ঘুম না এলে ঘুমের বড়ি!
চার-পাঁচ দিন ধরে ঘুমের সমস্যা হচ্ছিল অনিক আহমেদের (ছদ্মনাম)। সারা দিন অফিস করে তাড়াতাড়ি শোয়ার তোড়জোড় করলেও ঘুম শুধু দূর থেকে হাতছানি দিত। আসলে তাঁর অফিসে নানা রকম সমস্যা চলছিল, সেই চাপের প্রভাব পড়ল ঘুমে। এক সহকর্মীর পরামর্শে তিনি ঘুমের ওষুধ খাওয়া শুরু করলেন। এক বছর পর দেখা গেল যে শুধু ঘুমের ওষুধ নয়, গাঁজা-ইয়াবা খাওয়াও শুরু হয়ে যায়…ঘুম না আসা তাঁকে আসক্তির পথে নিয়ে যায়।
আমরা নিজেদের স্বার্থে ঘুম না আসার নানা কারণ দাঁড় করিয়ে নিই। ঘুম না আসার জন্য নিজেরাই কোনো না কোনোভাবে দায়ী। এই শহুরে জীবনের গ্যাঁড়াকলে পড়ে চারপাশের বিভিন্ন চাপে এতই ব্যতিব্যস্ত থাকি, নিজেকে নিয়ে কেউ ভাবি না। সারা দিনের কাজ শেষে রাতে নির্ভার ঘুম আসছে না, অমনি নাগালের মধ্যে থাকা একটা ঘুমের বড়ি টুক করে খেয়ে নিই আমরা অনেকে। মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত, বিষণ্ন, কোনো কারণে দুশ্চিন্তা বা শারীরিক কোনো সমস্যা, বিশেষ করে হরমোনজনিত রোগের ক্ষেত্রে সাধারণত ঘুমের সমস্যা হয়ে থাকে। শরীর ও মনের মধ্যে থাকা চাপা চাপগুলো সরিয়ে ফেলতে না পেরে দিনের পর দিন ঘুমের ওষুধের দ্বারস্থ হন অনেকে। অজান্তে কখন এই অভ্যাস আসক্তিতে রূপ নেয় বোঝাই যায় না। অনেকে ভাবেন, ঘুমের ওষুধই তো খেয়েছি, নেশা তো করিনি। এই ভুল ধারণা ডেকে আনে বিপত্তি।
ঘুমের সমস্যা, ঘুমের ওষুধ নগরজীবনের সঙ্গে লেপটে আছে। সকালে ফুরফুরে মেজাজে উঠতে দরকার একটা আরামের ঘুম। সে জন্য ছোট্ট একটি লাল, নীল বা সাদা রঙের ওষুধের দিকে ঝুঁকে পড়ি আমরা। এভাবেই শরীর একসময় ঘুমের ওষুধে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন ওষুধ না খেলে ঘুম আসতে চায় না। অযথা ঘুম নিয়ে ভয়ে ভীত হয়ে খেয়ে ফেলেন ঘুমের ওষুধ। নিয়ম থাকা সত্ত্বেও অনেক ওষুধ বিক্রেতাই চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই ঘুমের ওষুধ বিক্রি করেন, যা আমাদের দেশে বেশ সহজলভ্য। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ারও দরকার মনে করি না, নিজেরাই অন্যের মুখে শুনে বা দোকানে গিয়ে ওষুধ কিনে আনি। সবচেয়ে শঙ্কিত হওয়ার কথা হলো এই যে, গত কয়েক বছরে গাঁজা, ইয়াবার পাশাপাশি ঘুমের ওষুধ খাওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। ঘুমের ওষুধ অজান্তেই জন্ম দিয়েছে নেশাতুর মানুষের।
গত ডিসেম্বরে কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন-নবম ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন সাইকিয়াট্রি ২০১৭-অ্যাডিকশন সাইকিয়াট্রি সেমিনারে একটি গবেষণাপত্র তুলে ধরেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাইকোথেরাপি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মোহিত কামাল। তাঁর সঙ্গে সহকারী হিসেবে ছিলেন একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফারজানা রহমান। ২০১৩ সালের মে থেকে ২০১৬ সালের মে পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও নিরাময় কেন্দ্রে যাঁরা মাদকাসক্তির চিকিৎসা নিতে যান, এমন ৩০৬ জনের মধ্যে চালানো হয়েছিল এই গবেষণা।
গবেষণা থেকে বেরিয়ে আসে, নগরজীবনের মানুষের ঘুমের ওষুধের প্রতি আসক্তি বেশি। সেই হার ৭৮ দশমিক ১ শতাংশ। আর গ্রামীণ মানুষের মধ্যে এই হার ২১ দশমিক ৯ শতাংশ। আরও একটি আশঙ্কার বিষয় হলো, তরুণদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা করছেন এমন তরুণদের মধ্যে ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ, এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়ে ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ, এমনকি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের ১৪ দশমিক ১ শতাংশ এই আসক্তিতে জড়িয়ে পড়েছে।
কর্মজীবী ও কর্মহীন মানুষের মধ্যেও ঘুমের ওষুধে আসক্ত হওয়ার হার নেহাত কম নয়। ঢাকা, গাজীপুর ও আশপাশের এলাকায় এই প্রবণতা বেশি, তেমনটাই উঠে আসে এই গবেষণায়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মজীবী ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ, ব্যবসায়ী ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ, বেকার ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ আসক্ত ঘুমের ওষুধে।
অনিক আহমেদের ঘুম না আসার কারণ ছিল কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ। এর বাইরেও অনেক কারণ আছে। যেমন এই গবেষণায় দেখা যায়, ঘুমের ওষুধের প্রতি আসক্তির কারণ হতাশা, সম্পর্ক নিয়ে সমস্যা, রাগ বা আক্রমণাত্মক আচরণ, খারাপ সঙ্গ, পারিবারিক কোন্দল, অনৈতিক সম্পর্ক, সম্পর্ক ভাঙা বা বিবাহবিচ্ছেদ এবং ওষুধের প্রতি নির্ভরতা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব কারণে ঘুমের ওষুধ সেবনকারীর সংখ্যা বাড়ছে। ৫০ শতাংশ অবিবাহিত, ৪৫ শতাংশ বিবাহিত এবং বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে এমন ৫ শতাংশ মানুষের মধ্যে ঘুমের ওষুধের প্রতি আসক্তি দেখা গেছে।
গবেষণার ফলাফল দেখলে ঘুমের ওষুধকে আর হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ থাকছে না। লেখক-কবি-সাহিত্যিকেরা তাঁদের লেখায় যতই শৈল্পিকভাবে নির্ঘুম রাতকে ফুটিয়ে তুলুন না কেন, নিত্যদিনকার জীবনে নির্ঘুম রাত অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়।
নির্ঘুম রাত ঘুমের ওষুধের দিকে আকর্ষণ করে। জীবনযাপনে কিছু পরিবর্তন আনা গেলে ঘুমের ওষুধের প্রতি নির্ভরতা ধীরে ধীরে কমানো সম্ভব। যাঁদের ঘুমের সমস্যা গুরুতর হয়নি, তাঁদের জীবনযাপনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা জরুরি। যেমন রাতে নির্দিষ্ট একটি সময়ে ঘুমানো, সন্ধ্যার পর চা বা কফি পান না করা, শুতে যাওয়ার আগে উত্তেজক কিছু না দেখা, টিভি বা মুঠোফোনে চোখ না রাখা, ভোরে ওঠার অভ্যাস, ইয়োগা ও মেডিটেশন করা, হাঁটা বা কোনো শারীরিক ব্যায়াম-সাধারণভাবে এগুলো মানলে ঘুম আসবে।
সম্পর্ক বা পারিবারিক সমস্যা বা কোনো বিষয়ে চাপ, হতাশা থেকে বের হওয়ার উপায় হিসেবে ঘুমের ওষুধ খাওয়া চরম বোকামি। তাতে কোনো সমস্যার সমাধান তো হবেই না, উল্টো সমস্যা গেড়ে বসবে। নিজের ও চারপাশ থেকে ভালোর রস আস্বাদন করুন, দেখবেন জীবনটা অত খারাপ মনে হচ্ছে না। ছেঁড়া কাঁথা গায়ে দিয়েও জীবনকে সুন্দর মনে হবে। তবু না হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। খেয়াল-খুশি ও ইচ্ছামতো ঘুমের ওষুধ খাওয়া উচিত নয়।
আট ঘণ্টার ঘুমের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে সাফল্যের সূত্র। শান্তির ঘুম মনে শান্তি আনে।
তৌহিদা শিরোপা: সাংবাদিক।