নুন দিয়ে চিনিপানা খাওয়ার মতো গরিবের দৌড় বড়জোর প্রতিবেশী ভারত, আরেকটু বেশি হলে নেপাল। ভারত আসলে অনেকটা ‘পাশের পাড়া’র মতো, নেপাল যেন ঢিল ছোড়া দূরত্বের আরেক গাঁ। চিকিৎসাসহ নানা কারণে অনেকেরই ভারতে যেতে-আসতে হয়, নেপাল মূলত শখের ভ্রমণ তালিকায় থাকা প্রথম দেশ। সাধ ও সাধ্যের যুগলবন্দী আমাদের অনেককেই দেশ দুটিতে প্রথম পর্যটক হওয়ায় উৎসাহী করে। এসব দেশে পা রেখে প্রথমেই যাতে চোখে আটকে যায়, তা হলো ‘শৃঙ্খলা’। বাংলাদেশের মতোই মানুষের চাপ, ভিড়, কিন্তু ব্যবস্থা সেখানে দৃশ্যমান, বিশেষ করে পরিবহনব্যবস্থা।
প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, জিডিপি ইত্যাদি নানা পরিমাপ, পরিসংখ্যান, সূচকে ভারত, নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য তেমন একটা নেই; বরং কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে বলেই কর্তাব্যক্তিদের কথাবার্তায় ঘুরেফিরে শোনা যায়। কিন্তু দিল্লি বা কাঠমান্ডুর সঙ্গে ঢাকার রাস্তার তুলনায় মনে আসে ‘অভিভাবকহীন’ শব্দটি। ঢাকাকে দুই ভাগ করে দুটি করপোরেশন করা হয়েছে, শহরটির অভিভাবক দুজন, কিন্তু আগের লাউ এখন হয়েছে কদু! শুধু অব্যবস্থাপনা বা বিশৃঙ্খলাই নয়, আমাদের রাজপথ রক্তপিপাসুও! প্রায় প্রতিদিনই কারও না কারও প্রাণ না কেড়ে সে ‘শান্ত’ হয় না!
যেখানে সবার মাথাপিছু আয় বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে, তখন বাসমালিকদের আয় কমছে! দেশের জন্য দুঃসংবাদই বলতে হয়। দরদি মন নিয়ে বরং জনগণেরেই বিষয়টা ভেবে দেখা উচিত—এমন দুঃসংবাদের পাশে প্রতিদিন পাঁচ-সাতজনের মৃত্যু, এ আর এমন কী! ‘পথখরচ’ বলেও তো একটা কথা আছে; পথে চলতে গেলে কিছু খরচ হয়। এসব মৃত্যু না হয় উন্নয়নের পথে থাকা বাংলাদেশের ‘খরচের খাতায়’ লেখা থাক।
সংসদে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীকে ‘টোটালি ফেইল’ (বা সম্পূর্ণ ব্যর্থ) বলায় অবশ্য পরিস্থিতির ইতরবিশেষ হয় না। মাইশা মমতাজ আর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শেষে স্কুটি নিয়ে আর উত্তরার বাসায় ফিরবেন না। ওয়ারীর শিশু মারিয়ান রুহী ফিরে পাবে না তার মাকে। ফরিদপুরের শেখ নাঈমের মা নাজমা বেগমের আহাজারি—‘ওরে বাজান, আমার বাজান চইলা গেল রে। আমার বাজানরে আইনা দে’ আর ‘খবর’ হবে না কোনো গণমাধ্যমে। বাবার সঙ্গে মোটরসাইকেলে চড়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিল রাজশাহীর প্রথম শ্রেণি পড়ুয়া আফরিন হক। ফুটফুটে শিশুটির ঠাঁই হয়েছে কবরে। উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না; গতকালের বাসি মৃত্যুর কথা লিখতে লিখতে আসবে আজকের টাটকা প্রাণহানির খবর! অবস্থাদৃষ্টে কারও মনে হতেই পারে, গতকালের পত্রিকা আজ পুরোনো, সড়কে মানুষের মৃত্যুও তেমনি আলোচনায় থাকে বড়জোর এক দিন!
কিন্তু যে মায়ের নাড়িছেঁড়া ধন চলে গেল, যে বাবা তাঁর নয়নের মণিকে হারালেন, তাঁরা কি আমৃত্যু একটা দিনের জন্যও সন্তানশোক ভুলতে পারবেন? দুর্ঘটনা এ দেশে তো আর ‘দুর্ঘটনা’ নয়, তাই এত এত মৃত্যুর কোনো বিচার দেখে না দেশবাসী। দোষীর শাস্তি দেখতে পারলেও হয়তো মায়ের দগ্ধ অন্তরাত্মার জ্বলুনি একটু কমত, বাবার বুকের ভার কিছুটা লাঘব হতো। ন্যায়বিচারে সন্তানের বিষণ্নতা ঘুচত, ভাই-বোনের হাহাকার কমত, বন্ধু-স্বজনের দীর্ঘশ্বাস হালকা হতো।
২০১৮ সালে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আবদুল করিম রাজীব (১৭) ও একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মীমের মৃত্যুর পর সড়কে নেমে এসেছিল সারা দেশের শিক্ষার্থীরা। সড়ক নিরাপদ করতে তাদের সব দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছিল। এরপর বুড়িগঙ্গার দূষিত পানি আরও দূষিত হয়েছে, ঢাকার বাতাস ভরেছে বিষে, সড়কের পরিস্থিতি হয়েছে আরও ‘প্রাণনাশী’। ‘অরাজকতা’, ‘নৈরাজ্য’ কিংবা ‘হযবরল’—কোনো বিশেষণই দিয়েই একে আর চেনানো যায় না।
তবু জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব মুজিবুল হক ৩ মার্চ সংসদে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘বর্তমান সরকার অনেক উন্নয়নের দাবিদার। কিন্তু রাজধানী শহর ঢাকায় ট্রান্সপোর্টের একটা নীতিমালা, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা চোখে পড়েনি।’ আমাদের চোখেও পড়ে না, আমাদের চোখের পোড়ানিও কমে না। মুজিবুল হক লক্কড়ঝক্কড় বাসের কথা বললেন। বললেন, লাইসেন্স নেই, কোনো আইন মানে না, যেখানে সেখানে পার্ক করে রাখে। এসব কথার সারমর্ম টানলেন তিনি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীকে ‘টোটালি ফেইল’ অভিহিত করে। পাশাপাশি তিনি সংসদে উপস্থিত বাংলাদেশ বাসমালিক সমিতির সভাপতি ও জাপার সাংসদ মসিউর রহমানকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘আপনারা মানুষের প্রতি দরদি হোন।’
মুজিবুল হক যখন এই বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সংসদের অধিবেশন কক্ষে উপস্থিত ছিলেন না। তাই তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানা গেল না। তবে মসিউর রহমান ‘শাণিত’ জবাব দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘আমার কলিগ, আমি ওনার (মুজিবুল হক) আগে জাতীয় পার্টির মহাসচিব ছিলাম দুই বছর। সেই ক্ষোভে কি না বা আমি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি, সে ক্ষোভে কি না বা জনগণের দুর্দশা দেখে কি না, কীভাবে উনি বলেছেন, আমি বুঝতে পারলাম না।’ তবে তিনি ‘হিসাব’ যে পাই পাই করে ষোলো আনা ছাড়িয়ে আঠারো আনা বোঝেন, তা বোঝা গেল তাঁর বক্তব্যের পরবর্তী অংশে। তাঁর ভাষ্য, ঢাকায় যানজটের কারণে এখন একটি বাস তিনটির বেশি ট্রিপ দিতে পারে না। আয় কমে গেছে।
যেখানে সবার মাথাপিছু আয় বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে, তখন বাসমালিকদের আয় কমছে! দেশের জন্য দুঃসংবাদই বলতে হয়। দরদি মন নিয়ে বরং জনগণেরেই বিষয়টা ভেবে দেখা উচিত—এমন দুঃসংবাদের পাশে প্রতিদিন পাঁচ-সাতজনের মৃত্যু, এ আর এমন কী! ‘পথখরচ’ বলেও তো একটা কথা আছে; পথে চলতে গেলে কিছু খরচ হয়। এসব মৃত্যু না হয় উন্নয়নের পথে থাকা বাংলাদেশের ‘খরচের খাতায়’ লেখা থাক।
হাসান ইমাম সাংবাদিক
[email protected]