টিয়া পাখি গণিত জানে
টিয়া পাখি গণিত জানে। টিয়া পাখি আর তোতা পাখি কিন্তু একই। যাহাই টিয়া, তাহাই তোতা, তাহাই কাকাতুয়া। তোতা পাখি বিখ্যাত তার মুখস্থবিদ্যার জন্য। শেখানো বুলি আওড়ানোর ক্ষমতার জন্য।
তাহলে আমরা যে গণিত অলিম্পিয়াডের অনুষ্ঠানে শিশু-কিশোরদের বলি, মুখস্থকে ‘না’ বলো!
প্রথমে ‘গণিত জানে টিয়া পাখিও’ খবরটা বলে নিই। প্রথম আলোর শেষ পাতায় ৫ মার্চ ২০২০ এএফপি পরিবেশিত খবরে বলা হয়েছে, নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বের করেছেন, টিয়া পাখি কেবল মুখস্থ করতে জানে না, তারা গণিতও জানে। বিচার-বিশ্লেষণ করার গাণিতিক দক্ষতা আছে তাদের। গবেষকেরা টিয়া পাখির সামনে কালো খাম আর লাল খাম রাখলেন। টিয়া কালো খাম তুললেই পুরস্কার পায় খাবার। এরপর দেখা গেল, সে শুধু কালো খামই তোলে।
কিন্তু তারা শুধু খামের রং দেখে, তা-ই নয়, মানুষগুলোকেও দেখে। যে মানুষ টিয়া পাখিকে বেশি আদর করে, খাবার দেয়, তার হাতের পাত্র থেকে তারা খাম তুলে প্রমাণ করেছে, তোতা পাখির বিদ্যা কেবল মুখস্থবিদ্যা নয়, আছে বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতাও।
এই খবরে বলা হয়েছে, গবেষকদের একজন বলেছেন, গবেষণার ফলে তাঁরা বিস্মিত হননি। কারণ, তাঁরা আগে থেকেই জানতেন, টিয়া পাখি যথেষ্ট বুদ্ধিমান। তবে টিয়া পাখি গণিত জানে, এটা তাঁদের কাছে নতুন আবিষ্কৃত তথ্য। এর আগে জানা গিয়েছিল, শিম্পাঞ্জি গণিত জানে।
জানি না, গবেষকেরা জানা জিনিস নিয়ে গবেষণা করে নতুন তথ্য কী পান। নিশ্চয়ই পান। না হলে কেন গবেষণা করেন। আমাদের বিখ্যাত উপস্থাপক হানিফ সংকেত ‘ইত্যাদি’তে দেখিয়েছিলেন, এক লোকের শ খানেক গরু আছে। তিনি প্রতিটা গরুর আলাদা নাম দিয়েছেন। খাবার দেওয়ার সময় তিনি গরুর নাম ধরে ডাকেন, অমনি ঠিক ঠিক গরুটা চলে আসে।
কুকুর তো এই কাজ হামেশাই করে। ছোটবেলায় দেখেছি, হাঁসের বাচ্চারা আমার জেঠিমার পেছনে পেছনে হাঁটত; কারণ, তিনি তাদের খাবার দিতেন।
নিউজিল্যান্ডের গবেষক বলেছেন, ‘সব পাখি প্রজাতির মধ্যে টিয়ার ব্যক্তিত্ব অনন্য। যে ছয়টি টিয়া নিয়ে আমরা কাজ করেছি, তাদের প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত পছন্দ ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল।’
তাহলে দেখা যাচ্ছে, তোতা পাখির ব্যক্তিত্বহীনতা নিয়ে, মুখস্থবিদ্যা নিয়ে যে কিংবদন্তি প্রচলিত, তা ঠিক নয়। টিয়া বা তোতারও ব্যক্তিত্ব আছে। স্বাতন্ত্র্য আছে। সম্ভবত মেরুদণ্ডও আছে।
এবার টিয়া বা তোতা পাখি নিয়ে যেসব কৌতুক জানি, তা বলে নিই।
একদিন একটা যাত্রীবাহী হেলিকপ্টারে একটা টিয়া, আরেকজন মানুষ উঠল যাত্রী হিসেবে। আকাশে ওঠার পর টিয়া পাখিটা নানা রকম অসংগতি ও অব্যবস্থা লক্ষ করল। সিটবেল্ট নেই। পাইলটের ওয়্যারলেস সেট কাজ করছে না। ইত্যাদি। তখন টিয়া পাখিটা প্রতিবাদী হয়ে উঠল। ‘এটা হতে পারে না। এই হেলিকপ্টার কি মানুষ চালাচ্ছে, না চালাচ্ছে আজরাইল। এ তো সাক্ষাৎ যমদূত!’
টিয়া পাখিটার প্রতিবাদে ত্যক্ত-বিরক্ত পাইলট ওকে ধরে জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে মারল।
তখন প্রতিবাদ শুরু করল মানুষ যাত্রী।
পাইলট তাকেও ছুড়ে মারল।
পড়ন্ত মানুষটার কানের কাছে গিয়ে টিয়া বলল, ‘তোমার যদি পাখা না থাকে, তাহলে তুমি প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলে কেন?’
প্রায় একই ধরনের আরেকটা কৌতুক।
একটা টিয়া পাখি গাছের মগডালে চুপ করে বসে আছে। নিচে একটা মুরগি সারাক্ষণ ছটফট করছে। নড়াচড়া করছে।
মুরগি বলল, তুমি চুপচাপ বসে থাকো সারাটা দিন। তোমার চলেটা কী করে?
তোতা পাখি বলল, তুমিও চুপচাপ বসে থাকো।
মুরগি চুপটি করে বসে রইল।
একটা শিয়াল এসে মুরগিটাকে খেয়ে ফেলল। তখন টিয়া পাখি বলল, ‘চুপচাপ বসে থাকতে হলে যথেষ্ট ওপরে বসতে হয়।’
একটা পোষা পাখির দোকান।
ক্রেতা: এই হলুদ-গলা টিয়া পাখিটার দাম কত?
বিক্রেতা: এক লাখ টাকা। সে টাইপ করতে জানে।
ক্রেতা: ওই নীল-গলা টিয়া পাখিটার দাম কত?
বিক্রেতা: দুই লাখ টাকা। এই পাখিটা টাইপ করতে জানে, ফোন রিসিভ করে উত্তর দিতে পারে।
ক্রেতা: আর ওই লাল-গলা টিয়া পাখিটা?
বিক্রেতা: ওর দাম দশ লাখ।
ক্রেতা: কেন? ওর কী গুণ?
বিক্রেতা: ওর কোনো গুণ নাই। তবে ওই দুই টিয়া পাখিই একে বস বলে ডাকে।
দেশে যথেষ্ট বাক্স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিদ্যমান। তা না হলে এত কথা হচ্ছে কেন? এত কথা আমরা পড়ছি কেন? টিয়া পাখিরাই যদি যথেষ্ট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হয়ে থাকে, তাহলে আমরা, মানুষেরা কি ব্যক্তিত্বহীন হতে পারি? আমরাও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। আমরাও বাছাই করতে পারি।
টিয়া পাখি, তুমি তো গণিত জানো। তাহলে একটা অঙ্ক কষো। বইমেলায় বই বিক্রি হয়েছে ৮২ কোটি টাকা। এর ১০ ভাগ যদি লেখকদের প্রাপ্য হয়ে থাকে, লেখকেরা কত পাবেন?
৮ কোটি ২ লাখ টাকা।
এ বছর বই বেরিয়েছে ৪ হাজার ৯১৯টি। গত বছর বেরিয়েছিল ৪ হাজার। ১০ বছরে বইমেলায় মোট ১৬ হাজার ৪০০ লেখক তৈরি হয়েছেন এবং বেঁচে আছেন ধরা হলে প্রত্যেক লেখক কত করে রয়্যালটি পাবেন?
টিয়া পাখি: ৫ হাজার টাকা।
পাপিয়া নামের একজন নেত্রী নমিনেশন লাভের আশায় খরচ করেন ১০ কোটি টাকা, নমিনেশন পান না। তাহলে ১৬ হাজার লেখকের মোট বই থেকে আয় বেশি, নাকি পাপিয়ার একার আয় বেশি?
টিয়া পাখি: এটা নিউজিল্যান্ডের টিয়াকে জিজ্ঞেস করো। আমাকে না। আমি এমসিকিউ পদ্ধতিতে পড়েছি। টিক দিতে পারি। আর সৃজনশীলে আমাদের এই অঙ্ক শেখানো হয় নাই।
রবীন্দ্রনাথের ‘তোতাকাহিনী’ আমাদের অনেকেরই পড়া। রবীন্দ্রনাথের ‘দুই পাখি’ কবিতা থেকে উদ্ধৃতি:
দুজনে কেহ কারে বুঝিতে নাহি পারে,
বুঝাতে নারে আপনায়।
দুজনে একা একা ঝাপটি মরে পাখা,
কাতরে কহে, ‘কাছে আয়!’
বনের পাখি বলে—না,
কবে খাঁচার রুধি দিবে দ্বার।
খাঁচার পাখি বলে—হায়,
মোর শকতি নাহি উড়িবার।
গান হিসেবে এটা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। শেষ লাইনটা আমাদের বুকে শেলের মতো বাজতে থাকে, ‘হায়, মোর শকতি নাহি উড়িবার।’
পুনশ্চ: টিয়া পাখিকে কেন খাঁচায় পুরে রাখা হয়? কারণ, সে কথা বলতে পারে।
আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক