২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

তাঁদের শূন্যতা আমরা আজও বহন করে চলেছি

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর সকালবেলা। মুক্তিযুদ্ধের নানা পরিক্রমায় আমরা কয়েকজন যারা আগরতলার বিশ্রামগঞ্জ মুক্তিবাহিনী হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কর্মরত ছিলাম, বন্ধু কেকা করীমের আশ্রয়ে তখন কলকাতাবাসী। প্রতিদিন প্রতিক্ষণ মনের ভেতর একই ভাবনা, একই উদ্বেগ। কেমন আছে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে রেখে আসা আত্মীয়–পরিজন, বন্ধুবান্ধব, স্বজনেরা। কবে দেশ স্বাধীন হবে? দেশে ফিরে সবাইকে দেখতে পাব তো!

তখন তো মোবাইলের যুগ শুরু হয়নি। মালিকের টেলিফোনে ডাক পড়ল আমার। অপর পারে মুক্তিযুদ্ধের শুভানুধ্যায়ী প্রিয় গৌরীদি, গৌরী আইয়ূবের কণ্ঠ। ‘তাড়াতাড়ি রেডিও ধরো, তোমরা বিজয় অর্জন করেছ।’ কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন আমার হৃৎস্পন্দন থেমে গেল। দৌড়ে ঘরে এসে সবাইকে ডাকলাম। রেডিওর বোতাম ঘোরানো মাত্র খুব পরিচিত, খুব কাছের এবং শ্রদ্ধেয় কয়েকজন ব্যক্তির নাম শুনতে পেলাম। সংবাদ পাঠক এক এক করে এই নামের তালিকায় যাঁদের আমরা আমাদের নাগরিক সমাজের নেতা, সর্বজনের মান্য বুদ্ধিজীবী বলে জানি তাঁদের নাম বলে যেতে লাগলেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন দেশের বরেণ্য সাংবাদিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী এবং অন্য পেশাজীবীরা। ভাবছিলাম তাঁরা হয়তো মুক্তিযুদ্ধের বিজয় উদ্‌যাপন করতে হয় শহীদ মিনার কিংবা বাংলা একাডেমিতে একত্র হয়েছেন। কারণ, যাঁদের নাম শুনছিলাম, তাঁরা সবাই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষ, যাঁরা অবরুদ্ধ বাংলাদেশে জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কাজ চালিয়ে নিয়ে গেছেন। তাঁরা তো বিজয় উদ্‌যাপন করবেনই।

অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকলাম সংবাদ পাঠক কখন বলবেন তাঁরা কী কারণে, কোথায় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। কখন তাঁদের কণ্ঠস্বর শুনতে পাব? পরক্ষণেই একটু উদ্বিগ্ন বোধ করলাম। বিশেষ করে আমি আর আমার ছোট বোন সাঈদা কামাল। ভাবছি মা সুফিয়া কামালের নাম উল্লেখ করছে না কেন এরা? মা কি তাহলে সুস্থ নন? একটা এত বড় জাতীয় অনুষ্ঠান হচ্ছে আর মা সেখানে উপস্থিত থাকবেন না? এর মাঝেই সংবাদ পাঠকের শেষ বাক্যটি কানে এল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী জামায়াতে ইসলামীর ঘাতক দল আলবদর এবং আলশামস ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে এঁদের নৃশংসভাবে হত্যা করে এখানে-ওখানে বধ্যভূমিগুলোতে ফেলে রেখে গেছে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহর থেকে বিজয়ের আগমুহূর্ত পর্যন্ত যেসব বরেণ্য বুদ্ধিজীবীকে আমরা হারিয়েছি, তাঁদের মধ্যে আছেন অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, মুনীর চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, রাশীদুল হাসান, ড. আবুল খায়ের, ড. আনোয়ার পাশা, সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, আলতাফ মাহমুদ, নিজামুদ্দীন আহমদ, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, সেলিনা পারভীন প্রমুখ।

অসাড়, বাকরুদ্ধ হয়ে ভাবছিলাম যা শুনলাম সেটা কি সত্যি? সত্যিই এই মানুষগুলো আর নেই? বাংলাদেশের দীর্ঘ সময়ের নানা আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে যাঁরা আমাদের চেতনা এবং আদর্শের সংজ্ঞা আর মান নির্ণয়ে অবদান রেখেছেন, মূলধারার রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং নারী অধিকার আন্দোলনের ধারাকে যুক্ত করতে ভূমিকা রেখেছেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধকে সব মানুষের যুদ্ধে পরিণত করতে সহযোগী ভূমিকা রেখেছেন, তাঁরা এমনভাবে স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে প্রাণ হারালেন?

অচিরেই একের পর এক সূত্র থেকে এই খবরের সত্যতা নিয়ে আর সন্দেহের অবকাশ থাকল না। ভয়ানক এক শূন্যতার বোধ যেন আমাদের সব চিন্তাভাবনা, চলনশক্তি হরণ করে নিল।

২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর—গণহত্যা শুরুর প্রথম থেকেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বেছে নিয়েছিল বুদ্ধিজীবী হত্যার ন্যক্কারজনক কৌশল। এ কথা ঠিক, তাদের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগকে নির্মূল করা। একই সঙ্গে হিন্দু জনগোষ্ঠীকেও বিশেষভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার করেছিল তারা। তবে গণহত্যারত এই হানাদার বাহিনীর বন্দুকের নল তাক করে থেকেছে বাংলাদেশের সব মানুষের বুকের দিকে। ২৫ মার্চে তারা প্রথমেই পুলিশ আর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল বাহিনীর সঙ্গে তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের। তার আগেই তারা সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছিল।

বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে তাঁর বন্দিদশার ছবি প্রকাশ করে বাংলাদেশের মানুষের মনোবল ভেঙে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ধূর্ত হানাদার বাহিনী আর তার দোসরেরা এ কথা বুঝতে ভুল করেনি যে একটা জাতিকে নির্মূল করতে হলে, তাদের পরিচয় চিরতরে মুছে দিতে হলে তাদের পথপ্রদর্শক বুদ্ধিজীবীদের শেষ করে দিতে হবে। একটি জাতির মেধা, মনন আর প্রজ্ঞার আধার যাঁরা, যাঁরা সব ক্রান্তিকালে, সংকটে-সম্পদে রাজনীতিকসহ সব সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তিকে তাঁদের জ্ঞান, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা দিয়ে ঋদ্ধ করেন, আলোকিত করেন, তাঁদের চিরতরে সরিয়ে দিয়ে সেই জাতিকে অভিভাবকহারা করে দিতে পারলে সেই জাতি পথের দিশা খুঁজে পাবে না সহজে। তাই নিরস্ত্র, অহিংস, নির্বিবাদী এই মানুষগুলোকে বেছে বেছে হত্যা করল ঘাতকেরা।

ফল যা হওয়ার তাই হলো। বাংলাদেশের উল্টো পথে হাঁটার ভাগ্য বরণ করে নিতে হলো। খল, বিশ্বাসঘাতক শক্তির হাতে ঘটল মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতীকের নির্মম মৃত্যু। কোনো সামাজিক শক্তি কোনো রকম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। পরবর্তী সময়েও কত সহজে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ধ্যানধারণা, সাম্প্রদায়িকতা, নারীবিদ্বেষী চিন্তা আমাদের শিক্ষা, সামাজিক সংস্কৃতি, রাজনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করাতে সক্ষম হয়েছে সামরিকতন্ত্রী দখলদারেরা। সেই দখলদারির ফলে জাতির যে সুদূরপ্রসারী ক্ষতি হয়েছে, যে গভীর শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে বের হওয়ার পথ আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিও সময়ে সময়ে এ ব্যাপারে তাদের অসহায়তা প্রকাশ করে থাকেন নানা আলোচনায়।

দুঃখের বিষয়, আমাদের রাজনীতিতে সেই শূন্যতা পূরণ করতে সংশ্লিষ্টদের আগ্রহী হতে লক্ষ করি না। সেই ক্ষতি পূরণ হতে পারত, যদি সমাজের সব প্রগতিশীল শক্তিকে উজ্জীবিত করে দেশের কাজে নিয়োজিত করার নীতি গ্রহণ করা হতো। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিকদেরই মূল ভূমিকা পালন করতে হয়, বিশেষত ক্ষমতাসীন দলকে। সেখানে বরং রাজনীতি আর সামাজিক নেতৃত্বের মধ্যে যেন একটা সংঘাত তৈরির প্রবণতাই অনুভূত হয়। আমার শঙ্কা ভুল প্রমাণিত হলে স্বস্তি পাব। বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসে হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত সব বুদ্ধিজীবীর প্রতি নিবেদন করি আমার গভীর শ্রদ্ধা। তাঁদের শূন্যতা আজও আমরা বহন করে চলেছি।

  • সুলতানা কামাল মানবাধিকারকর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা