ইউরোপজুড়ে এখন ছুটি। ক্রিসমাস শেষ, নববর্ষ আসছে। বছরের এই সময়ে অনেকেই বাড়িতে আর বন্ধুদের সঙ্গে কাটিয়ে থাকেন। লন্ডনে আমাদের বাগানের দেখাশোনা করে রন। ছুটি কেমন করে কাটাবে জানতে চাইলে রন বলল, আগামী দুই সপ্তাহ অনলাইনে জাপানি বাগান বানানোর কোর্স করবে। গ্রাহকেরা অনেকেই নাকি জাপানির জেন ঘরানার বাগান করতে চাইছেন। ছোট ছোট পাথর, নুড়ি আর বনসাইয়ের সুবিন্যস্ত সমন্বয় হলো ‘জেন গার্ডেন’। গত বছরের বিধিনিষেধেও আমাদের পাড়ার মাছ বিক্রেতা, পর্তুগিজ রিকার্ডোকেও দেখেছি মাছ আর ভাত দিয়ে তৈরি জাপানি খাবার সুসি তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়ে লন্ডনের জাপানি রেস্তোরাঁয় কাজ নিতে।
ছুটির আগে অফিসে কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। অনেকেই বলল, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো ছাড়াও অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের কোর্স করবে। চিকিৎসা, বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, গবেষণা, আইন বা প্রযুক্তি নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের সবাইকেই নিয়মিত, নিয়ম করে নতুন জিনিস শিখতে হয়, পুরোনো জিনিস ভুলে যেতে হয়। কাজের প্রয়োজনে। এটাই প্রচলিত ধারণা। আসলে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির অধিকাংশ পেশায়, সব স্তরের সবার জন্যই নিয়মিতভাবে নতুন জিনিস শেখার কোনো বিকল্প নেই। যেকোনো পেশায় এগিয়ে যেতে হলে, এমনকি টিকে থাকতে হলেও পুরোনো কিছু জিনিস ভুলে যেতে হবে, নতুন শিখতে হবে। আজ না হলেও ভবিষ্যতে পৃথিবীর সব দেশে, সব পেশায় এটি প্রযোজ্য হবে।
কেউ এগিয়ে না এলেও নিজ উদ্যোগে শিখতে শুরু করুন। দূরত্ব কোনো সমস্যা নয়, হাত বাড়ালেই প্রযুক্তির কল্যাণে যেকোনো বিষয়ে, যেকোনো কিছু আপনি শিখতে পারবেন। দরকার শুধু আপনার ইচ্ছা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অবিশ্বাস্য দ্রুততায় এগিয়ে চলছে। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও জানা তথ্যগুলো প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। যেমন ধরুন, আশির দশকে ডিমকে স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে ধরা হতো না। ১৯৮৪ সালে টাইম ম্যাগাজিনে কোলেস্টেরলের সঙ্গে ডিমের সম্পর্ক নিয়ে একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। ২০১৪ সালে, একই পত্রিকার প্রচ্ছদে বলা হলো ‘ডিম সম্পর্কে আমাদের আগের ধারণা ভুল। ডিম স্বাস্থ্যকর খাবার’। রসায়নের একটি উদাহরণ ধরুন। ১৯৭০ সালে পর্যায় সারণিতে মৌলের সংখ্যা ছিল ১১০। এটাই স্কুল-কলেজে পড়ানো হতো। এখন আমরা জানি মৌলের সংখ্যা ১১৮।
ওষুধবিজ্ঞানে হাফ-লাইফ বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। কোনো ওষুধের ক্রিয়া অর্ধেকে নেমে আসতে যে সময়ের প্রয়োজন, তাকে হাফ-লাইফ বলা হয়। স্যামুয়েল আরবসমান নামের এক বিজ্ঞানী হাফ-লাইফ অব ফ্যাক্টস বইয়ে বলেছেন, আমাদের জানা প্রতিটি তথ্যের একটা মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ আছে। গবেষণা বলছে, প্রতি ১০ বছরে, অঙ্ক বা অর্থনীতির মতো শাস্ত্রে আমাদের জানা অর্ধেক তত্ত্ব বা তথ্যের পরিবর্তন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন হয়। পদার্থবিজ্ঞানে এ সময় ১৩ বছর। মনোবিজ্ঞান ও ইতিহাসে এ সময় গড়ে সাত বছর। আমাদের এই শতাব্দী আসলে বর্জনের মাধ্যমে অর্জনের।
প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হিমশিম খাচ্ছে। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ পত্রিকার সাম্প্রতিক এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা যা শিখে আসছে, মাত্র পাঁচ বছরেই পুরোনো হয়ে যাচ্ছে।
দেড় যুগ আগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বিলাতে আমি পিএইচডি করেছিলাম। আমার পিএইচডি সুপারভাইজার তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বিলাতের অন্যতম এক বিজ্ঞানী। আমার গবেষণালব্ধ কাজও একাধিক পুরস্কার এবং গবেষণা বরাদ্দ পেয়েছে। এত কিছুর পরও আমার জ্ঞানের ভান্ডার হালনাগাদ রাখার জন্য প্রতিনিয়ত পড়াশোনা করতে হয়। প্রায় দুই যুগ ধরে, ইউরোপ-আমেরিকার নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় মেধাবীদের সঙ্গে কাজ করছি। অনেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে জগদ্বিখ্যাত। তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক রিচার্ড ওয়াইজ। লন্ডনের খ্যাতনামা ইম্পিরিয়াল কলেজের নিউরোলজির নামকরা অধ্যাপক। দিনের পর দিন রিচার্ডকে দেখেছি পাঁচটার পরে ঘরের দরজা বন্ধ করে পড়াশোনা করতে।
ড. অ্যান্ড্রু ব্ল্যাক। নিজ হাতে হাজার কোটি টাকার ওষুধপ্রযুক্তি এবং গবেষণাবিষয়ক পরামর্শক কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বছরের পর বছর ধরে অ্যান্ড্রুকে দেখেছি নতুন জিনিস শিখতে। কাজের তাগিদে মাসের পর মাস অ্যান্ড্রুর সঙ্গে লন্ডন থেকে ট্রেনে করে ব্রাসেলসে যেতাম। কাজ শেষে, ফেরার সময় ট্রেনে সামনের টেবিলে বসে রেড ওয়াইন নিয়ে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অ্যান্ড্রু পড়ে যেত।
কী ভাবছেন, আপনি ব্যস্ত। নতুন কিছু শেখার সময় নেই। আপনি পেশাগত জীবনে অনেক ওপরে উঠে গেছেন। নতুন নতুন কিছু শেখার প্রয়োজন নেই। গবেষণা বলছে, আপনি হয়তো ভুল।
মাইকেল সাইমনস। লেখক ও গবেষক। দীর্ঘ সময় ধরে মাইকেল বিভিন্ন ক্ষেত্রে অত্যন্ত সফল ব্যক্তিদের দৈনন্দিন জীবন নিয়ে গবেষণা করেছেন। মাইকেল দেখেছেন বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেট, জ্যাক মা আর ইলন মাস্কের মতো ব্যক্তিরা তাঁদের ক্যারিয়ারের পুরো সময় সপ্তাহে অন্তত পাঁচ ঘণ্টা নতুন কিছু শেখার জন্য ব্যয় করেছেন। তাঁদের প্রত্যেকেই অন্তত ট্রিলিয়ন ডলার কোম্পানির মালিক। তাঁদের থেকে ব্যস্ত লোক হয়তো পৃথিবীতে কম। মাইকেলের গবেষণা বলছে, পরিবর্তিত এই বিশ্ব পরিস্থিতিতে কাজের জায়গায় উন্নতি করতে হলে এমনকি টিকে থাকতে হলেও শেখার জন্য সপ্তাহে পাঁচ ঘণ্টা বরাদ্দ করতে হবে। অফিসের কাজ করার সময়টা এই পাঁচ ঘণ্টা থেকে আলাদা হতে হবে।
ব্যক্তিগত উদ্যোগের পাশাপাশি এখানে প্রাতিষ্ঠানিক এবং রাষ্ট্রের উদ্যোগও জরুরি। পশ্চিমের কোম্পানিগুলো ইতিমধ্যেই যুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ এবং প্রণোদনা দিতে শুরু করেছে। প্রশিক্ষিত কর্মীদের নিয়োগ দেওয়ার থেকে কর্মরত কর্মীদের নতুন প্রযুক্তিগত শিক্ষা দেওয়াটা কোম্পানির জন্য অনেক লাভজনক। কেউ এগিয়ে না এলেও নিজ উদ্যোগে শিখতে শুরু করুন। দূরত্ব কোনো সমস্যা নয়, হাত বাড়ালেই প্রযুক্তির কল্যাণে যেকোনো বিষয়ে, যেকোনো কিছু আপনি শিখতে পারবেন। দরকার শুধু আপনার ইচ্ছা।
● ড. সুব্রত বোস প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট