‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’—কবির এই কথাগুলোর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার মতো মানুষ খুব একটা পাওয়া যাবে না। দুনিয়ার তাবৎ জনপ্রিয়, পাঠকপ্রিয় ও দর্শকনন্দিত বেশির ভাগ উপাখ্যান, সাহিত্য ও সিনেমার উপজীব্য বিষয় নারীর প্রতি ভালোবাসা। আপাতদৃষ্টে পুরুষের ভালোবাসা এবং স্নেহ মূলত নারীকে কেন্দ্র করেই। প্রেয়সী ও জননীর প্রতি পুরুষের ভালোবাসা সর্বজনীন। যৌবনের তুঙ্গে, চিরাচরিত দৃশ্যপটে, পুরুষের কাছে নারীর ভালোবাসাই সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত।
কিন্তু নারীকে যখন একজন মানবী হিসেবে আমরা দেখি, তার অবস্থা অনেকটাই বিবর্ণ, যা জায়া ও জননীর পর্যায়ে নয়, যদিও নারী সব সময়ই জায়া ও জননীর ভূমিকা পালন করেন। মানুষ হিসেবে নারীর যে সাধারণ মৌলিক অধিকার, তা ভীষণভাবে উপেক্ষিত। দেশ-কাল, ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে ঐতিহাসিকভাবে নারীরা আইনি ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার। আইনি কিছু সুযোগ রয়েছে, তবে তা-ও ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সুরক্ষা পাওয়ার উপায় মাত্র। পারিবারিক আইন থেকে শুরু করে উত্তরাধিকার আইন—সব ক্ষেত্রেই নারীরা সমান অধিকার পেয়েছেন, সেটা আমরা হলফ করে দাবি করতে পারি না।
জাতিসংঘ মহিলা পরিষদের তথ্যানুযায়ী এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ১৫-১৯ বছর বয়সী প্রতি ৫ জন কিশোরীর মধ্যে একজন যৌন সহিংসতার শিকার হয়; শতকরা ৮০ ভাগের বেশি বিবাহিত নারী অন্তত একবার সহিংসতার শিকার হন; শতকরা ৭৬ ভাগ নারী উচ্চশিক্ষাকালীন যৌন হয়রানির শিকার হন এবং শতকরা মাত্র ২.৬ জন নারী শারীরিক ও মানসিক হয়রানির প্রতিকারে আইনি সহায়তা চান। একশনএইড ও জাতীয় নারী নির্যাতন ফোরামের সাম্প্রতিক তথ্যমতে বাংলাদেশে ৬৬ শতাংশ নারী গৃহ সহিংসতার স্বীকার, যাঁদের ৭২ শতাংশ সহিংসতার বিষয়ে কখনো মুখ খোলেননি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্যানুযায়ী ২০২০ সালে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৫৫৪ জন নারী। তাঁদের মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা যান ৩৬৭ জন এবং আত্মহত্যা করেন ৯০ জন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন ২০১ জন নারী। সারা দেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ১ হাজার ৬২৭ নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৫৩ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন।
মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি প্রজনন অধিকারের বিষয়টিও উপেক্ষিত। বিয়ে, জন্মনিয়ন্ত্রণ, সন্তানসংখ্যা নির্ধারণে নারীর অধিকার সুরক্ষিত নয়। ‘আমার শরীর আমার আধিকার’—এটি শুধুই একটি স্লোগান। ১৯৯০ সালে কায়রোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সম্মেলনকে অনেকেই প্রজনন অধিকার ও নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকল্পে মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করেন।
নারী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এই সম্মেলনে যুগান্তকারী ঘোষণা দেওয়া হয়—বিয়ে, জন্মনিয়ন্ত্রণ ও সন্তান ধারণের সিদ্ধান্ত নারীর অধিকার। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশসহ ১৩৯টি দেশের প্রতিনিধিরা এ বিষয়ে সহমত পোষণ করেন এবং নিজ নিজ দেশে এই অধিকার বাস্তবায়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের অঙ্গীকার করেন।
কায়রো সম্মেলনের ৩০ বছর পরও আমরা দেখি আমাদের দেশে দুই-তৃতীয়াংশ অপ্রাপ্ত বয়সী কিশোরীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে নিজের অনিচ্ছায়। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কিশোরী সন্তানের জননী হচ্ছে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই। আবার দেশের মোট গর্ভধারণের প্রায় শতকরা ৪০ ভাগই অনিচ্ছাকৃত। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারে পুরুষের অংশগ্রহণ মাত্র ১৬ শতাংশ, পক্ষান্তরে নারীদের অংশগ্রহণ ৮৪ শতাংশ, যদিও পরিবারকল্যাণের দায়িত্ব স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েরই সমান।
অনেক নারী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত শারীরিক অসুবিধা সত্ত্বেও অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ এড়ানোর জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন স্বামীর জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে অনিচ্ছার কারণে। আবার অনেক নারী ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও স্বামীর অনুমতি না থাকায় জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন না।
ঐতিহাসিকভাবে আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারী ও পুরুষের ভূমিকা পূর্বনির্ধারিত। পুরুষেরা সংসারের আয় ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত এবং অপর দিকে নারীর ভূমিকা অন্দরমহলে। এভাবেই আমরা শত শত বছর যাবৎ মানসিকভাবে বেড়ে উঠেছি। বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় আমরা নারী নির্যাতনকেও পরিবারে এবং পরিবারের বাইরে অবলোকন করি কোনো রকম প্রতিবাদ-প্রতিরোধ না করেই।
গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব পরিবারের সদস্যরা বাল্যকাল থেকে নিজ পরিবারে নারী নির্যাতন প্রত্যক্ষ করেছে, তাদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে নির্যাতিত হওয়া এবং নির্যাতন করার প্রবণতা থাকে। সময় এসেছে ভাবার, আমরা এই ধারাবাহিকতার অবসান চাই কি না।
আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং আইনের শাসন নারীর প্রতি সহিংসতা কমানোর জন্য অপরিহার্য হলেও শুধু আইন দিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা নির্মূল করা যাবে না। আইনের পাশাপাশি আমাদের মনোযোগ দিতে হবে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে। এ ক্ষেত্রে পুরুষদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, পুরুষদের প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতীয়মান না করে নারী নির্যাতন রোধকল্পে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে হবে। নারীর অধিকার সুরক্ষার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বাল্যবিবাহ এবং যৌতুকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনে পুরুষদের নেতৃত্ব দিতে হবে সম্মুখ থেকে।
পরিবার এবং জাতি গঠনে নারীদের ভূমিকা সর্বজনস্বীকৃত। একজন শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ নারীই পারেন একটি পরিবার গঠনে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে। পারিবারিক কলহ, নির্যাতন ও সহিংসতা নারীদের মনোদৈহিক অবস্থায় স্থায়ী বিরূপ প্রভাব ফেলে, যার প্রভাব পড়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের ওপর, বিশেষ করে পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের ওপর। সুসংহত অধিকার না থাকায় নারীরা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে দুর্বল অবস্থানে থাকেন, যা তাঁদের হীনম্মন্য করে এবং তাঁদের মানসিক বিষণ্নতারও কারণ হয়।
আমরা কি বিষয়গুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করে আগামী প্রজন্মকে একটি নারীবান্ধব সমাজ উপহার দিতে পারি না? দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সব হীনম্মন্যতা, সংকীর্ণতা ও বৈষম্যকে পাশ কাটিয়ে নারীদের সামনে এগিয়ে আনতে হবে, এটাই হোক সব পুরুষের চাওয়া।
মো. মাহবুব উল আলম টেকনিক্যাল ডিরেক্টর, ইউএসএআইডি সুখী জীবন, পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ
আমেনা খান প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর, ইউএসএআইডি সুখী জীবন, পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ