দেশপ্রেম নিয়ে সাতকাহন

দেশপ্রেম হচ্ছে একজন ব্যক্তি বা একটি জনগোষ্ঠী কর্তৃক মাতৃভূমির প্রতি একধরনের আবেগপূর্ণ অনুরাগ বা ভালোবাসা। আর দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ পরস্পর সম্পৃক্ত হওয়ায় এটাকে জাতীয় অনুভূতি কিংবা জাতীয় অহংকারও বলা যেতে পারে। মানুষের জাতিগত, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক অথবা ঐতিহাসিক পটভূমিকায় দেশভেদে দেশপ্রেমের ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিদৃষ্ট হলেও ব্যাপারটা আসলে এক ও অভিন্ন এবং দেশপ্রেমিক বলতে বোঝায় এমন সব ব্যক্তি, যাঁরা দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগে সর্বদা প্রস্তুত।
আরবি ভাষায় একটি প্রবচন আছে, ‘আল্ হব্বুল ওয়াতান মিনাল ইমান,’ অর্থাৎ ‘দেশপ্রেম হচ্ছে ইমানের অঙ্গ’। ইমান তথা বিশ্বাসই হচ্ছে ইসলাম ধর্মের মূলমন্ত্র ও পাঁচটি স্তম্ভের একটি। তাই প্রবচনটি অনুসারে, যাঁর অন্তরে দেশপ্রেম আছে, ধরে নিতে হবে যে তাঁর ইমানও আছে; পক্ষান্তরে যাঁর অন্তরে দেশপ্রেমের দীপশিখা প্রজ্বলিত নেই, তাকে মোমিন বলে অভিহিত করলেও ধরে নিতে হবে যে তাঁর ইমান পরিপূর্ণ নয়।
আমাদের মহানবী (সা.) যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করছিলেন, তখন বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘হে জন্মভূমি, আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে চাইনি; কিন্তু তোমার লোকেরা আমাকে থাকতে দিল না।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তৎকালে পৃথিবীতে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রচলিত ছিল না এবং মক্কা থেকে মদিনার দূরত্ব হচ্ছে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার। আজকাল সড়কপথে গাড়িযোগে তিন ঘণ্টায় এই দূরত্ব অতিক্রম করা যায়; কিন্তু মহানবী (সা.)-এর সময়ে উটের পিঠে আরোহণ করে মক্কা থেকে মদিনায় যেতে, অবশ্য ঘুরপথে, তাঁর সময় লেগেছিল দুই সপ্তাহ।
সে যা হোক। বিশ্বের তাবৎ জ্ঞানী-গুণীরা দেশপ্রেম সম্পর্কে অনেক সুচিন্তিত মন্তব্য করে গেছেন, যেগুলোর কতক এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে:
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিয়েই শুরু করা যাক। কবিগুরু বলেছেন, ‘দেশকে ভালো না বাসলে তাকে ভালো করে জানার ধৈর্য থাকে না; তাকে না জানলে তার ভালো করতে চাইলেও ভালো করা যায় না।’ প্রাচীন রোমান কবি ভার্জিল (খ্রিষ্টপূর্ব ৭০—১৯) বলে গেছেন, ‘সে-ই সবচেয়ে সুখী, যে নিজের দেশকে স্বর্গের মতো ভালোবাসে।’ কথাটার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় একটি সংস্কৃত প্রবচনেও, যেটাতে বলা হয়েছে, ‘জননী জন্মভূমি স্বর্গাদপি গরীয়সী’, অর্থাৎ ‘জননী জন্মভূমি স্বর্গের চাইতেও গরীয়ান’। প্রাচীন রোমান বাগ্মী সেনেকাও (খ্রিষ্টপূর্ব ৫৪—খ্রিষ্টাব্দ ৩৯) বলেছেন, ‘কেউই তার দেশকে সেটার আকার ও বৈশিষ্ট্যের জন্য ভালোবাসে না, ভালোবাসে কারণ দেশটা তার নিজের।’ প্রখ্যাত আইরিশ নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ (১৮৫৬—১৯৫০) বলেছেন, ‘দেশপ্রেম হচ্ছে আপনার দৃঢ় প্রত্যয় যে আপনার দেশটা অন্যান্য দেশের চেয়ে উৎকৃষ্টতর। কেননা, আপনি ওখানে জন্মগ্রহণ করেছেন।’ আর বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে জন এফ কেনেডি যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে অভিষিক্ত হন, তখন তিনি একটি চমৎকার কথা বলেছিলেন, ‘আপনার দেশ আপনার জন্য কী করতে পারে সে প্রশ্ন করবেন না, প্রশ্ন করুন আপনি দেশের জন্য কী করতে পারেন।’ এমন অসংখ্য উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে।
কেউ কেউ হয়তো পরিহাসের ছলে বলবেন, একজন দেশপ্রেমিক হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি তাঁর দেশকে ভালোবাসেন এবং চান দেশ থেকে যতটা সম্ভব আদায় করে নেওয়া যায়। কিছু লোকের জন্য দেশপ্রেম হচ্ছে দেশের জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করার সদিচ্ছা, যতক্ষণ পর্যন্ত না ওটা ওদের ব্যবসা-বাণিজ্য তথা আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে ক্ষতি না করে।
রাজনীতিবিদ প্রসঙ্গে গল্প আছে: একটি বাচ্চা ছেলে তার রাজনীতিবিদ পিতাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘আচ্ছা বাবা, তোমাদের বিরোধী দলের কেউ যদি তাঁর দল পরিত্যাগ করে তোমাদের দলে যোগদান করেন, তাহলে তাঁকে তোমরা কী বলবে?’
‘দেশপ্রেমিক।’ পিতা ঝটপট জবাব দিলেন
‘আর যদি তোমাদের দলের কেউ বিরোধী দলে চলে যায়?’
‘তাকে বলব দেশদ্রোহী।’ পিতা এবার প্রত্যুত্তর করলেন।
প্রশ্ন হতে পারে, দেশপ্রেমের নিদর্শন কী? তদুত্তরে বলা যায়, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনেই তো অনেক নিদর্শন বিদ্যমান। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে দেশকে মুক্ত করার দিবসটাকে ‘বিজয় দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত করে আমরা ফি-বছর উদ্যাপন করে থাকি। আমাদের দেশের দামাল ছেলেরা যখন বিদেশে কিংবা স্বদেশে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে বিদেশি টিমের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে তখন আমরা খুশিতে উদ্বেলিত হই, আর পরাজিত হলে শোকে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ি। আমাদের দেশের কোনো অর্থনীতিবিদ বা অন্য কেউ নোবেল পুরস্কার পেলে গর্বে আমাদের বুকের ছাতি দশ ইঞ্চি পরিমাণ বেড়ে যায়। নিজেরা দেশ ও জাতিকে যতই গালমন্দ করি না কেন, বিদেশিরা দেশের বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দটি করলেও খেপে গিয়ে বিজাতীয় ভাষায় বলে উঠি, ‘মাই কান্ট্রি, রাইট অর রং’। এসব বিবিধ কার্য দেশপ্রেমের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেশপ্রেম ছিল অনন্যসাধারণ; তাই তো তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’।
জাতি হিসেবে ইংরেজদের দেশপ্রেম ঈর্ষণীয় পর্যায়ের এবং একসময় যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য অস্ত যেত না, সেটা অনেকটা ইংরেজদের ওই দেশপ্রেমের কারণেই। উল্লেখ্য, দিল্লির মুঘল সম্রাট শাহজাহানের আত্মজা জাহানারার স্নেহভাজন এক বাঁদির বসনে হঠাৎ একদিন আগুন লেগে গেলে সেটা নেভাতে গিয়ে জাহানারা স্বয়ং মারাত্মকভাবে দগ্ধ হন। দেশীয় সব হেকিম-কবিরাজ ব্যর্থ হলে সুরাটের ইংরেজ কুঠিরের চিকিৎসক গ্যাব্রিয়েল বাউটন চিকিৎসা করে তাঁকে সারিয়ে তোলেন। সম্রাট প্রীত হয়ে মি. বাউটনকে তাঁর ইচ্ছানুরূপ পুরস্কৃত করতে চাইলে তিনি নিজের জন্য কিছু না চেয়ে প্রার্থনা জানালেন, কলকাতার কাছে ইংরেজদের কুঠি নির্মাণের জন্য একখণ্ড জমি এবং ভারতবর্ষে ইংরেজদের বিনা শুল্কে বাণিজ্যের অধিকার। প্রার্থনা মঞ্জুর করা হলো; উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অঙ্কুরোদ্গম হলো। দেশপ্রেমের এর চেয়ে উজ্জ্বল নিদর্শন আর কী হতে পারে?
তবে হ্যাঁ, ইংরেজদের ভাষায় ‘জেনোফোবিয়া’ বলে একটি শব্দ আছে, যেটার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ‘বিদেশের প্রতি অহেতুক ভয় বা ঘৃণা’। অধিকাংশ ইংরেজের নাকি ধারণা, তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যাকে একটিমাত্র শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা যেতে পারে এবং সেটা হচ্ছে ‘বিদেশিরা’। ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে বসবাসরত ফরাসিদের কথা নাহয় বাদই দিলাম, তাদের নিকটতম প্রতিবেশী আইরিশরাও তাদের চোখে বোকা ও স্কটিশরা হাড়-কেপ্পন আর ওয়েলসদেরও মোটেই বিশ্বাস করা যায় না।
শুধু ইংরেজদের দেশপ্রেমের কথাই বলি কেন, আমেরিকান ও জার্মানরাই বা এদিক দিয়ে কম কিসে! একদা আমেরিকান সানডে স্কুলের একজন শিক্ষক একটি ছাত্রকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘প্রথম মানুষ কে?’ প্রত্যুত্তরে ছাত্রটি জর্জ ওয়াশিংটনের নাম বলায় শিক্ষক শুধরে দিয়ে বললেন, ‘আদম’। তখন ছাত্রটি বিস্ময়সহকারে বলল, ‘আহ্! যদি আপনি বিদেশিদের কথা বলেন, তাহলে সম্ভবত আদমই।’ আর এক জার্মান টুরিস্ট আমেরিকায় বেড়াতে গিয়ে যা-ই দেখে, বলে, ‘এর চেয়ে ভালো জিনিস আমার দেশে আছে।’ অবশেষে তাকে যখন ছায়েরা জলপ্রপাত দেখাতে নেওয়া হলো তখন সে নাকি বলে উঠেছিল, ‘আমাদের দেশে এক প্লাম্বার আছে, যে ইচ্ছা করলে এই ব্লাডি লিকটা সারাতে পারবে।’
অবশ্য দেশপ্রেমের ব্যাপারে আমাদের এতদ্দেশীয় লোকেরা কম যান না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রমাত্রেই বিলেতের অধ্যাপক হেরল্ড লাসকির নাম শুনে থাকবেন। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ রাজত্বকালে নাকি তিনি একবার একজন ভারতীয় পণ্ডিতের সঙ্গে আলাপ করছিলেন। একপর্যায়ে লাসকি বলেছিলেন, ‘ব্রিটিশরা যদি ভারতবর্ষ থেকে চলে আসে, তাহলে সমস্ত উপমহাদেশে অনাচার ও অরাজকতা ছড়িয়ে পড়বে।’ সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় ওই পণ্ডিত প্রত্যুত্তর করলেন, ‘হ্যাঁ, আপনি হয়তো ঠিকই বলেছেন। তবে সে ক্ষেত্রে ওটা হবে আমাদের নিজস্ব অনাচার, নিজস্ব অরাজকতা।’
পরিশেষে উল্লেখ করা প্রয়োজন, অতিরিক্ত কোনো কিছুই যেমন ভালো নয়, তদ্রূপ অতিমাত্রায় ‘দেশপ্রেমও’ বাঞ্ছনীয় নয়। ইংরেজি ভাষায় এ প্রসঙ্গে দুটি আলাদা শব্দই আছে—‘শভিনিজম’, অর্থাৎ উৎকট স্বদেশপ্রেম ও ‘জিংগোইজম’, অর্থাৎ সংগ্রামপ্রিয় দেশপ্রেম। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, জার্মানদের উৎকট ও সংগ্রামপ্রিয় দেশপ্রেমই ছিল পৃথিবীতে দু–দুটো বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। বোধ করি এ কারণেই প্রখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক মোপাসা পরিহাসভরে বলে গেছেন, ‘দেশপ্রেম হচ্ছে একটি ডিম, যা ফুটে যুদ্ধের জন্ম হয়।’
অতএব আমরা সবাই অবশ্যই দেশপ্রেমিক হব, তবে অতি-দেশপ্রেমিক হব না এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশ ও জাতির প্রতি ঘৃণা বা তাচ্ছিল্য প্রকাশ করব না।
আতাউর রহমান: রম্য লেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷