ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিশোর-কিশোরীদের স্বপ্ন বোঝার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের গবেষকেরা ২০২১ সালের আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে একটি জরিপ পরিচালনা করেন। ১৪৫ কিশোর-কিশোরীর ওপর করা এ জরিপে বাংলাদেশের আটটি বিভাগের বাংলা, ইংরেজি ও মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করা হয়েছিল। গবেষণায় জানা যায়, কিশোর-কিশোরীরা চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, ব্যাংকার, আইনজীবী, মাওলানার মতো মূলধারার পেশার পাশাপাশি ইউটিউবার, পেশাদার গেমার, কনটেন্ট ক্রিয়েটর, ভয়েস আর্টিস্ট, সমাজসেবী, ক্রিকেটার ইত্যাদি পেশা নিয়ে স্বপ্ন দেখছে। বাংলাদেশের জাতীয় মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০২১-এ এসব তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
কিশোর-কিশোরীরা চারুকলা, কনটেন্ট তৈরি, সোশ্যাল মিডিয়া, আইসিটি ইত্যাদি বিষয়ে পড়াশোনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কারণ, এগুলো তাদের জীবনের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে। প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ‘কিন্তু তারা পুরোনো শ্রেণিকক্ষভিত্তিক শেখার কাঠামোতে আটকা পড়ে আছে, যা তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে খুব কম বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে না। কেউ কেউ মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।’
কিশোর-কিশোরীদের স্বপ্নের সঙ্গে বর্তমানে তারা যা শিখতে বাধ্য হচ্ছে, তার বিরাট ব্যবধান এ প্রতিবেদন তুলে ধরেছে। পরিবারের ক্ষেত্রেও বিষয়টি প্রযোজ্য। এখনো অনেক মা-বাবা পড়াশোনা ও পেশা নিয়ে নিজেদের ইচ্ছাকে সন্তানদের ওপর চাপিয়ে দেন। একটি শিশুর শিল্পী বা বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্নকে অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেওয়া সাধারণ ঘটনা। মা-বাবার প্রত্যাশার চাপ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সন্তানদের সৃজনশীল সম্ভাবনার বিকাশে বাধা দেয়। কেউ যদি পেশাগত জীবনে অর্থপূর্ণ কিছু অবদান রাখতে চায়, তাহলে তাকে সে বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহী হতে হবে। তাই কিশোর-কিশোরীরা যদি নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পড়াশোনা বা পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়, তাহলে তাদের জীবনে হতাশা ও অসন্তোষ তৈরি করে।
কয়েক বছর আগে টাঙ্গাইলের কয়েক কিশোর-কিশোরীর সঙ্গে কথা বলার সময় একজন কিশোরী জানিয়েছিল, ‘মা-বাবা যদি মনে করেন যে গান গাওয়া বা খেলাধুলা পরীক্ষায় ভালো ফলাফলে সাহায্য করবে, তাহলে তারা আমাদের এসব বিষয়ে সময় দিতে দেবেন।’ পরীক্ষায় ভালো করাটা যে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় ব্যাপার হয়ে উঠেছে, এ মন্তব্য সেটা মনে করিয়ে দেয়। কোচিং সেন্টারনির্ভর নিরানন্দ জীবনে বন্দী আমাদের দেশের শিশু-কিশোরেরা।
শিক্ষাব্যবস্থা যদি শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত করতে চায়, তাহলে তাদের বিশ্লেষণের ক্ষমতা, সৃজনশীলতা, দলগত কাজ, যোগাযোগ ইত্যাদির দক্ষতা বাড়াতে হবে। এর ফলে তারা দ্রুত যেকোনো বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে নতুন পেশায় যোগ দিতে পারবে। বাংলাদেশ যদি এ বিষয়গুলোকে বিবেচনা করে শিক্ষায় বিনিয়োগ না বাড়ায়, তাহলে আমরা জাতি হিসেবে পিছিয়ে পড়ব।
শিক্ষা যাতে আনন্দদায়ক হয়, জীবন ও সমাজের সঙ্গে তার যোগ থাকে এবং শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক বিকাশে সহায়তা করে, তার ওপর রবীন্দ্রনাথ গুরুত্ব দিয়েছেন। ১১৫ বছর আগে (বাংলা ১৩১৩) লেখা তাঁর ‘শিক্ষাসমস্যা’ এখনো প্রাসঙ্গিক, ‘শাস্তি দ্বারা কণ্টকিত করিয়া, ঘণ্টা দ্বারা তাড়া দিয়া মানবজীবনের আরম্ভে এ কী নিরানন্দের সৃষ্টি করা হইয়াছে। শিশু যে অ্যালজেব্রা না কষিয়াই, ইতিহাসের তারিখ না মুখস্থ করিয়াই মাতৃগর্ভ হইতে ভূমিষ্ঠ হইয়াছে, সে জন্য সে কি অপরাধী? তাই সে হতভাগ্যদের নিকট হইতে তাহাদের আকাশ–বাতাস, তাহাদের আনন্দ অবকাশ সমস্ত কাড়িয়া লইয়া শিক্ষাকে সর্ব প্রকারেই তাহাদের পক্ষে শাস্তি করিয়া তুলিতে হইবে?’
রবীন্দ্রনাথ শিশুদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে বিবেচনা করার পক্ষপাতী ছিলেন এবং শান্তিনিকেতনে তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা কি শিশু-কিশোরদের প্রতি সংবেদনশীল? কিশোর-কিশোরীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন মনে করিয়ে দেয় যে তারা চিন্তাভাবনায় আমাদের অনেকের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে। প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে বিশ্ব ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কর্মসংস্থানসহ আমাদের সমাজের প্রায় সব ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করছে এবং তা অব্যাহত থাকবে। বর্তমানের অনেক পেশা আগামী কয়েক দশকে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। নতুন পেশার সুযোগ তৈরি হবে।
শিক্ষার্থীরা আজ যা শিখছে, তা চাকরির বাজারে প্রবেশের সময় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। ভবিষ্যতে সারা জীবন ধরে একটা পেশায় থাকা অনেকের পক্ষে সম্ভব হবে না। শিক্ষাব্যবস্থা যদি শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত করতে চায়, তাহলে তাদের বিশ্লেষণের ক্ষমতা, সৃজনশীলতা, দলগত কাজ, যোগাযোগ ইত্যাদির দক্ষতা বাড়াতে হবে। এর ফলে তারা দ্রুত যেকোনো বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে নতুন পেশায় যোগ দিতে পারবে। বাংলাদেশ যদি এ বিষয়গুলোকে বিবেচনা করে শিক্ষায় বিনিয়োগ না বাড়ায়, তাহলে আমরা জাতি হিসেবে পিছিয়ে পড়ব।
মা-বাবা এবং অভিভাবকদের গোল্ডেন জিপিএ নিয়ে এত দুশ্চিন্তার কারণ নেই। দীর্ঘ মেয়াদে এটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। পড়াশোনার পাশাপাশি সন্তানদের সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করুন। এটি তাদের আনন্দ দেবে এবং নিজেদের আগ্রহের বিষয়ে কাজ করতে সহায়তা করবে।
বেশির ভাগ মা-বাবাই সন্তানের ভালো চান, কিন্তু সেই চাওয়াটা নিজের মতো করে এবং সমাজের ছক মেনে। সুখ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের পল ডোলান। হ্যাপি এভার আফটার বইতে তিনি লিখেছেন, পড়াশোনা, পেশাগত সাফল্য, স্বাস্থ্য, বিয়ে, সন্তান ইত্যাদি নিয়ে সুখী হওয়ার ফর্মুলাবিষয়ক একটা সামাজিক ন্যারেটিভ আছে। সমাজের সংজ্ঞা অনুযায়ী, সুখী হওয়া কারও কারও জন্য প্রযোজ্য হলেও সবার ক্ষেত্রে তা কাজ করে না। সবাই একভাবে সুখী হয় না। নানা ধরনের অর্থপূর্ণ জীবন আছে। সমাজের চোখে সুখী হতে গিয়ে অনেকে ভীষণ অসুখী জীবন কাটায়। জীবনে অর্থ খুঁজে পাওয়া, সুখী হওয়া, আনন্দে থাকার যাত্রাটা একেকজনের একেক রকম। এ বিষয়ে মা-বাবা ও অভিভাবকদের বোঝা প্রয়োজন। তাহলে তাঁরা নতুন ধরনের বিষয়ে পড়াশোনা ও পেশা নির্বাচনে সন্তানদের বাধা দেবেন না।
শিশুরা স্বতন্ত্র ব্যক্তি, তাদের নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ ও স্বপ্ন আছে। তাদের সঙ্গে আচরণের সময় মা-বাবা, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট সবার বিষয়টি মনে রাখা উচিত। মা-বাবার দায়িত্ব সন্তানদের সঠিক নির্দেশনা দেওয়া, যা তাদের সম্ভাবনার বিকাশে ভূমিকা রাখবে। মা-বাবাকে সন্তানদের কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনে তাদের স্বপ্নকে সম্মান করাটা শিখতে হবে। পরিবর্তিত বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করার কাজটা শিক্ষকেরা করবেন।
কিশোর-কিশোরীরা তাদের মনের কথা জানাচ্ছে। আমরা কি শুনছি?
লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী