কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে দারিদ্র্যসীমার ওপরের একটি বড় জনসংখ্যার আয় বিভিন্ন মাত্রায় কমেছে, অনেকে আয়ের সুযোগ সম্পূর্ণভাবে হারিয়েছে। ফলে উপান্তিক জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশের আয় বাংলাদেশে বর্তমানে নির্ধারিত দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। তারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এই পুরোনো উপান্তজনেরাই হচ্ছে নতুন প্রান্তজন, যাদের ‘নিউ পুওর’ বা ‘নতুন দরিদ্র’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে।
কোভিডের আগে বাংলাদেশে প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল বলে সাধারণভাবে অনুমান করা হয়। ‘নতুন দরিদ্র’–এর সংখ্যা কত বা মোট জনসংখ্যার তারা কত শতাংশ, তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন হিসাব ও মত রয়েছে। কিছু কিছু জরিপে কোভিড অতিমারির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার ফলে এটা ২৫-৪০ শতাংশ হয়েছিল বলে অনুমিত হয়েছে। জুন-পরবর্তী অর্থনীতি এখন কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে সত্য, কিন্তু তা সত্ত্বেও একটি বড় অংশের মানুষ, যারা আয়ের নিরিখে কোভিডের আগে দারিদ্র্যসীমার ওপরে ছিল, কিন্তু তৎপরবর্তী সময়ে নতুন দরিদ্র জনগোষ্ঠীতে যুক্ত হয়েছিল, তারা এখন পর্যন্ত সেখান থেকে বের হতে পারেনি। হালনাগাদ তথ্য-উপাত্তের অনুপস্থিতিতে এ জনসংখ্যার সঠিক মান নির্ধারণ বেশ জটিল, কিন্তু রক্ষণশীল হিসাবমতো, ১৫ শতাংশ ধরলেও এটা আড়াই কোটির মতো হবে। এই জনগোষ্ঠী যাতে দারিদ্র্যের ফাঁদে আটকে না পড়ে এবং দ্রুততম সময়ে পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে পারে, তার জন্য বিশেষ এবং ভিন্নতর উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুভূত হচ্ছে।
২০১৬ খানা জরিপ থেকে সচরাচর দারিদ্র্যসীমার ঠিক ওপরে অবস্থানকারী এ ১৫ শতাংশ নতুন দরিদ্রদের আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। এদের ৩৮ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ, ৩১ শতাংশ স্বকর্মসংস্থানে নিয়োজিত, ৩০ শতাংশ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত আর মাত্র ১ শতাংশ উদ্যোক্তা ও নিয়োগকর্তা। এঁদের মধ্যে আছেন কৃষি, শিল্প, যানবাহন ও নির্মাণশ্রমিক, নিয়মিত কাজ ও আয়ের সুযোগ থাকলে যাঁরা দারিদ্র্য সীমারেখার ওপরে অবস্থান করেন, আছেন বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত স্বল্প আয়ের চাকরিজীবী, ক্ষুদ্র ও খুচরা ব্যবসায়ী। আয়ের নিরিখে নিম্নমধ্যবিত্ত গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত মানুষের একটি অংশ এ নতুন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ জনগোষ্ঠীর সম্পদ ও বিত্ত নেই, সঞ্চয় থাকলেও তা স্বল্প। কিন্তু যখন কাজ থাকে, নিশ্চিত আয়ের সংস্থান থাকে, তখন তারা সে উপার্জন দিয়ে নিজেদের ও পরিবারের জন্য ন্যূনতম জীবন-জীবিকার সংস্থান করতে সক্ষম। এরা মূলত অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমবাজারের সঙ্গে যুক্ত। এ জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ ত্রাণ ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সচরাচর যাদের জন্য পরিচালিত, তাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। খানা জরিপ অনুসারে এ জনগোষ্ঠীর মাত্র ১০ শতাংশ যেকোনো একটি সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির উপকারভোগী। এ নতুন দরিদ্রদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শহর এলাকায় বাস করে, বাকি দুই-তৃতীয়াংশ গ্রামাঞ্চলে থাকে। কোভিডের কারণে এদের একটি অংশ শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে। এরা অনেকেই হয় আগের পেশায় কম আয় করছে অথবা পেশা পরিবর্তন করে অন্য কোনো পেশায় যেতে বাধ্য হয়েছে, যেখানে আয় পূর্বের তুলনায় কম। অনেকে আয়ের সুযোগ হারিয়ে বেকার, মূলত সঞ্চয়ের ওপর নির্ভর করে জীবন নির্বাহ করছে, যে সঞ্চয় শেষ হয়ে আসছে। অনেকে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে সাহায্য বা ধারকর্জ নিয়ে চলছে।
অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর সঙ্গে এ নতুন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যসীমার ওপরে ওঠার নিকট ও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। যারা কোভিডের ধাক্কায় দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গিয়েছিল, তাদের একটি অংশ অর্থনীতি সচল হতে শুরু করলে আগের অবস্থায় বা তার কাছাকাছি ফিরে গেছে। কিন্তু শিল্পকারখানা ও উৎপাদন খাত এখনো আগের মাত্রায় সচল হয়নি, সেবা খাতের একটি বড় অংশ এখনো স্থবির, নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলোতে (যেমন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সেবা প্রদান) ব্যাপক শ্রম নিয়োজনের সুযোগ নেই। তাই তাদের অনেকেই পতিত অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ ও সুযোগ খুঁজে পাচ্ছে না। সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উদ্যোক্তা সহায়তার মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুবাদে এদের একটি অংশকে আয়-সুযোগ সৃষ্টি ও অবস্থান উত্তরণে সহায়তা করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়।
প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে এদের একটি অংশ এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারবে যখন শিল্প কলকারখানা, ক্ষুদ্র-মাঝারি-কুটির শিল্প ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণের সহায়তায় আবার সচল হবে, কর্মী নিয়োগ করবে, বেতন ও মজুরি প্রদান করবে। কিন্তু এসব প্যাকেজের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষমতা সীমিত। সিপিডি পরিচালিত এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, এসব কর্মসূচির মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শ্রমবাজারের মাত্র ৮-১২ শতাংশের কাছেই কেবল পৌঁছানো সম্ভব। বিভিন্ন দেশে আয় হারানো এসব মানুষকে চিহ্নিত করে নগদ-সহায়তা (ক্যাশ-ট্রান্সফার) কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু সরকার যে আড়াই হাজার টাকা নগদ সহায়তা ৫০ লাখ পরিবারকে দেওয়ার কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল, সেসব কর্মসূচিতে এদের বড় অংশই অন্তর্ভুক্ত হয়নি। বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতিতে দারিদ্র্যসীমার নিচের প্রান্তিক মানুষদেরই সেখানে অগ্রাধিকার দিতে হয়েছে।
এ মানুষদের অনেকেরই হঠাৎ করে অন্য পেশায় যাওয়ার সক্ষমতা নেই, মনস্তাত্ত্বিক কারণে সরকারের ত্রাণ সাহায্যের জন্যও অনেকে হাত পাততে পারে না। কিন্তু সঞ্চয় যখন ফুরিয়ে যায়, আর যখন কোনো উপায় থাকে না, তখন তারা অন্য কাজ খোঁজে, স্বল্প আয়ের বিকল্প কাজে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে অথবা বেকারত্ব মেনে নিতে বাধ্য হয়। তারা সন্তানদের শিক্ষার ব্যয় নির্বাহ করতে পারে না, সন্তানেরা পরিবারকে সাহায্য করার জন্য লেখাপড়া ছেড়ে আয়–রোজগারের সন্ধানে নামে। তখন তারা ও তাদের পরিবার শুধু দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায় না, বরং সেখানেই আটকে পড়ার আশঙ্কায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
দারিদ্র্যের ফাঁদের ঝুঁকিতে থাকা এসব মানুষকে সাহায্য করার কৌশল সাধারণভাবে দারিদ্র্যসীমার নিচে যারা আছে, সেসব মানুষের থেকে ভিন্নতর হবে। চাহিদাভিত্তিক তালিকা করে এ নতুন দরিদ্রদের সহায়তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এটা হতে পারে নগদ-ট্রান্সফার, আপত্কালীন সহায়তা, স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা, যেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তারা চাকরিরত ছিল (যেমন বেসরকারি ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান), সেসব প্রতিষ্ঠানকে বেতন প্রদানে সহায়তা প্রদান এবং নির্মাণ কর্মকাণ্ডে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে। এ জনগোষ্ঠীর অনেকে এনজিও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, যাদের কর্মকাণ্ড এখন অনেকটাই বিপর্যস্ত ও স্থবির। সরকার এসব প্রতিষ্ঠানকে সহায়তার জন্য একটি ফান্ড করতে পারে, যা এ জনগোষ্ঠীর অনেকের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে। পিকেএসএফ এ ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, যা আরও সম্প্রসারণ করা যেতে পারে।
তবে মনে রাখতে হবে, তাদের টেকসইভাবে উঠে আসা মূলত নির্ভর করবে অর্থনীতির দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতার ওপর, যত দ্রুত স্বাস্থ্যঝুঁকি সামাল দিয়ে অর্থনীতি সচল হবে, ততই ধারাবাহিকভাবে তাদের উত্তরণ সম্ভব হবে। চাহিদা-সরবরাহ-আয়-ক্রয়ক্ষমতার ইতিবাচক চক্রের সুবাদে অর্থনীতিতে যে গুণক প্রভাবের সৃষ্টি হবে, তার ফলে এ জনগোষ্ঠীর অনেকেরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। সুতরাং বিষয়টির প্রতি জরুরি দৃষ্টি দিতে হবে। সবচেয়ে কার্যকর ও টেকসই উপায় হবে সামষ্টিক অর্থনীতির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করা, বাণিজ্য ও ব্যবসায়ে চাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনতে বিনিয়োগ এবং ব্যবসা পরিবেশকে আরও অনুকূল করা, বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী ব্যয় নিশ্চিত করা, তার মান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা। সরকারের বাড়তি ব্যয়ের কারণে রাজস্ব ঘাটতি যদি আরও বৃদ্ধি পায়, তাহলে সেটা মেনে নিয়ে সে পথেই যেতে হবে।
বাংলাদেশে আয় ও সম্পদের ক্ষেত্রে বৈষম্য যা কোভিড-পূর্ব অর্থনীতিতে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছিল, নতুন দরিদ্ররা দারিদ্র্যসীমার ওপরে টেকসইভাবে উত্তরণের সুযোগ না পেলে সে বৈষম্য আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ধরনের বাস্তবতায় অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের অভীষ্ট অর্জন সম্ভব হবে না। আগামী দিনের উন্নয়ন সম্ভাবনাও ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্যের কারণে বাধাগ্রস্ত হবে। আমরা যদি কোভিড-১৯ থেকে উত্তরণের পরিপ্রেক্ষিতে আগের চেয়েও ভালো অবস্থায় ফিরতে চাই, তাহলে উপান্তিক থেকে প্রান্তিক গোষ্ঠীতে পতিত এ নতুন দরিদ্রদের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টাকে সমর্থন দেওয়ার লক্ষ্যে সরকারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান, ঋণ কার্যক্রম গ্রহণ ও কর্ম সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
মোস্তাফিজুর রহমান: সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো