তালেবানের উত্থানের দায় বাইডেনকে নিতে হবে

গজনি শহরে এক তালেবান যোদ্ধার সতর্ক অবস্থান
ছবি: এএফপি

গত এক সপ্তাহে তালেবান আফগানিস্তানের এক ডজনের বেশি প্রাদেশিক রাজধানী দখল করে নিয়েছে। প্রচণ্ড গতিতে তারা একের পর এক এলাকা দখল করে এখন কাবুলের একেবারে কাছে চলে এসেছে। মার্কিন বিমানবাহিনী সহায়তা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ার পর আফগান বাহিনী তালেবানকে প্রতিহত করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এখন বাস্তবতা হলো, আফগান সরকারের পক্ষে আর খুব বেশি সময় টিকে থাকা সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ছাড়তেই শুধু বাকি আছে।

কিন্তু তালেবানের এ বিপর্যয় নিয়ে আসা মোটেও অবশ্যম্ভাবী ছিল না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, তাঁর পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন তালেবানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ায় তাঁর হাত–পা বাঁধা। চুক্তির কারণেই তিনি আফগানিস্তান থেকে সেনা সরিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু ২০ বছরের বেশি সময় আমেরিকা আফগানিস্তানে বিপুল পরিমাণ লোকবল ও অর্থবল খরচ করে যতটুকু সাফল্য অর্জন আনতে পেরেছিল, তা যাতে আফগান সরকার ধরে রাখতে পারে, অন্তত তা নিশ্চিত করে মার্কিন বাহিনীকে ধাপে ধাপে সরিয়ে আনা উচিত ছিল।

কিন্তু বাইডেন তা না করে ভিন্ন পথে হাঁটলেন। তিনি লড়াইয়ের শুরুতেই এমনভাবে আমেরিকান সেনা সরানো শুরু করলেন এবং আফগান সরকারের সঙ্গে কোনো রকম সমন্বয় না করে এমনভাবে আফগান প্রশাসনকে অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দিলেন, যার ফলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণ বোধ–বুদ্ধিসম্পন্ন যেকোনো মানুষই আফগানিস্তানে অনির্দিষ্টকালের জন্য মার্কিন সেনা মোতায়েন করে রাখার পক্ষে মত দেবেন না। আমি এবং অন্যরা বরাবরই বলে আসছি, যুক্তরাষ্ট্র এত দিন সেখানে যা কিছু অর্জন করেছে অন্তত তা যাতে হাতছাড়া না হয়, সে বিষয়ে বাইডেনের মন দেওয়া উচিত ছিল।

বাইডেন মনে করেন, আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের আবার নতুন করে অর্থ ব্যয় করার মানে হলো সেখানে অনন্তকাল অর্থ ও লোকবল খরচ করে যাওয়ার রসিদে সই করার শামিল। তিনি বলেছেন, ট্রাম্প তালেবানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তাঁর সামনে তেমন কোনো ভালো বিকল্প রেখে যাননি। তাঁর এ যুক্তি ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেখান থেকে আজ হোক কাল হোক সরতেই হতো। কিন্তু যেভাবে তিনি হুড়োহুড়ি করে সেনা সরালেন, নিশ্চয়ই ট্রাম্প সে ধরনের কোনো শর্ত রেখে যাননি। এ তাড়াহুড়োর কারণে যা হওয়ার তাই হয়েছে। তালেবান অপ্রতিরোধ্য হয়ে এখন কাবুলের দিকে ধেয়ে আসছে। পেন্টাগনও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আফগানিস্তান থেকে মার্কিন দূতাবাসের কর্মীদের সরিয়ে আনতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ সেনা প্রত্যাহারে আরও বেশি সময় নেওয়ার দরকার ছিল এবং ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েই সে প্রত্যাহার শুরু করা যেত। বাইডেনের এ ভুলের কারণে ইতিহাস তাঁকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যর্থ নেতা হিসেবে হয়তো নথিবদ্ধ করে রাখবে।

বাইডেন যখন সেনা প্রত্যাহারের আদেশ দেন, তখন আফগানিস্তানে মোট সাড়ে তিন হাজার মার্কিন সেনা ছিল। এই সব সেনাকে একসঙ্গে না সরিয়ে যদি আগামী এক বছরের জন্য সেখানে এক বা দুই হাজার সেনা রাখতেন এবং তাদের দিয়ে আফগান বাহিনীকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতেন, তাহলে পরিস্থিতি এ জায়গায় আসত না।

মার্কিন সামরিক পরিকল্পকদের সবাই ভালো করে জানেন, বরাবরই মৌসুম ভিত্তিতে তালেবানের যুদ্ধ হয়ে থাকে। তালেবান নেতারা সাধারণত শীতকালে তাঁদের ঘাঁটিতে, বিশেষ করে পাকিস্তানের বিভিন্ন গোপন আস্তানায় আশ্রয় নিয়ে থাকেন। এ সময় তালেবান যোদ্ধারা শক্তি সঞ্চয় করেন এবং বসন্তকালে গরম পড়ার সময় তাঁরা যুদ্ধের জন্য সংঘবদ্ধ হন। এরপর চাষ করা পপি তোলা শেষ হলে গ্রীষ্মে পুরোদমে লড়াইয়ে নেমে পড়েন। এ মৌসুম পর্যন্ত অন্তত মার্কিন বাহিনীর আফগান সেনাদের পাশে থাকা উচিত ছিল। আগামী শীত আসার আগপর্যন্ত আফগান সরকারকে সহায়তা দিলে আশরাফ গনির সরকার তালেবান মোকাবিলার জন্য করণীয় ঠিক করতে সময় পেত। অন্যদিকে, আমেরিকান কূটনীতিকেরাও এ সময়টাতে আঞ্চলিক মিত্রদের সঙ্গে আফগান ইস্যুতে কী কী করা দরকার, তা ঠিক করার বিষয়ে আলোচনা করার সময় পেতেন। আলোচনা ফলপ্রসূ না হলে সামরিক কৌশল কী হবে, তা নিয়ে প্রস্তুতি নেওয়া যেত।

বাইডেন যখন সেনা প্রত্যাহারের আদেশ দেন, তখন আফগানিস্তানে মোট সাড়ে তিন হাজার মার্কিন সেনা ছিল। এই সব সেনাকে একসঙ্গে না সরিয়ে যদি আগামী এক বছরের জন্য সেখানে এক বা দুই হাজার সেনা রাখতেন এবং তাদের দিয়ে আফগান বাহিনীকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতেন, তাহলে পরিস্থিতি এ জায়গায় আসত না। মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর দেশটি কীভাবে চলবে, সে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা কী হবে, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের বিচরণ নিরাপদ রাখতে কাবুল বিমানবন্দরকে কীভাবে সুরক্ষিত রাখা হবে, তা নিয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণাও কাউকে দেওয়া হয়নি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেসব আফগান দোভাষী আমেরিকানদের সহায়তা করেছেন, তাঁদের নিরাপদে সরিয়ে আনা যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই সব দোভাষী এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের আফগান সহায়তাকারীদের ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন দূতাবাস নজিরবিহীন গড়িমসি করেছে। অনেকের ভিসা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

এটি স্পষ্ট যে ১ মে থেকে সেনা প্রত্যাহার করার বিষয়ে ট্রাম্প তালেবানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে বাইডেনের হাত–পা বেঁধে দিয়ে গেছেন। কিন্তু সেনা প্রত্যাহারে বাইডেন আরও সময় নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি এখন যে সিদ্ধান্ত নিলেন, তাতে বিশ্বের কাছে কী বার্তা গেল? যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের কাছে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়েছে—এমন ধারণাই এখন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।

এখন বাইডেনের ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ আফগান নাগরিকদের। তালেবান বন্যার পানির মতো নতুন নতুন এলাকায় ঢুকে পড়ছে। একের পর এক সরকারি কর্মকর্তাদের হত্যা করছে। তারা তাদের নিবর্তনমূলক মতাদর্শ পালনে লোকদের বাধ্য করছে। বাইডেনের এ ভুলের কারণে যুক্তরাষ্ট্র এরপর কোনো দেশের নাগরিকদের কাছে সহায়তা চাইলে সে ক্ষেত্রে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা দেবে কি না, তা নিয়ে তাদের দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে।


নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

ফ্রেডেরিক ডব্লিউ কাগান আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের একজন সিনিয়র ফেলো