চীন ও রাশিয়া বেশ ঘটা করেই পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন শীতকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বেইজিং সফর করছেন। খেলা দেখার সঙ্গে কূটনীতিটাও হয়ে গেল জম্পেশ। ইউক্রেন নিয়ে পশ্চিমাদের টানাপোড়েনের মধ্যে পুতিন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে হাতে হাত রেখে বৈঠক করলেন। রাশিয়া ও চীনের পরস্পরের সমর্থনের ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রকে আরও বেকায়দায় ফেলবে।
নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রকে নীতি ও কৌশল অবলম্বন করতে হবে। যদিও ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান থেকে সরে আসার সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে; আবারও পুরোনো পথে ফিরে যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়া ও চীনের যৌথ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে একটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে, ইসলামপন্থীদের সঙ্গে আমেরিকানরা আবারও সম্পর্ক গড়ে তুলবে কি না। যাদের সন্ত্রাসী-জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা, আবার তাদের সঙ্গেই গাঁটছড়া বাধা লাগতে পারে। এ সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না; বরং এটি এখন খুবই প্রবল। ইসলামপন্থীদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রতার চিন্তাভাবনা অনেকের কাছেই আজগুবি মনে হতে পারে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ইসলামপন্থীদের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বিকল্প নেই।
যুক্তরাষ্ট্র মূলত দুটি ফ্রন্টে এখন কাজ করছে। একদিকে রাশিয়াকে নিজের সীমার মধ্যে বেঁধে ফেলা, অন্যদিকে চীনের প্রভাব সংকুচিত করা। পূর্ব ইউরোপ দিয়ে রাশিয়াকে আটকানোর নানা চেষ্টাই যুক্তরাষ্ট্র করছে। বেলারুশ ও ইউক্রেনে কয়েকবারই যুদ্ধ বাধানোর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ইউরোপের অনিচ্ছা ও নির্লিপ্ততার কারণে এটা এখনো সম্ভব হয়নি। ইউরোপ, বিশেষ করে জার্মানি ও ফ্রান্স নতুন করে কোনো যুদ্ধে যেতে আগ্রহী না বলেই মনে হচ্ছে। নিতান্তই বাধ্য না হলে ব্রিটেন বাদে ইউরোপের অন্যান্য দেশ নতুন কোনো যুদ্ধে নাও যেতে পারে।
অর্থনৈতিক মন্দার পর করোনা অতিমারির ধাক্কা সামলাতেই ইউরোপ এখন ব্যস্ত। তাদের অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করতে হবে। এ ছাড়া রাশিয়ার ওপর ইউরোপের জ্বালানি, মূলত গ্যাসের নির্ভরতা আছে। বিকল্প জ্বালানি উৎস নিশ্চিত না করে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করা ইউরোপের দেশগুলোর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হবে। আর ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ত্যাগের পর জার্মান ও ফরাসিরা নিজেদের মতো করে ইউরোপের রাজনীতি সাজাতে চাইছে। সম্প্রতি জার্মানিতে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। সরকারে যুদ্ধবিরোধী সবুজ দলের শরিকানা আছে। এ কারণে জার্মানিতে সরকারের ভেতর থেকেই বাধা আসবে। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে ইউরোপ আর আগের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অনুগামী হবে না বলেই মনে হচ্ছে।
ব্রিটেন থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। কিন্তু এর বাইরেও ফ্রান্স, ইতালি ও জার্মানি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী মিত্র। ইরাক, সিরিয়া ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনের সামরিক উপস্থিতি বৃহৎ আকারে থাকলেও এর নৈতিক ভিত্তি তৈরিতে কাজ করেছে জার্মানি, ফ্রান্সসহ অন্য দেশগুলো। পুরো ইউরোপের সমর্থন না পেলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নতুন কোনো যুদ্ধে জড়ানো কঠিন হবে।
এ অবস্থায় রাশিয়া ও চীনকে ঘায়েল করতে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে দুটি অস্ত্র আছে। একটি হচ্ছে ইসলামপন্থীদের সঙ্গে পুরোনো মিত্রতা আবার ফিরিয়ে আনা। এর সূচনা হয়েছে তালেবানের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করার মাধ্যমে। মূলত রাশিয়া ও চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব লক্ষ্য করেই যুক্তরাষ্ট্র পুরোনো মিত্র তালেবানের সঙ্গে আলাপ শুরু করেছিল। তালেবানদের সঙ্গে বছর দুয়েক আগে হুট করেই যুক্তরাষ্ট্রের আলাপ-আলোচনা শুরু করে। অনেকেই এর কারণ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তালেবানদের সঙ্গে সম্পর্কের পুনঃস্থাপন মূলত আবার বিশ্বরাজনীতিকে গত শতকের আশি বা সত্তরের দশকে ফিরিয়ে আনছে। ওই সময় সোভিয়েত রাশিয়া বা কমিউনিজমের প্রভাব ঠেকাতে তালেবানকে ব্যবহার করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে এমন এক দেশ, যারা পরাজয় নিশ্চিত জেনে শত্রুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেলে। একসময় ইসলামপন্থীদের দিয়ে কমিউনিস্ট ও সেক্যুলারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়েছে। ১৯৯০ সালের বিশ্বরাজনীতির পটপরিবর্তন আবার সেক্যুলার ও ইসলামপন্থীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এখন আবার ইসলামপন্থীদের দিয়েই রাশিয়া-চীনকে ঘায়েল করতে চাইবে।
যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত তালেবানদের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিকে রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চায়। তালেবানের সঙ্গে শান্তিচুক্তি অন্য ইসলামপন্থীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করবে। ইতিমধ্যেই এ ধরনের নানা আভাস পাওয়াও যাচ্ছে। যদিও এখনো পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়নি। তবে ধীরে ধীরে এটা পরিষ্কার হতে শুরু করবে। ইসলামপন্থীদের মধ্য এশিয়ার রাশিয়ার বিরুদ্ধে ও বিভিন্ন দেশে চীনের বাণিজ্য ও স্থাপনার বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে। ইতিমধ্যেই রাশিয়া কাজাখস্তানের নিজস্ব রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে। আর কাজাখ সরকার আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসী ও জঙ্গি বলে দোষারোপ করেছে। রাশিয়ান বাহিনী কাজাখস্তানের সমস্যার সাময়িক সমাধান করেছে। কাজাখ জনসাধারণের ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি; বরং বেড়েছে। একই অবস্থা মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও। বিভিন্ন দেশের কর্তৃত্ববাদী সরকারের সঙ্গে রাশিয়া, চীনের সখ্য রয়েছে। এসব সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ রয়েছে। জনসাধারণের মধ্যে বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষোভ বিরাজ করছে।
ফলে দেখা যাচ্ছে, রাজনীতির মাঠ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রস্তুত। এখন কেবল আন্দোলনকারীদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে মাঠে নামিয়ে দেওয়া। আর উইঘুরে চীনের নির্যাতন ও দমন তো চলছেই। বিক্ষুব্ধ জনতার মধ্যে ইসলামপন্থীদের একটু জায়গা দিলেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তাদের মনোভাব ঘুরে যেতে পারে। যাদের বিরুদ্ধে এত দিন যুদ্ধ করল, তাদের দিয়েই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করবে যুক্তরাষ্ট্র।
ইসলামপন্থীদের দিয়ে চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করে রাশিয়া চীনের কাছ থেকে সরিয়ে আনতে চাইবে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এ রকম সফট পাওয়ারের ব্যবহার আরও করবে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এই নীতির কারণে বিশেষ করে চীনের দিকে ঝুঁকে থাকা মুসলিম দেশগুলো নতুন করে বিপদে পড়তে পারে। একদিকে তাদের ওপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে; পাশাপাশি ইসলামপন্থীর নতুন করে উত্থান ঘটতে পারে। এরা পুরোপুরিই তালেবান, আইএস, বোকো হারাম ও আল শাবাবের থেকে পৃথক হবে। নতুন এই গোষ্ঠী কেবল অস্ত্রই ধারণ করবে না; বরং এরা অস্ত্র ও জ্ঞান—দুটোরই প্রয়োগ করবে। নতুন রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলবে। রাজনীতি, অর্থনীতি ও জ্ঞানের জগতে এদের শক্তিশালী অবস্থান থাকতে পারে। বর্তমান তালেবান নেতৃত্বের প্রতি খেয়াল করলেই এ বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট হবে। মোল্লা ওমরের তালেবানের সঙ্গে বর্তমান তালেবানের বিস্তর পার্থক্য আছে। নতুন ধরনের ইসলামপন্থীদের পাশাপাশি মধ্যপন্থীদেরও উত্থান ঘটতে পারে। মধ্যপন্থীদের নেতা হতে পারে সৌদি আরব। যুক্তরাষ্ট্র কট্টর ও মধ্যপন্থী, উভয় গোষ্ঠীকেই হাতে রাখতে চাইবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাদের কোনো চিরস্থায়ী মিত্র বা শত্রু নেই। যুক্তরাষ্ট্র সবার সঙ্গেই কাজ করে। যুক্তরাষ্ট্র মিসরের আনোয়ার সাদাতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিল। ব্রাদারহুডের সঙ্গে কাজ করেছে। আবার হোসনে মোবারককেও সমর্থন দিয়েছে। তারা ইরাকে সাদ্দাম হোসেনকে আশকারা দিয়েছে। পরে সাদ্দামকে হত্যা করেছে। দেখা যাচ্ছে, যখন যাকে প্রয়োজন, তার সঙ্গেই রাজনীতি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে এমন এক দেশ, যারা পরাজয় নিশ্চিত জেনে শত্রুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেলে। একসময় ইসলামপন্থীদের দিয়ে কমিউনিস্ট ও সেক্যুলারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়েছে। ১৯৯০ সালের বিশ্বরাজনীতির পটপরিবর্তন আবার সেক্যুলার ও ইসলামপন্থীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এখন আবার ইসলামপন্থীদের দিয়েই রাশিয়া-চীনকে ঘায়েল করতে চাইবে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই শত্রু-মিত্রতার খেলা নতুন কিছু নয়। কিন্তু খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আনোয়ার সাদাত, ব্রাদার হুড, হোসনে মোবারক, সাদ্দাম, বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিত্রতা বা শত্রুতা করে টিকতে পারেনি। তাই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যারা এই শত্রু-মিত্রতার খেলায় লিপ্ত আছে, তাদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। রাশিয়া ও চীনকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র কাউকে ফেলে দিতে কসুর করবে না। কারণ, রাশিয়া-চীনের ঐক্য যুক্তরাষ্ট্রের টিকে থাকার জন্য বড় ধরনের হুমকি।
ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক