নাইন–ইলেভেন ও আমেরিকায় ধর্মীয় বর্ণবাদের উত্থান

নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে ঈদুল ফিতরের নামাজে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের নামাজ আদায়ফাইল ছবি: রয়টার্স

টুইন টাওয়ার হামলার বার্ষিকীতে যুক্তরাষ্ট্রে কীভাবে নিরাপত্তার সঙ্গে ব্যক্তিস্বাধীনতার ভারসাম্য রক্ষা করা যেতে পারে, তা নিয়ে বিতর্ক ওঠে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নাগরিক স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করার ক্ষেত্রে বর্ণবাদ যে ভূমিকা পালন করে, সে বিষয়টি প্রায়ই সে আলাপ ও বিতর্কের তোড়ে হারিয়ে যায়। বর্তমানে লক্ষ্যবস্তু মুসলমানরা। এক শতাব্দী আগে ছিল ইহুদি ও ক্যাথলিকরা।

বর্ণবাদের এবং যে প্রক্রিয়ায় মানুষ এর শিকার হয়ে থাকে, তার চেহারা মোটামুটি একই রকম। এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে গণমাধ্যমে এবং সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অসাধু এবং রাষ্ট্রীয় আইনকানুন অমান্যকারী পঞ্চম কলাম হিসেবে অপমানজনক হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়। তারপরে (অ্যাংলো-স্যাক্সন প্রোটেস্ট্যান্ট) আমেরিকান জীবনযাত্রার জন্য তাঁদের ধর্মীয় বিধিবিধান অনুসরণকে হুমকি হিসেবে দেখানো হয়। সবশেষে ধর্মকে একটি বিপজ্জনক রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলে ধর্মীয় অনুশাসন পালন করা থেকে তাদের বিরত রাখা হয়।

দুই দশক ধরে মিডিয়া আমেরিকানদের মধ্যে মুসলমানদের সন্ত্রাসী হিসেবে ধারাবাহিকভাবে চিত্রায়িত করে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে লাখ লাখ মুসলমান চিকিৎসক, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, আইনজীবী এবং অন্যান্য পেশাজীবী কীভাবে দেশটির সামগ্রিক উন্নয়নের ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন, তা নিয়ে এসব সংবাদমাধ্যমে খুব কমই খবর হয়েছে। ২০১৮ সালে ইউনিভার্সিটি অব আলাবামা পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে সেখানে যে পরিমাণ খবর প্রচার করা হয়েছে, কোনো সন্ত্রাসী ঘটনায় মুসলমানরা জড়িত থাকলে সে তুলনায় ৩৫৭ গুণ বেশি খবর প্রচার করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজনের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে, তাদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত নজরদারি আরোপ করে এবং তাদের দেশ থেকে বের করে দিয়ে রাজনীতিকেরা মিডিয়াকে মুসলমানদের খল চরিত্র হিসেবে চিত্রায়িত করার বৈধতা দিয়েছেন। তৎকালীন বুশ প্রশাসনের ন্যাশনাল সিকিউরিটি এন্ট্রি-এক্সিট সিস্টেম (এনএসইইআরএস) শীর্ষক বিশেষ নিবন্ধন প্রক্রিয়া অথবা ওবামা প্রশাসনের কাউন্টারিং ভায়োলেন্ট এক্সট্রিমিজম শীর্ষক প্রকল্পের মধ্য দিয়ে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক উভয় শিবির থেকে আমেরিকানদের জন্য যে অভিন্ন বার্তা দেওয়া হয়েছে, তা হলো মুসলমানরা আমেরিকার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

এরপর ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিবাসনভীতি ও ইসলামভীতিকে প্ল্যাটফর্ম বানিয়ে তাঁর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা শুরু করলেন। ২০১৬ সালের মার্চে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘আমি মনে করি, ইসলাম আমাদের ঘৃণা করে। আমাদের প্রতি তাদের ভয়ানক ঘৃণা আছে। এ কারণে যারা যুক্তরাষ্ট্রের মানুষকে এবং অমুসলিমদের ঘৃণা করে তাদের বিষয়ে আমাদের খুব সতর্ক হতে হবে এবং তাদের আমরা আমাদের দেশে ঢুকতে দিতে পারি না।’ ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে ঢুকেই তিনি তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বসলেন।

যে সমাজ মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতার সুরক্ষাদানকে মৌলিক মূল্যবোধ হিসেবে মনে করে, সেই একই সমাজের মুসলমানবিরোধী অবস্থান একটি সাংঘর্ষিক বিষয়। ধর্মীয় পরিচয়ভিত্তিক সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রথম নয়। এর আগে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান, আদিবাসী আমেরিকান এবং অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘু এ ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়েছে। আমি আমার দ্য রেসিয়াল মুসলিম: হোয়েন রেইসিজম কোয়াশেস রিলিজিয়াস ফ্রিডম বইয়ে ব্যাখ্যা করেছি, শুধু শারীরিক গঠন ও গায়ের চামড়ার রং বর্ণবাদের ভিত্তি নয়। ধর্মীয় পরিচয়ও এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে।

যে সমাজ মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতার সুরক্ষাদানকে মৌলিক মূল্যবোধ হিসেবে মনে করে, সেই একই সমাজের মুসলমানবিরোধী অবস্থান একটি সাংঘর্ষিক বিষয়। ধর্মীয় পরিচয়ভিত্তিক সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রথম নয়। এর আগে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান, আদিবাসী আমেরিকান এবং অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘু এ ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়েছে।

একজন লোকের শরীরের গড়ন, তার গায়ের রং, চুলের রং, তার মুখের আকৃতি—এসব দেখে তার জাতীয়তার উৎস সম্পর্কে ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সে অনুযায়ী সে সমাজের কোন স্তরে কীভাবে কতটুকু মর্যাদা পাবে, তা সামাজিকভাবে নির্ধারিত হয়ে থাকে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টানদের একটি বড় অংশ ঐতিহাসিকভাবে এই জাতিগত পরিচয়ের বাইরে ধর্মীয় পরিচয়কে বর্ণবাদের ভিত্তি হিসেবে ধরে এসেছে। তারা প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টান নয়, এমন গোত্র বা অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি ঐতিহাসিকভাবে বর্ণবাদী আচরণ করে থাকে।

১৮৮০ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ এবং পূর্ব ইউরোপের লাখ লাখ অভিবাসী যখন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিল, তখন তারা স্পষ্টতই সেখানে বর্ণবাদী আচরণের শিকার হিসেবে নিজেদের দেখতে পেয়েছিল। এই লোকেরা ইউরোপিয়ান বংশোদ্ভূত ইহুদি ও ক্যাথলিক ছিল। আমেরিকার তৎকালীন আইন অনুযায়ী তারা সামাজিকভাবে ‘মধ্যম মানের’ নাগরিকের স্বীকৃতি পেয়েছিল। তাদের কৃষ্ণাঙ্গ, আদিবাসী আমেরিকান ও এশিয়ানদের চেয়ে উচ্চ স্তরের নাগরিক মনে করা হলেও তাদের উত্তরাঞ্চলীয় ইউরোপিয়ান প্রোটেস্ট্যান্টদের চেয়ে নিম্নস্তরের ভাবা হতো।

১৯২০ সালে শ্বেতাঙ্গ প্রোটেস্ট্যান্টদের সংগঠন কু ক্ল্যাক্স ক্ল্যান ক্যাথলিকদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা শুরু করে। তারা আমেরিকানদের বোঝাতে থাকে ক্যাথলিকরা বিদেশি বংশোদ্ভূত ধর্মগুরুদের ধর্মপাঠ এবং বিদেশি ভাষার কৃষ্টি–কালচার আমেরিকায় ছড়িয়ে দিচ্ছে, যা অ্যাংলো-প্রোটেস্ট্যান্টদের জাতীয়তার পরিচয়ের জন্য বিরাট হুমকি। শুধু ক্যাথলিকদের ধর্মপালন প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে এই সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়েছিল যে ক্যাথলিকরা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণাকে নস্যাৎ করার জন্য গোপনে চক্রান্ত করছে। শ্বেতাঙ্গ স্বদেশবাদীরা অভিযোগ তোলেন, রোমান ক্যাথলিক চার্চের যে শিক্ষা ক্যাথলিকরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রচার করছিলেন, তা উদারনৈতিকতাবাদের মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং দিন শেষে সেটি আমেরিকার গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। ঠিক সেই ষড়যন্ত্রতত্ত্বই নাইন–ইলেভেন হামলার পর ইসলামের শরিয়াহবিরোধী প্রচার–প্রোপাগান্ডায় ব্যবহার করা হয়েছে।

সে সময় যেভাবে ইহুদিবিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছিল, আজ ঠিক একইভাবে ইসলামভীতি ছড়ানো হচ্ছে। উনিশ শতকের গোড়ায় মূলধারার সংবাদমাধ্যমে ইহুদিদের ধোঁকাবাজ, বিচ্ছিন্নতাবাদী, পরজীবী, অসৎ, বলশেভিকদের চর—ইত্যাদি বলে উল্লেখ করা হতো। ১৯২০ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদির সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গেল (যাদের বেশির ভাগই পূর্ব ইউরোপ থেকে যাওয়া) তখন প্রোটেস্ট্যান্ট স্বদেশবাদীরা ইহুদিদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় বর্ণবাদী অপপ্রচার চালাতে শুরু করল। তারা বলতে লাগল, এই ইহুদিরা আদি ইহুদি নয়, এরা হলো তুর্কি বংশোদ্ভূত মোঙ্গল ও খাজার যারা পরে জুডাইজম গ্রহণ করেছে।

বিংশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়ায় ইহুদিদের চোখের রং, নাকের গঠন, মুখের আদল—ইত্যাদি নিয়ে নেতিবাচকভাবে মন্তব্য করা হতো। এই ধারাবাহিক প্রচারের ফলে ১৯৩৮ সাল নাগাদ আমেরিকানদের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মাল যে ইহুদিদের খারাপ কাজের কারণেই ইউরোপে তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছিল এবং সেই নির্যাতন তাদের পাওনা ছিল।

দুই দশক ধরে ধারাবাহিক প্রচারের ফলে ২০১৭ সাল পর্যন্ত অবস্থা যা দাঁড়ায় তা ভয়াবহ। পিউ রিসার্চের এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৫০ শতাংশ আমেরিকান মনে করে মুসলমানরা মূলধারার মার্কিন নাগরিক নন। ৪৮ শতাংশ আমেরিকান মুসলমানদের বিষয়ে উষ্ণ অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। দেখা যাচ্ছে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায়, বিশেষ করে নাইন–ইলেভেন হামলার পর আমেরিকায় মুসলমানদের কোণঠাসা করার চেষ্টা হয়েছে। ক্রিশ্চিয়ানিটিকে স্বাভাবিক হিসেবে ধরা হলেও ইসলামকে ভয়ংকর একটি মতাদর্শ হিসেবে তুলে ধরায় যুক্তরাষ্ট্রে গোটা মুসলিম সম্প্রদায় বেকায়দায় পড়েছে।

এ অবস্থায় ধর্মীয়ভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণে ও তাদের বর্ণবাদের শিকার বানানোয় যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের যে ক্ষতি হয়েছে, তা আমাদের নানা বিতর্ক ও আলাপে তুলে ধরতে হবে। সেটি করতে পারলেই আমেরিকান ইসলামভীতি দূর হবে।


আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

শাহার আজিজ নিউইয়র্কের রজার্স ল স্কুলের আইন বিষয়ের অধ্যাপক