কথায় আছে, লোহা গরম থাকতে থাকতে হাতুড়ির ঘা দিতে হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঠিক সেটাই করেছেন। কিন্তু তা যে শেষ পর্যন্ত হিতে বিপরীত হবে না, বুক ঠুকে এখনই বলা যাচ্ছে না। কৃষক বিক্ষোভ দানা বাঁধছে। আগামী দিনে কোন রূপ নেবে বলা কঠিন। ছয় বছরে এই প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দল কিছুটা ব্যাকফুটে।
লোহা গরম বলতে করোনাকাল ও বিরোধীদের ছত্রভঙ্গ হাল। গত ছয় মাস দেশে কোনো আন্দোলন নেই। প্রতিরোধ নেই। সরকার যা করতে চেয়েছে, মসৃণভাবে হয়ে গেছে। তা সে সামাজিক অসন্তোষ (দিল্লি দাঙ্গা) দমানো হোক অথবা সরকারি সিদ্ধান্তের (কাশ্মীর) রূপায়ণ। সব বিতর্ক ‘কাগুজে বাঘ’ হয়ে থেকেছে। কৃষিক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সংস্কার সেরে ফেলতে সরকার তাই ঠিক সময়টাই বেছেছে। তিন-তিনটি অর্ডিন্যান্স বা অধ্যাদেশ জারি হয় গত জুন মাসে। কিন্তু তা যে বুমেরাং হতে পারে, সম্ভবত সেই ধারণা সরকার করেনি। তাই এই প্রথম মোদি সরকার মুখোমুখি এক বড় চ্যালেঞ্জের।
সংসদীয় অধিবেশনের মুখ্য বিষয় ছিল কৃষি ও শ্রমসংস্কার চূড়ান্ত করে ফেলা। অধ্যাদেশের বয়স ছয় মাস। তার মধ্যে তাকে আইনে পরিণত করতে হয়। কিন্তু যেভাবে তা করা হলো, প্রায় বিনা আলোচনায়, বিরোধীদের যাবতীয় দাবি নস্যাৎ করে, বিতর্কিত বিল আরও বিবেচনার জন্য ‘সিলেক্ট কমিটিতে’ পাঠানোর সুপারিশ অগ্রাহ্য করে, তাতে স্পষ্ট সরকার চায় না সিদ্ধান্তের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হোক। অর্থনীতির পরিভাষায় কৃষি ও শ্রম আইনের সংস্কার ‘বিগ টিকিট রিফর্মস’। দুই সংস্কারের জন্য সরকার যা করল তা দুরমুশেরই শামিল! সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকা রাজ্যসভায় যে দৃশ্য দেশবাসী দেখল, তা এই দেশের গণতন্ত্রের পক্ষে মোটেই সুখদায়ক বিজ্ঞাপন নয়।
দেশের ৮৪ কোটি গ্রামীণ নাগরিকের মধ্যে ৫০ কোটি কৃষককে অশান্ত ও দুশ্চিন্তায় রেখে রাজত্ব চালানো অসম্ভব। কৃষক–মনে প্রলেপ না পড়লে আগামী দিনে সুখকর অনুভূতির পরশও উবে যাবে। সে বড় সুখের সময় হবে না
কৃষি ভারতীয় সংবিধানের যৌথ তালিকায় থাকলেও এ ক্ষেত্রে রাজ্যের অধিকার ছিল প্রশ্নাতীত। সংস্কারের ফলে সেই অধিকার চলে আসছে কেন্দ্রের হাতে। নতুন আইনে কৃষিবাজারের (এ দেশে যা ‘মান্ডি’) ওপর রাজ্যের একচেটিয়া অধিকার আর থাকবে না। কৃষকদের মতো বেসরকারি বহুজাতিক সংস্থাও তাদের পছন্দমতো ‘মান্ডি’ তৈরি করতে পারবে। কৃষককে বাধ্য করা যাবে না কোনো এক বাজারে উৎপাদিত পণ্য বিক্রিতে। চুক্তিভিত্তিক চাষও করা যাবে। সবচেয়ে বড় কথা, কোন দামে চাষি তাঁর পণ্য বেচবেন, তা বাজারই ঠিক করে দেবে। কৃষক বিক্ষোভের বড় কারণগুলোর মধ্যে এটা অন্যতম।
তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস (এমএসপি) নিয়ে। এ দেশের কৃষিব্যবস্থায় এমএসপি প্রথা চালু রয়েছে বহু দশক ধরে। ক্ষতির হাত থেকে চাষিকে বাঁচিয়ে ন্যায্যমূল্য দিতে সরকার প্রতিবছর বিভিন্ন ফসলের এমএসপি ঠিক করে দেয়। এটাই এই দেশের কৃষকের প্রধান রাজনৈতিক হাতিয়ার। সেই দামের নিচে সরকার ফসল কিনতে পারে না। এই ব্যবস্থা চাষির কাছে একটা বড় নিরাপত্তাও। নতুন আইনে কিন্তু এই প্রথা বাধ্যতামূলক রাখা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রী বলছেন বটে, এমএসপি ছিল, আছে ও থাকবে। কিন্তু নতুন আইনে তার কোনো স্বীকৃতি রাখা হয়নি। কৃষক সংগঠন ও বিরোধীরা চাইছে, এমএসপি প্রথাকে নতুন আইনের আওতায় এনে সবার জন্য বাধ্যতামূলক করতে, যাতে বেসরকারি দেশি ও বহুজাতিক সংস্থা কম দামে ফসল বিক্রিতে কৃষককে বাধ্য করাতে না পারে।
সংস্কার আরও একটি বিষয় নিশ্চিত করেছে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের আওতা থেকে বাদ দিয়েছে চাল, ডাল, তৈলবীজ, পেঁয়াজ ও আলুকে। এই পাঁচ পণ্যের উৎপাদন ও মজুতের ওপর কেন্দ্র বা রাজ্য কোনো সরকারেরই আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। আলু ও পেঁয়াজের মতো পচনশীল পণ্যের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ ও অন্য পণ্যের দাম ১০০ শতাংশ বাড়লে একমাত্র তবেই রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে পারবে। নচেৎ বাজারই সর্বেসর্বা।
কৃষিক্ষেত্রে এ সংস্কার রাজ্যসভায় ‘ধ্বনি ভোটে’ পাস করা নিয়ে তুলকালাম বাধলে আট বিরোধী সদস্যকে পুরো অধিবেশনের জন্য বহিষ্কার করা হয়। প্রতিবাদে সব বিরোধী দল রাজ্যসভা বর্জন করে সংসদ ভবন চত্বরে ধরনায় বসে। বিরোধীহীন রাজ্যসভায় পরের দিন বিনা বাধা ও আলোচনায় পাস হয় শ্রম আইন সংস্কার বিল। এর ফলে ৩০০ কর্মী কাজ করেন, এমন শিল্পের মালিক সরকারের অনুমতি ছাড়াই কর্মী নিয়োগ ও ছাঁটাই করতে পারবেন।
প্রধানমন্ত্রী যে সংস্কারকে ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’ বলেছেন, বিরোধীদের কাছে তা ‘গণতন্ত্রের কৃষ্ণপক্ষ’ ও ‘কৃষকদের মৃত্যু পরোয়ানা’। শাসক দল বলছে, ১৯৯১ সালের পর ফের সংস্কারের দুয়ার হাট করে খোলা হলো। বিরোধীরা বলছে, স্বাধীন কৃষক হতে চলেছেন বেসরকারি পুঁজির হাতের পুতুল ও ক্রীতদাস। সরকার বলছে, এর ফলে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়বে। মধ্যস্বত্বভোগী বা ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য দূর হবে। বিরোধীদের আশঙ্কা, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য না থাকায় কৃষক–শোষণ শুরু হবে। বিজেপি ও আরএসএসের আদর্শভিত্তিক ভারতীয় কিষান সংঘ ও স্বদেশি জাগরণ মঞ্চও এ আইনে বদল আনার দাবি জানিয়েছে।
গত ছয় বছরে এতটা বিচলিত প্রধানমন্ত্রী কখনো হননি, যা হয়েছেন গত ছয় মাসে। প্রথম ছোবল করোনার। প্রায় একই সময়ে চীনের সীমান্ত হানা। তৃতীয় আঘাত সরকারের স্ব–আরোপিত কৃষি সংস্কার। বিরোধীদের ‘অপপ্রচারকে’ দোষী ঠাওরে দেশজোড়া ক্ষোভ প্রশমনে প্রধানমন্ত্রী বারবার বলছেন, এ সংস্কার ২০২২ সালে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করবে।
কিন্তু তাতেও নিভছে না কৃষক মনের ক্ষোভ। আগুন। কেন এত তীব্র প্রতিরোধ ও উষ্মা? প্রশ্নটা ভাবাচ্ছে। উত্তরটা কি তবে সরকারের প্রতি অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা বৃদ্ধি? ‘ট্রাস্ট ডেফিসিট’?
এ জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেই দায়ী। এযাবৎ যেসব শ্রুতিমধুর প্রতিশ্রুতি তিনি শুনিয়ে এসেছেন, প্রতিটিই মিলিয়ে গেছে মরীচিকার মতো। ‘আচ্ছে দিন’, ব্যাংক খাতায় ১৫ লাখ টাকা, বছরে দুই কোটি চাকরি, এক শ স্মার্ট সিটি তৈরি, ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ অথবা একুশ দিনে করোনা খতম, ছয় বছরে একটি প্রতিশ্রুতিও সাকার হয়নি। কাজেই কৃষি সংস্কার ২০২২ সালে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করবে, প্রধানমন্ত্রীর এ সোনালি স্বপ্নাচ্ছন্নতায় ভাসতে কৃষককুল রাজি নয়। বরং অনাকাঙ্ক্ষিত আশঙ্কায় তাঁরা উদ্বিগ্ন। তাই এত আন্দোলন। এত ক্ষোভ। সমর্থনের হাত গুটিয়ে নেওয়ার তাগিদ।
দেশের ৮৪ কোটি গ্রামীণ নাগরিকের মধ্যে ৫০ কোটি কৃষককে অশান্ত ও দুশ্চিন্তায় রেখে রাজত্ব চালানো অসম্ভব। কৃষক–মনে প্রলেপ না পড়লে আগামী দিনে সুখকর অনুভূতির পরশও উবে যাবে। সে বড় সুখের সময় হবে না।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি