ডু ১৯৩৫ সালে দিনাজপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভকারী এ শিল্পীর জীবদ্দশায় চারটি একক প্রদর্শনী হয়েছে। এ ছাড়া তাঁর চিত্রকলা বহু দলবদ্ধ প্রদর্শনীতে স্থান পায়। সর্বোপরি নিতুন কুন্ডু জীবনসংগ্রামে বিজয়ী বীর। তাঁর সৃষ্টিকর্ম জাতি অনন্তকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
আবুল কালাম আজাদ শিল্পসমালোচক