ডুবন্ত জাহাজে থাকলে মানুষ খড়কুটো ধরেও বাঁচতে চায়। আমাদের নাগরিক সমাজের অবস্থা তার চেয়ে ভালো বলা যাবে না। অনেক বিষয়ে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সুপরামর্শ দেওয়া হয়, অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানো হয়। কিন্তু রাষ্ট্রের যাঁরা মালিক–মোক্তার, তাঁরা পাত্তা দেন না। আবার বিরোধী দলে থাকলে এই রাজনীতিকেরাই নাগরিক সমাজের কাছে ধরনা দেন। এই স্ববিরোধিতা আমাদের রাজনীতির দুরারোগ্য ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।
গত সেপ্টেম্বর মাসে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন পেতে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন ৫৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক। তাঁদের বক্তব্য ছিল: বিগত দুই নির্বাচন কমিশনের ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ আচরণের কারণে নির্বাচনী ব্যবস্থায় মানুষের আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। নির্বাচনী ব্যবস্থায় মানুষের আস্থা ফেরাতে নির্বাচন কমিশন এমনভাবে পুনর্গঠন করতে হবে, যেটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।
কেবল নাগরিক সমাজ নয়, বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলও আইন করে নতুন নির্বাচন কমিশনের দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, এত কম সময়ে আইন করা সম্ভব নয়। সার্চ কমিটির মাধ্যমেই নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। এরই ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রপতি ২০ ডিসেম্বর থেকে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনাও শুরু করেছেন। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন প্রক্রিয়াটিও বেশ জটিল। যারা ইতিমধ্যে নিবন্ধিত হয়েছে, তাদের চেয়ে অনেক সক্রিয় ও জনসমর্থনপুষ্ট দল আছে। কিন্তু আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণে তারা নিবন্ধন পায়নি। তাদেরও আলোচনায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত।
এই প্রেক্ষাপটে গত বুধবার ৩৭ জন বিশিষ্ট নাগরিক অপর এক বিবৃতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির চলমান সংলাপে দেশে নতুন করে গণতন্ত্রচর্চা, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, জবাবদিহি এবং আইনের সম ও ন্যায্য প্রয়োগসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে জাতীয় ঐকমত্যের প্রত্যাশা করেছেন। তাঁরা বলেছেন, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির আলোচনার উদ্যোগ দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সময়োপযোগী ও জরুরি। এ সংলাপে গণমাধ্যম ও নাগরিক সংগঠনগুলোকে যুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।
বিবৃতিতে নাগরিকেরা আরও বলেন, ‘অর্থনৈতিক উন্নয়নের বেশ কিছু মাপকাঠিতে দেশের প্রশংসনীয় সাফল্য এসেছে। তবে মুদ্রার অপর পিঠ, অর্থাৎ নির্বাচন, জবাবদিহি, আইনের সমপ্রয়োগ, বাক্স্বাধীনতা, সভা-সমিতির অধিকার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও নির্যাতন এবং আনুষঙ্গিক অনেক মাপকাঠিতে আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছি।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে তিন দশক আগের, ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় প্রণীত তিন রাজনৈতিক জোটের রূপরেখায় যে গণতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করা হয়েছিল, অনেক আগেই তা রাজনৈতিক নেতৃত্ব শিকোয় ঝুলিয়ে রেখেছেন। ক্ষমতার হিসাব-নিকাশে এক দল সাবেক স্বৈরাচার ও অপর দল স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। তারপরও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা আশা করছেন, ‘তিন জোটের রূপরেখা’র আদলে একটি ঐকমত্য সৃষ্টি হবে।
বিশিষ্ট নাগরিকদের দুই বিবৃতির ভাষা ও ভঙ্গিতে ফারাক থাকলেও একটি বিষয়ে তাঁরা স্পষ্ট করেছেন যে গণতন্ত্রের জন্য সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য
এবং সেই লক্ষ্যে একটি স্বাধীন ও মেরুদণ্ডধারী নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। নব্বইয়ে এরশাদের পতনের পর যে কটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে, তা ঐকমত্যের ভিত্তিতে হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ১৯৯১, ১৯৯৬ (১২ জুন) ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনের কথা বলা যায়। তাই ২০২৩ সালের নির্বাচনটি সুষ্ঠু ও অবাধ করতে হলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের মতৈক্য থাকতে হবে। কোনো দলকে ক্ষমতায় রাখা বা আনার জন্য এ মতৈক্য নয়। জনগণের ভোটাধিকার রক্ষার মতৈক্য। আর মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশন যে কখনো সরকার বা নির্বাহী বিভাগকে আইন মানতে বাধ্য করতে পারে না, তার প্রমাণ রকিব কমিশন রেখেছে। কে এম হুদা কমিশনও রেখে চলেছে। ভারতের টি এন সেশন কমিশনের মতো কমিশন বাংলাদেশে আসেনি, যার ভয়ে নির্বাহী বিভাগ তটস্থ থাকবে। তবে এ টি এম শামসুল হুদা ও আবু হেনা কমিশন তো আমরা পেয়েছি, যারা প্রবল প্রতিকূল পরিবেশেও একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেশবাসীকে উপহার দিয়েছে।
২.
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট লেখক-ইতিহাসবিদ আকবর আলি খান বাংলাদেশের আর্থরাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছেন তঁার অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি বইয়ে (প্রথমা প্রকাশন, ২০১৭)।
ছয় খণ্ডে বিন্যস্ত বইয়ের চতুর্থ খণ্ডে তিনি আলোচনা করেছেন নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে। লেখার শুরুতে তিনি দুটি উদাহরণ টেনেছেন। একটি মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী, যিনি আইয়ুব আমলে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার ছিলেন। তাঁর এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেক ব্যক্তি বাস করতেন, যাঁরা মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি পছন্দ করতেন না। ফজলুল কাদের চৌধুরী বিষয়টি বুঝতে পেরে এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের গণমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠকে বসে তাঁর উন্নয়নকাজের ফিরিস্তি তুলে ধরেন। এরপর চৌধুরী সাহেব বললেন, এত উন্নয়নকাজ করার পরও কি তিনি তাঁদের কাছ থেকে ভোট আশা করতে পারেন না। বৈঠকে অংশগ্রহণকারী সংখ্যালঘু প্রতিনিধিরা বললেন, ‘হ্যাঁ পারেন।’ জবাবে তিনি বললেন, ‘আমি আপনাদের ভোট পেয়ে গেছি। ভোটের দিন আপনাদের কষ্ট করে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার দরকার নেই।’ সত্যি সত্যি তাঁরা ভোটের দিন কেন্দ্রে যাননি এবং ফজলুল কাদের চৌধুরী বিপুল ভোটে জয়ী হলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশেও অনেক নেতা একই নীতি অনুসরণ করেছেন। তাঁরা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, আপনাদের ভোট পেয়ে গেছি, ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আগে সম্প্রদায়বিশেষের প্রতি এ ফরমান জারি হতো। এখন সম্প্রদায়-নির্বিশেষে দুর্বল জনগোষ্ঠীর ওপর ফরমান জারি করা হয়। সাম্প্রতিক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের হুমকি-ধমকি, হুঁশিয়ারি দেখলেও মনে হয় ভোটের রাজনীতিতে ভোটারদের আমরা অগ্রাহ্য করে চলেছি।
আকবর আলি খান তাঁর বইয়ে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর উদ্ধৃতি দিয়ে আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে গোপালগঞ্জে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ তাঁকে হারানোর জন্য নানা চেষ্টা চালাচ্ছিল। অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে উদ্ধৃত করছি, ‘ঢাকা থেকে পুলিশের প্রধানও গোপালগঞ্জে হাজির হয়ে পরিষ্কারভাবে তাঁর কর্মচারীদের হুকুম দিলেন মুসলিম লীগকে সমর্থন করতে। ফরিদপুর জেলার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আলতাফ গওহর সরকারের পক্ষে কাজ করতে রাজি না হওয়ায় তাঁকে বদলি করে আরেকজন কর্মচারীকে আনলেন।...নির্বাচনের কয়েক দিন পূর্বে খন্দকার শামসুল হক মুক্তার সাহেব, রহমত জান, শহীদুল ইসলাম ও ইমদাদকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হলো। একটি ইউনিয়নের প্রায় ৪০ জন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। নির্বাচনের মাত্র তিন দিন পূর্বে আরও ৫০ জনের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট দেওয়া হয়।’
পাকিস্তান আমল পেরিয়ে বাংলাদেশ ৫০ বছর পার করেছে। কিন্তু নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীনদের সেই জবরদস্তি এখনো চলছে। চেহারাটা আরও উৎকট রূপ নিয়েছে। পাকিস্তান আমলে আলতাফ গওহরের মতো নীতিনিষ্ঠ আমলা ছিলেন, এখন তা-ও দুর্লভ। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ জনগণের ওপর ভরসা করত; কিন্তু এখনকার আওয়ামী লীগ ভোটের রাজনীতিতে সেই জনগণকেই অপাঙ্ক্তেয় করে ফেলেছে। গণতন্ত্রের ডুবন্ত জাহাজ উদ্ধার করবে কে?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি