বিশেষ সাক্ষাৎকার: রুদাবেহ্ শহীদ
ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে তালেবানকে বদলাতে হবে
রুদাবেহ্ শহীদ যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্কট্যাংক আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো। তাঁর কাজের ক্ষেত্র বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভারত ও দক্ষিণ এশিয়া। আর কাজ করেন মূলত সংঘাত, সংকট ব্যবস্থাপনা, অভিবাসন ও নাগরিক সমাজ নিয়ে। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বর্তমান আফগান পরিস্থিতি, তালেবানের ক্ষমতা দখল, আঞ্চলিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশ ও আফগান শরণার্থী প্রসঙ্গে।সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া
প্রশ্ন :
আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আবার ফিরছে তালেবান। তালেবানের অতীত শাসনের অভিজ্ঞতা আফগান জনগণের রয়েছে। অনেকে বলছেন, এ তালেবান আগের মতো হবে না। আপনার মন্তব্য কী?
রুদাবেহ্ শহীদ: তালেবান ২০ বছর পর আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, কিছু পরিবর্তন আসবে। তবে আফগানিস্তানে তালেবানের শাসন আগের মতো না–ও হতে পারে। কারণ, সেখানকার জনগণ তালেবান শাসনের আগের রূপ মেনে নেবে না। গত ২০ বছরে আফগান জনগণ নানা ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ভোগ করেছে। তালেবানের কাবুল দখলের আগপর্যন্ত আফগানিস্তানের পার্লামেন্ট কার্যকর ছিল, সেখানে ৩৪টি প্রদেশের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। সেখানে নারী প্রতিনিধিদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল। এমন পরিস্থিতিতে তালেবানের পক্ষে আগের অবস্থানে ফিরে যাওয়া কঠিন হবে। আমরা দেখলাম, আফগান টিভিতে নারীরা আবার খবর পড়তে শুরু করেছেন। আগের তালেবান শাসনের সময় দেশটি অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। ফলে এবার তাদের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অর্থনৈতিক অবস্থা ধরে রাখা। সেটা করতে গেলেও তালেবানকে বদলাতে হবে। আগের মতো হলে চলবে না।
প্রশ্ন :
নানা জাতিগোষ্ঠী ও গোত্রভিত্তিক আফগানিস্তানে তালেবানের পুরো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা কি আদৌ সম্ভব?
রুদাবেহ্ শহীদ: তালেবান মূলত একটি পশতু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এর বাইরে তাজিক, উজবেক, হাজারাসহ নানা জাতিগোষ্ঠী রয়েছে এবং এসব জাতিগোষ্ঠীর অঞ্চলভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ফলে সবার সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতা ছাড়া তালেবানের পক্ষে আফগানিস্তানের ওপর পুরো নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করা প্রায় অসম্ভব। আগের তালেবান শাসনের সময়ও এটা সম্ভব হয়নি। এবার এরই মধ্যে জালালাবাদে তালেবানবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। পাঞ্জশির প্রদেশ তালেবানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে। সীমান্তবর্তী অনেক এলাকা রয়েছে, যেখানে সেসব দেশের জাতিগোষ্ঠীর প্রাধান্য রয়েছে। আফগানিস্তান সব সময়ে এ অঞ্চলের বাফার স্টেট হিসেবে বিবেচিত হয়েছে; একই সঙ্গে বিদেশি আগ্রাসী শক্তির কবর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ছাড়ার মধ্য দিয়ে সেটা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। আসলে আফগানিস্তানের ওপর কোনো সরকার কখনো পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পারেনি।
প্রশ্ন :
আফগানিস্তানের একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাধা কি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী? ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী নিয়েও তো জাতিরাষ্ট্র গড়ে ওঠে।
রুদাবেহ্ শহীদ: ভিন্ন ভিন্ন জাতি নিয়েও একটি জাতিরাষ্ট্র গড়ে ওঠে। ভারত বহু জাতির রাষ্ট্র। কিন্তু এসব জাতিগত পরিচয়ের ঊর্ধ্বে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছে। কিছু সাধারণ ঐকমত্যের ভিত্তিতে তা গড়ে ওঠে। আফগানিস্তান বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিদেশি শক্তির হামলা, আক্রমণ ও দখলদারির শিকার হয়েছে। কার্যকর জাতিরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য একটি দেশের যে সময় লাগে, তা আফগানিস্তান পায়নি। প্রায় চার দশক ধরে আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ চলছে। এমন পরিস্থিতি একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনে সহায়ক নয়। এখন তালেবান আবার ক্ষমতায় এসেছে। তারা যদি পশতুন জাতীয়তাবাদের প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা করে, তবে সে সমস্যা থেকেই যাবে।
প্রশ্ন :
আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান, চীন ও রাশিয়া তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে। এই তিন দেশের সঙ্গে তালেবানশাসিত আফগানিস্তানের সম্পর্ক কেমন হতে পারে?
রুদাবেহ্ শহীদ: পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে ঐতিহাসিক বিরোধ রয়েছে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে বিভক্তকারী ডুরান্ড লাইন নিয়ে আফগানের আপত্তি ও অস্বস্তি আছে। পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া দুই দেশের আরেক সমস্যার জায়গা। আফগান তালেবানের প্রতি পাকিস্তানের ডিপ স্টেটের মদদ রয়েছে ঠিকই; কিন্তু আফগান ও পাকিস্তানের সম্পর্ক এসব সমস্যা থেকে সহজে বের হতে পারবে বলে মনে হয় না। আফগানিস্তানে তালেবানের ফিরে আসা নিয়ে পাকিস্তান, চীন ও রাশিয়ার মধ্যে একধরনের সমঝোতা লক্ষ করা যায়। আফগানিস্তানে চীনের স্বার্থ মূলত অর্থনৈতিক। কাবুলে দূতাবাস বন্ধ না করে চীন তালেবানের হাতে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার হস্তান্তর চেয়েছিল। আফগানিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদের দিকে তাদের নজর রয়েছে। একই সঙ্গে তারা তালেবানের কাছে এ নিশ্চয়তাও চাইছে, যাতে উইঘুর মুসলিমরা তাদের কাছ থেকে কোনো ধরনের মদদ না পায়। অন্যদিকে, তালেবানের প্রত্যাবর্তনে যে কটি দেশ স্বস্তিতে আছে, তার মধ্যে রাশিয়া অন্যতম। আফগানিস্তানে ক্ষমতা বদলের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত দিমিত্রি জিরনভ তালেবান প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করেছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আফগানিস্তান–সংক্রান্ত বিশেষ দূত জমির কাবুলভ বলেছেন, নির্বাসিত প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির পুরোনো ‘পুতুল সরকার’–এর চেয়ে তালেবানের সঙ্গে আলোচনা করা সহজ। এরপর রুশ কূটনীতিকদের মুখে শুনলাম, রাজধানী কাবুল এখন আগের চেয়ে বেশি নিরাপদ। ভ্লাদিমির পুতিন গত শুক্রবার বলেছেন, তালেবানের প্রত্যাবর্তন একটি বাস্তবতা, যা মেনে নিতেই হবে।
প্রশ্ন :
আফগানিস্তানে ভারতের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। তালেবান শাসন কায়েম হওয়ার পর দেশটির ওপর যদি চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পায়, তখন ভারতের অবস্থান কী দাঁড়াবে?
রুদাবেহ্ শহীদ: আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখল ভারতকে সত্যিই বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। তালেবান সরকারকে ভারত যদি স্বীকৃতি না দেয়, তবে আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে পাকিস্তান, চীন ও রাশিয়া এগিয়ে যাবে। আবার তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিলেও সমস্যা। কারণ, এতে ভারতকে তার বর্তমান নীতিগত অবস্থানের বদল করতে হবে। তালেবানের কারণে উপমহাদেশে প্যান ইসলামিক ধারণা পৃষ্ঠপোষকতা পেতে পারে। ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাকামীরাও উৎসাহিত হতে পারে। ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদে মদদ দেওয়ার অভিযোগ এনে দেশটির বিরুদ্ধে যে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, তালেবানকে স্বীকৃতি দিলে তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আফগানিস্তানে ভারতের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পে এর পরিমাণ প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার। এর স্বার্থ রক্ষা করা ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, চীন আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদের প্রতি আগ্রহী হলে সেখানে ভারত পাল্টা কিছু করতে পারবে না। কারণ, এ খাতে বিনিয়োগ করার মতো প্রযুক্তি ও সামর্থ্য ভারতের নেই। সবকিছু মিলিয়ে আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখল ভারতের জন্য একটা উভয়সংকট তৈরি করেছে।
প্রশ্ন :
আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের প্রভাবে অনেকে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী তৎপরতা নতুন করে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন। আপনার মন্তব্য কী?
রুদাবেহ্ শহীদ: বাংলাদেশ থেকে যাঁরা আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন, তাঁরা তালেবানের পতনের পর দেশে ফিরে এসেছিলেন। তাঁরাই বাংলাদেশে হরকাতুল জিহাদ তৈরি করেছিলেন। ফলে আফগানিস্তানে তালেবানের ফিরে আসা আমাদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তা ছাড়া নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়ে মিয়ানমার থেকে আসা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। তারা যেহেতু নির্যাতনের শিকার একটি জনগোষ্ঠী, তাই তাদের ক্ষোভকে কোনো ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠী কাজে লাগাতে পারে। তালেবান শাসনের প্রভাব এর ওপর পড়তে পারে। তবে আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের সরকার জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে এবং আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথেষ্ট সাফল্যের সঙ্গে জঙ্গিদের মোকাবিলা করে আসছে।
প্রশ্ন :
আফগানিস্তানে তালেবানের শাসন টিকে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু?
রুদাবেহ্ শহীদ: তালেবানের ক্ষমতায় টিকে থাকা নির্ভর করছে তারা নিজেদের আগের চেয়ে কতটা বদলাতে পারছে, তার ওপর। ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে হবে। তাদের শাসন নিয়ে অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যেসব ভীতি আছে, সেই দিকগুলোয় নজর দিতে হবে। নারী স্বাধীনতা, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, মানবাধিকার—এসব বিষয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এখন আফগানরা ছড়িয়ে আছে। ফলে আফগানিস্তানে কী ঘটছে, সেটা নজরের বাইরে থাকবে না। তালেবান সরকারকে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে; বিশেষ করে পশ্চিমের সঙ্গে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। এসবের ওপরই নির্ভর করছে তালেবানের টিকে থাকা।
প্রশ্ন :
অনেক আফগান দেশত্যাগের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ অঞ্চলে এর কী প্রভাব পড়তে পারে?
রুদাবেহ্ শহীদ: আফগানিস্তানের শরণার্থীরা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য চাপ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের একটি বিপুল জনগোষ্ঠী আশ্রয় নিয়েছে। পাকিস্তানে আফগান শরণার্থী রয়েছে। ভারতে তিব্বতি, আফগান, তামিলসহ নানা দেশের শরণার্থী রয়েছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে নতুন করে আফগান শরণার্থীদের চাপ দক্ষিণ এশিয়া নিতে পারবে না। যুক্তরাজ্য ও কানাডা কিছু শরণার্থী নেওয়ার কথা বলেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়াকে এই শরণার্থীদের গ্রহণ ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।