২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ডিজিটাল মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কি আরও কমছে

বাংলাদেশে ডিজিটাল মাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ আরও কড়াকড়ি করার পথে হাঁটছে সরকার। এর ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গণমাধ্যম এবং ওটিটিসহ ইন্টারনেটভিত্তিক বিনোদনমূলক প্ল্যাটফর্মে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ আরও সংকুচিত হবে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের আলাদা দুটি খসড়া নীতিমালা এমন আশঙ্কাই তৈরি করেছে। এই দুটি খসড়া নীতিমালায় এমন কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা বহুল আলোচিত-সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
বিটিআরসির ওয়েবসাইটে দেওয়া ও ইংরেজিতে লেখা খসড়া নীতিমালাকে ‘দ্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্লাটফর্মস ২০২১’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া ও বাংলায় লেখা নীতিমালার শিরোনাম হচ্ছে, ‘ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান এবং পরিচালনা নীতিমালা-২০২১ (খসড়া)’। বিটিআরসির খসড়া নীতিমালা ওয়েবসাইটে দিয়ে তাতে ১৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জনগণের মতামত চাওয়া হয়েছে। তবে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে জনগণের মতামত চাওয়া বা কারও সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার বিষয়টি নেই।

বিটিআরসির খসড়া নীতিমালা
‘দ্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্লাটফর্মস ২০২১’ প্রণয়নে উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ওই নীতিমালার পটভূমিতে (ব্যাকগ্রাউন্ড) আরও বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আদেশ এবং আমাদের দূরদর্শী নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মিল রেখে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা প্রণয়ন করতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন একটি কমিটি গঠন করেছিল।’ এখানে দাবি করা হয়, আন্তর্জাতিক সর্বোৎকৃষ্ট রীতিনীতি এবং আইটিইউর (আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন) পরামর্শ বিবেচনা করে কমিটি এই কর্মপদ্ধতি প্রস্তাব করে।

এই খসড়া নীতিমালায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য যেমন, তেমনি প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের জন্যও বেশ কিছু নিয়ম করা হয়েছে। এতে ‘মধ্যস্থতাকারী’ (ইন্টারমিডিয়ারি) হিসেবে এক ব্যক্তিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যিনি অন্য কোনো ব্যক্তির পক্ষে ইলেকট্রনিক রেকর্ড গ্রহণ, সংরক্ষণ এবং প্রেরণ করেন অথবা এই ধরনের রেকর্ড সংশ্লিষ্ট সেবা প্রদান করেন। এর মধ্যে টেলিকম-নেটওয়ার্ক-ইন্টারনেট-ওয়েব হোস্টিং সেবা প্রদানকারী, সার্চ ইঞ্জিন, অনলাইন পেমেন্ট সাইট, অনলাইন অকশন সাইট, অনলাইন মার্কেট প্লেস ও সাইবার ক্যাফেও অন্তর্ভুক্ত।

‘মধ্যস্থতাকারীদের দায়িত্ব’ শিরোনামে নীতিমালার দ্বিতীয় ভাগে বলা হয়েছে, তারা ব্যবহারকারীদের এমন কিছু প্রকাশ, প্রদর্শন, প্রেরণ, সংরক্ষণ, আপলোড বা শেয়ার না করার কথা জানাবেন, যা ‘বাংলাদেশের ঐক্য, অখণ্ডতা, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা অথবা সার্বভৌমত্ব, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অথবা জনশৃঙ্খলার প্রতি হুমকি…’, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির জনক, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে’, ‘কোনো ব্যক্তির প্রতি আক্রমণাত্মক, মিথ্যা, হুমকি বা ভীতি-প্রদর্শক ও অপমানজনক বা মানহানিকর’, ‘ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিকে আঘাত করে’ এবং ‘সরকারের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে’। এ ছাড়া ‘সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ, ঘৃণা বা শত্রুতা তৈরি করে অথবা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বংস করে অথবা অশান্তি বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে কিংবা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় বা অবনতি ঘটানোর দিকে অগ্রসর হয়’—এ রকম কোনো কিছু প্রকাশ, প্রদর্শন, প্রেরণ, সংরক্ষণ, আপলোড বা শেয়ার না করা হয়, সেটাও নিশ্চিত করবেন ‘মধ্যস্থতাকারী’। এখানে উল্লেখিত কয়েকটি বিষয় বহুল আলোচিত-সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১, ২৫, ২৯, ৩১ এবং ৩২ ধারার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

এই খসড়া নীতিমালায় সংবাদ ও সাম্প্রতিক বিষয়াবলি নিয়ে তৈরি কনটেন্ট, ‘অনলাইন কিউরেটেড কনটেন্ট’ এবং ওয়েব সিরিজগুলোও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এগুলো গণমাধ্যম এবং সম্ভাবনাময় বিনোদনমূলক ওটিটি (ওভার দ্য টপ) প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এই খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ক্ষেত্রে ‘মধ্যস্থতাকারীর’ যে দায়দায়িত্ব, সংবাদ ও সাম্প্রতিক বিষয়াবলি নিয়ে তৈরি কনটেন্ট ও ‘অনলাইন কিউরেটেড কনটেন্ট’-এর ক্ষেত্রে ‘প্রকাশক’ (পাবলিশার) প্রায় একই রকম দায়িত্ব পালন করবেন।

ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে কেউ যদি উল্লেখিত বিষয়গুলো প্রকাশ, প্রদর্শন, প্রেরণ, সংরক্ষণ, আপলোড বা শেয়ার করেন, তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। একইভাবে ‘মধ্যস্থতাকারী’ বা ‘প্রকাশক’ তাঁর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে, তাঁর বিরুদ্ধেও নানাবিধ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। ডিজিটাল মাধ্যমে যে বিষয়গুলো প্রচার বা প্রকাশ না করতে বলা হয়েছে, সে রকম কিছু প্রকাশ বা প্রচার করা হচ্ছে—এমন মনে হলে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন তা বন্ধ বা ব্লক করতে বা সরাতে পারবে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের কারণ দর্শানো বা শুনানি ছাড়াই কমিশন এ কাজ করতে পারবে।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের খসড়া নীতিমালা

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের খসড়া নীতিমালার বিষয় হচ্ছে সুনির্দিষ্টভাবে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। এর শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, ‘ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান এবং পরিচালনা নীতিমালা-২০২১ (খসড়া)’। এই নীতিমালায় বলা হয়েছে, ‘ইচ্ছাকৃত বা বিদ্বেষপূর্ণ কারণে কোনো উপকরণ (কনটেন্ট) দ্বারা জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অসম্মানিত করা যাইবে না’, ‘...রাষ্ট্র ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে এ ধরনের কোনো উপকরণ (কনটেন্ট) তৈরি বা সম্প্রচার করা যাইবে না’ এবং ‘অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর এমন কনটেন্ট সম্প্রচার/ প্রদর্শন করা যাইবে না’। এখানে উল্লেখিত বিষয়গুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ৩১ ধারার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

এই নীতিমালায় ‘অশ্লীল কনটেন্ট’ ও ‘নিষিদ্ধ কনটেন্ট’ কে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ‘অশ্লীল কনটেন্ট অর্থ প্রচলিত আইন ও এই নীতিমালা ও তার অধীন প্রণীতব্য সংশ্লিষ্ট সকল নির্দেশিকার বহির্ভূত কনটেন্ট’। অন্যদিকে ‘নিষিদ্ধ কনটেন্ট অর্থ মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ পরিপন্থী, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী, রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ও অখণ্ডতার প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারী তথা প্রচলিত আইনের পরিপন্থী, দেশি সংস্কৃতিবিরোধী, সামাজিক মূল্যবোধ বিনষ্টকারী কোনো কনটেন্ট বা তথ্য উপকরণ’। এতে আরও বলা হয়েছে, ‘এই নীতিমালার ১৩ বিধির বিধান লঙ্ঘন করিয়া কোনো নিবন্ধিত প্ল্যাটফর্ম কোনো নিষিদ্ধ কনটেন্ট সম্প্রচার করিলে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ ওই নিষিদ্ধ কনটেন্ট অপসারণের জন্য ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ প্রদান করিবেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাহা অপসারণে বাধ্য থাকিবে। এ ক্ষেত্রে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করিবে।’

বাংলাদেশে নীতিমালার নামে নানা রকম বিধিনিষেধ বা বাধ্যবাধকতা আরোপ করার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। কিন্তু একদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের কথা বলা, আবার সেই আইনের বিভিন্ন ধারার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ করে নীতিমালা প্রণয়ন করা—এতে সরকারের উদ্দেশ্য ও অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়। সরকারের এই দ্বিমুখী আচরণ দেখে মনে হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থেকে সহসাই আমাদের মুক্তি নেই, বরং নানা রকম নিয়মনীতির মোড়কে আমাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আরও বেশি হুমকির মুখে পড়ছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অভিজ্ঞতা এবং খসড়া নীতিমালা নিয়ে আশঙ্কা
সাইবার ক্রাইমসহ ডিজিটাল মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ, হয়রানি ও প্রতারণা বন্ধের উদ্দেশ্যের কথা বলে প্রথমে তথ্যপ্রযুক্তি আইন এবং পরে তা সংশোধন করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হয়। এরই মধ্যে আইনটি বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে একটি ‘আতঙ্ক’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই আইনে এমন অনেক বিষয়কে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, যা খুবই আপেক্ষিক এবং যেগুলোর কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আইনটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে এবং গত তিন বছরে সেটাই বহুভাবে চর্চিত হয়েছে। এ কারণে আইনটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে।

৮ ফেব্রুয়ারি আয়ারল্যান্ডভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ‘ফ্রন্টলাইন ডিফেন্ডার্স’ কর্তৃক প্রকাশিত এক তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটিকে একটি নিবর্তমূলক আইন হিসেবে অভিহিত করে তা স্থগিতের আহ্বান জানানো হয়। এর আগে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ একাধিক দেশি-বিদেশি সংস্থাও আইনটি বাতিল বা সংশোধনের কথা বলেছে। কিন্তু সরকার এ বিষয়ে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন ডিজিটাল মিডিয়া ও ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নিয়ে করা সরকারি দুটি প্রতিষ্ঠানের নীতিমালার সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন ধারার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে যা খুবই আশঙ্কাজনক। বিটিআরসির খসড়া নীতিমালা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘এখন বাংলাদেশের বাস্তবতায় কোনো বিষয়ে রাস্তায় প্রতিবাদে বাধা আসে। অন্য কোনো মাধ্যমেও প্রতিবাদ করা যায় না। সেখানে ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মতপ্রকাশের একটা প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দাঁড়িয়েছে। সেটাকেও এখন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পর এই নীতিমালা মানুষের মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে ভয় বাড়িয়ে দেবে’ (বিবিসি বাংলা, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২)।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বড় ভুক্তভোগী বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ও সংবাদকর্মীরা। এই আইনে বহু সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাঁদেরকে গ্রেপ্তার করে জেলেও পাঠানো হয়েছে। আইনটি যে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য হুমকি, তা বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার পর্যবেক্ষণেও স্পষ্ট হয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে বিটিআরসির খসড়া নীতিমালার সাদৃশ্য নিয়ে ‘বণিক বার্তা’র সম্পাদক ও সম্পাদক পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ বলেন, ‘সম্পাদক পরিষদ ও গণমাধ্যম কর্মীরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নির্দিষ্ট কিছু ধারা নিয়ে উদ্বিগ্ন, আইনমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, আইনটির অপব্যবহার হচ্ছে এবং এর কয়েকটি ধারা সংশোধন করা প্রয়োজন। সেই ধারাগুলো সংশোধন করার পরিবর্তে এখন আমরা দেখছি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের খসড়া নীতিমালায় সেগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যে সমস্যার সৃষ্টি করছে, এই খসড়া নীতিমালার বাস্তবায়নও একই সমস্যার সৃষ্টি করবে’ (ডেইলি স্টার, ৮ ফেব্রুয়ারি।)

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের মূল ধারার চলচ্চিত্র এখন খুবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এক সময় বছরে শতাধিক চলচ্চিত্র নির্মিত হলেও সেই সংখ্যা এখন দশ–বারোতে নেমে এসেছে এবং গত কয়েক বছরে দেশের বেশির ভাগ সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। এই ভগ্নদশার জন্য অন্যান্য কারণের পাশাপাশি চলচ্চিত্রে বিষয়ের পুনরাবৃত্তি ও বৈচিত্রহীনতা, সৃজনশীলতা ও নতুন চিন্তা-ভাবনার অভাব এবং সেন্সর বোর্ডসহ নানারকম বিধিনিষেধও দায়ী।

এ রকম অবস্থায় নির্মাতাদের কাছে একটি বিকল্প হিসেবে হাজির হয়েছে ওয়েব সিরিজ। এই ওয়েব সিরিজগুলো প্রদর্শিত হয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে। বহুল জনপ্রিয় নেটফ্লিক্স, আমাজন প্রাইম, হইচই—হলো এ রকম কিছু বিদেশি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। এরই মধ্যে দেশি মালিকানাধীন কিছু ওটিটি প্ল্যাটফর্মও কাজ শুরু করেছে এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ কনটেন্টের জন্য দর্শক বা ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছে। কিন্তু তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের খসড়া নীতিমালা দেশের সম্ভাবনাময় ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য একটি ‘অশনিসংকেত’। এই নীতিমালার সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারার সাদৃশ্য রয়েছে। নীতিমালাটিতে কিছু আপেক্ষিক ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণহীন বিষয় উল্লেখ করে কনটেন্টের ক্ষেত্রে একধরনের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এটি একদিকে যেমন একজন নির্মাতার শৈল্পিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, তেমনি এটি তার কাজের সুযোগকেও সংকুচিত করবে। এ বিষয়ে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘ওটিটি’র জন্য যে নীতিমালার খসড়া হয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। এই নীতিমালা চলচ্চিত্রকর্মীদের জন্য বিপজ্জনক এবং ভীষণ নিয়ন্ত্রণমূলক। এটা শিল্পীর স্বাধীন চিন্তার প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করবে। এর ফলে মানসম্পন্ন ও প্রথাবিরোধী কনটেন্ট তৈরি হবে না। ফলে দর্শকেরাও দেশি ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবে।’

বাংলাদেশে নীতিমালার নামে নানা রকম বিধিনিষেধ বা বাধ্যবাধকতা আরোপ করার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। কিন্তু একদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের কথা বলা, আবার সেই আইনের বিভিন্ন ধারার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ করে নীতিমালা প্রণয়ন করা—এতে সরকারের উদ্দেশ্য ও অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়। সরকারের এই দ্বিমুখী আচরণ দেখে মনে হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থেকে সহসাই আমাদের মুক্তি নেই, বরং নানা রকম নিয়মনীতির মোড়কে আমাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আরও বেশি হুমকির মুখে পড়ছে।

মনজুরুল ইসলাম সাংবাদিক