কয়েক দিন আগে পত্রিকায় খবরটি পড়ে শিউরে উঠেছিলাম। অনেক বছর আগে বাংলাদেশের এক দরিদ্র দম্পতি ভারতে গিয়েছিলেন জীবিকার সন্ধানে। কাজ খুঁজতে খুঁজতে তাঁদের ঠাঁই হয় রাজস্থানে। রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করতেন তাঁরা। সেখানেই তাঁদের দুটি সন্তান হয়। দুজনই এখন কিশোরবয়সী। তারা কখনো বাংলাদেশ দেখেনি। বাংলাদেশে যে তাদের দাদুবাড়ি, তারা সেই গল্প শোনে। রাজস্থানের মরুভূমিতে বসে বাংলাদেশের গ্রামের কথা তাদের কাছে রূপকথার মতো মনে হয়। তারা মা–বাবার কাছে বায়না ধরল দাদুবাড়ি দেখবে। মা–বাবাও রাজি হলেন। দুই সন্তানকে নিয়ে তাঁরা পাড়ি জমালেন বাংলাদেশের পথে।
কীভাবে আসবেন? মা, বাবা, দুই সন্তান—কারোরই পাসপোর্ট–ভিসা নেই। বাবা সীমান্তে এসে দালাল ধরলেন। ৩০ হাজার টাকায় রফা হলো। সীমান্তরক্ষীর চোখ এড়িয়ে দালাল তাঁদের নদী পার করে দেবেন। রাতের অন্ধকারে নদী পার হতে হবে। নদী ছিল খরস্রোতা। মায়ের হাত ধরে দুই সন্তান নদী পার হচ্ছিল। বাবার মাথায় বাক্সপেটরা। তারা যখন মাঝনদীতে, তখন বিএসএফ টের পায়, কেউ নদী সাঁতরাচ্ছে। এরপর বিএসএফ সদস্যরা ফাঁকা গুলি ছুড়লে দালালরা চিৎকার করে দ্রুত নদী পার হতে বলেন। কিন্তু মা নদীর মাঝামাঝি আসতেই বুঝতে পারেন, তাঁর হাতে ধরা দুই সন্তান আর তাঁর সঙ্গে নেই। ভেসে গেছে। পরে অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানা গেল, দুই সন্তানের লাশ নদীর ওপারে ভেসে উঠেছে। বিএসএফের হেফাজতে আছে।
মা–বাবার আর সন্তানদের দাদুবাড়ি দেখানো হলো না। তাঁরা এখন অন্য বাড়ির বাসিন্দা। মা–বাবা যেখানেই থাকুন, সন্তানদের আর ফিরে পাবেন না। সন্তানের শূন্যতা নিয়েই বাকি জীবন কাটাতে হবে। এই সীমান্তপথেই কিশোরী ফেলানি দেশে ফিরতে গিয়ে বিএসএফের গুলিতে মারা গিয়েছিল।
প্রতিদিন এ রকম অসংখ্য মৃত্যুর খবর আমরা পত্রিকায় পড়ি। টেলিভিশনে দেখি। সব খবর গণমাধ্যমে আসেও না। ওপরের তিনটি ঘটনায় যে চারজন মানুষ মারা গেল, তাদের কেউ কিশোর বয়সী, কেউ তরুণ। আবার কেউ নতুন জীবন শুরু না করতেই যবনিকা টানলেন। এই সব অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু দেখে তারাশঙ্করের ‘কবি’ উপন্যাসের সেই বিখ্যাত উক্তির কথাই মনে পড়ে—‘হায়! জীবন এত ছোট কেনে?
২.
আরেকটি মর্মান্তিক খবর। স্বামীকে ভিডিওতে রেখে স্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন। পত্রিকার খবরে জানা যায়, সুনামগঞ্জ শহরে স্বামীকে ভিডিও কলে রেখে আত্মহত্যা করেছেন মাহফুজা সাজনা নামের এক নারী। তাঁর স্বামী আমির হোসেন দিরাই থানার উপপরিদর্শক। বৃহস্পতিবার সকালে মাহফুজা তাঁকে ভিডিও কল দেন। এ সময় ফ্যানের সঙ্গে বাঁধা দড়ি দেখিয়ে বলেন, তিনি আত্মহত্যা করছেন। আমির হোসেন কল কেটে দিয়ে তখনই বিষয়টি বাড়ির মালিককে জানান। বাড়ির মালিক দরজা ভাঙার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে পুলিশকে খবর দিলে তারা এসে দরজা ভেঙে দেখতে পান, ফ্যানের সঙ্গে লাশ ঝুলছে। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, এএসআই আমির হোসেন জামালগঞ্জ থানায় থাকতে কলেজপড়ুয়া মাহফুজার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরে আমির হোসেন তাঁকে বিয়ে করেন। এটি তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে। আমির হোসেনের প্রথম স্ত্রী এই বিয়ে মানতে পারেননি। প্রথম স্ত্রী তাঁকে প্রায়ই বকাবকি করতেন। এ কারণেই কি মাহফুজা আত্মহত্যা করেছেন? মাত্র ২৪ বছর বয়সে একটি জীবন সাঙ্গ হলো।
প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করা বেআইনি—এটা নিশ্চয়ই পুলিশ কর্মকর্তার অজানা নয়। কয়েক মাস আগে ঢাকার এক ব্যবসায়ী লাইভে এসে আত্মহত্যা করেছিলেন নিজের কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে। সেটি স্বেচ্ছামৃত্যু হলেও মাহফুজার মৃত্যুকে স্বেচ্ছামৃত্যু বলা যাবে না। একজন নারী কোন পরিস্থিতিতে পড়লে স্বামীকে ভিডিও কলে রেখে আত্মহত্যা করেন!
৩.
ভাড়া নিয়ে যাত্রী ও বাসের কর্মীদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়াঝাটি হয়ে থাকে। সামান্য কথা–কাটাকাটি থেকে তুলকালাম কাণ্ডও ঘটে। তা–ই বলে যাত্রীকে চলন্ত বাস থেকে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলতে হবে! দেশে আইনকানুন বলে কিছু নেই? প্রথম আলোর গাজীপুর প্রতিনিধির পাঠানো খবর থেকে জানা যায়, ভাড়া নিয়ে তাক্ওয়া পরিবহনের দুই কর্মীর সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন মো. সায়েম নামের এক তরুণ। এরই জেরে বাসের কর্মীরা চলন্ত বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে তিনি সেই বাসের নিচে পিষ্ট হয়ে মারা যান। গত বৃহস্পতিবার দুপুর পৌনে ১২টায় জয়দেবপুর-চান্দনা চৌরাস্তা সড়কের শবিবাড়ি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
২০ বছর বয়সী সায়েম গাজীপুরের একটি ওয়ার্কশপে কাজ করতেন। দিনদুপুরে ওই বাসে নিশ্চয়ই আরও অনেক যাত্রী ছিলেন। কেউ এই হত্যাকাণ্ড থামাতে এগিয়ে এলেন না! মানুষ এতটাই অসংবেদনশীল হয়ে পড়েছে। কোনো কিছুই আর তাদের স্পর্শ করে না।
অনেক সময় যাত্রীরা ভাড়া নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন। নির্ধারিত ভাড়া দিতেও্ গড়িমসি করেন। তা–ই বলে বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে হবে?
এখন বেশির ভাগ বাস চলে চুক্তি ভিত্তিতে। বাস কতজন যাত্রী নিল, কতটা ট্রিপ দিল—সেসব মালিকের দেখার বিষয় নয়। দিন শেষে চুক্তি অনুযায়ী টাকা তাঁকে দিতেই হবে। বাসের কর্মীরা যত বেশি ট্রিপ দিতে পারবেন, যত বেশি যাত্রী নিতে পারবেন, ততই লাভ। কেউ ভাড়া কম দিতে চাইলে তাঁদের মেজাজ গরম হয়ে যায়। তা–ই বলে চলন্ত বাস থেকে ফেলে দিয়ে মানুষ হত্যা!
সায়েম একটি ওয়ার্কশপে কাজ করতেন। তিনি হয়তো মাসের বেতন ও বোনাস পেয়ে মা–বাবার হাতে তুলে দিতেন। কিংবা নিজের শখের কিছু কিনতেন সেই টাকা দিয়ে। কিন্তু বাসের কর্মীরা তার আগেই তাঁর প্রাণ কেড়ে নিলেন। মা–বাবা সন্তানকে ফেরত পেলেন না। ফেরত পেলেন সন্তানের লাশ। সড়কে নামলেই মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। অঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে। কিন্তু সায়েম তো দুর্ঘটনার শিকার হননি। তাঁকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
ওই ঘটনায় দুই বাসকর্মীকে পুলিশ আটক করেছে। বাসচালক পালিয়েছেন। তিনিও হয়তো ধরা পড়বেন। কিন্তু পরিবহন খাতে যে সীমাহীন নৈরাজ্য চলছে, তা বন্ধ হবে না। নিরাপদ সড়কের দাবিতে এত আন্দোলন হলো, এত আইন হলো, কিন্তু সড়ক আরও অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। যাঁরা আইন করেন, তাঁরাই আইন মানেন না।
প্রতিদিন এ রকম অসংখ্য মৃত্যুর খবর আমরা পত্রিকায় পড়ি। টেলিভিশনে দেখি। সব খবর গণমাধ্যমে আসেও না। ওপরের তিনটি ঘটনায় যে চারজন মানুষ মারা গেল, তাদের কেউ কিশোর বয়সী, কেউ তরুণ। আবার কেউ নতুন জীবন শুরু না করতেই যবনিকা টানলেন। এই সব অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু দেখে তারাশঙ্করের ‘কবি’ উপন্যাসের সেই বিখ্যাত উক্তির কথাই মনে পড়ে—‘হায়! জীবন এত ছোট কেনে?’
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি