ছদ্মনাম বাবু। মেধাবী ছাত্র। বাড়ি বালাবাড়িহাটে। থানাহাট এ ইউ পাইলট উচ্চবিদ্যালয়, চিলমারী থেকে এসএসসিতে ২০১৮ সালে জিপিএ-৫ পায়। চিলমারী ডিগ্রি কলেজ থেকে ২০২০ সালে অটো পাসেও একই ফল পায়। ভর্তি হয় কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে। সে নিজ জেলার বাইরের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষা পর্যন্ত দেয়নি। তার অভিভাবক একজন শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘সে যখন জেনে গেছে আর পরীক্ষা হবে না, তখন পড়াশোনা ছেড়ে দিল। ভোরে জাগা ছোট ভাইটা আমার সকাল ১০-১১টায় ঘুম থেকে উঠতে শুরু করল। বাড়িতে থাকতে থাকতে এমন হোম সিকনেস হলো, জেলার বাইরে পরীক্ষা পর্যন্ত দিল না!’
শাখাহাতীচরের মোস্তাক (৩৫)। পেশায় রাজমিস্ত্রি। তিনি বলেন, ‘স্কুল-কলেজ বন্ধ হওয়ায় পুরা লকডাউনত চেংরারা ঢাকা-চিটাগাং গেইছে। সাইটের কামত গেইছে। চরত-কাইমত কোনো কোনো চেংরা বাড়িত আছিল না।’
এ ছাড়া ৯ জানুয়ারি ‘ঝরে পড়া মেয়েরা স্কুলে না ফিরলে যত ক্ষতি: বাস্তবতা ও উত্তরণের পথ’ শীর্ষক গোলটেবিলেও সবাই স্বীকার করেছেন করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। অনলাইনে পড়াশোনা করতে গিয়ে অনেকের চোখে সমস্যা হয়েছে। মেয়ে ও ছেলে ব্যাপক সংখ্যায় ঝরে পড়েছে। এ ছাড়া ইউনিসেফ, ইউএনএফপিএ, ব্র্যাক, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালও বলেছে, করোনায় ১৩ শতাংশ বাল্যবিবাহ বেড়েছে, গত ২৫ বছরে যা সর্বোচ্চ।
২.
১৯৮৯ সাল। তখনো গাইবান্ধার শিবরাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বাংলাদেশের সেরা একটি প্রতিষ্ঠান। যত দূর চোখ যায়, রাস্তার দুই পাশে তুঁতগাছ। স্কুলের বাইরের মাঠে তখনো বোর্ডিং হয়নি। মাঠের সঙ্গে আবাদি জমি। মাঠের চতুর্দিকে নানা জাতের গাছ। ভেতরের মাঠে মাঝখানে কুয়া। সেই কুয়ার পানিতে গোসল করতাম। স্কুলের পেছনে ছোটখাটো জঙ্গল।
ছাত্রসংখ্যা বেশি ছিল বলে প্রায়ই মাঠে ক্লাস হতো। গরমের দিনে গাছের ছায়ায় আর শীতে রোদে। পরীক্ষা হতো ১০ হাত দূরে দূরে বসিয়ে। ঘাসেই বসতাম। ১০ হাত দূরে দূরে থাকায় কেউ কারও খাতা দেখতে পেতাম না। কেউ মাথা তুললেই দেখতাম স্যারের চোখ।
৩.
করোনার নতুন ধরন অমিক্রন। তার প্রভাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাস-পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করেছে। বাকিগুলোও শুরু হয় হয় ভাব; যদিও শিক্ষামন্ত্রী একে গুজব বলে ঘোষণা করেছেন।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা হলো বুনিয়াদি শিক্ষা। শিক্ষককে চোখে চোখ রেখে ক্লাস করাতে হয়। প্রয়োজনে নাচতে হয়, হাসতে হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা সরাসরি ক্লাসেই শিক্ষকদের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কথা বোঝে না। সেখানে টিভি আর মুঠোফোনের স্ক্রিনে শিক্ষা কেমনে সম্ভব?
পিডিএফ বা ই-বুক থেকে পাঠকেরা আবার বইয়ে ফিরে আসছেন। আমাদের প্রত্যেকের মুঠোফোনে কয়েক শ করে পিডিএফ আছে, কিন্তু তা আর পড়া হয়ে ওঠে না। কেন? গবেষণা বলছে, এতে চোখের ওপর চাপ পড়ে এবং মাথা ধরে। এ কারণে ফল শূন্য।
৪.
আগে আমাদের কঠোর পিতারা ঘরের বাইরে যেতে দিতেন না। কাজী নজরুল ইসলামের লক্ষ্মী ছেলের মতো স্কুল আর বই নিয়ে থাকতাম। এখন? যুগ উল্টে গেছে। শিক্ষার্থীরা এখন নিজেরাই বন্ধুদের সঙ্গে খেলে না। একসঙ্গে হলে পাবজি খেলে আর ঘরে থাকলে ফেসবুক ও ইউটিউব চালায়। মানে মুঠোফোনে পড়ে থাকে। সেই ওদেরই ঢুকিয়ে দিলাম জুম ক্লাসে।
২০২০ সালের একটি পত্রিকার শিরোনাম ছিল, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন ক্লাসে ৬০ ভাগ শিক্ষার্থীই ক্লাসের বাইরে। কারণ হিসেবে তারা বলেছে, শিক্ষকদের প্রস্তুতিহীনতা, জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের জুম প্ল্যাটফর্মে ক্লাস নেওয়ার অনভিজ্ঞতা, শিক্ষক প্রশিক্ষণে ঘাটতি, সব শিক্ষার্থীর স্মার্টফোন না থাকা এবং দূরবর্তী জেলা ও দুর্গম এলাকায় বসবাসকারী শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টারনেটের ধীরগতি এসব ক্লাসের জন্য ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। কোনো কোনো এলাকায় ক্লাস চলাকালে লোডশেডিংও শিক্ষার্থীদের যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যদি এই হাল হয়, তাহলে স্কুল-কলেজের কী অবস্থা?
বাংলাদেশের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই মাঠ আছে। রবীন্দ্রনাথেরও গাছের ছায়ায় ক্লাস নেওয়ার ছবি আছে। শহরের শিক্ষালয়গুলোতেও মাঠ আছে। যেখানে মাঠ ভরাট করে ভবন তুলেছি, সেখানে ছাদ আছে। হিসাব করলে মাঠ ও ছাদেই তিন হাত দূরত্ব রেখে ক্লাস করা সম্ভব। এখন তো প্রতিটি শ্রেণিতে ৩০ থেকে ৪০ জন শিক্ষার্থী থাকে। চরের স্কুলগুলোয় শিক্ষার্থীর অনুপাত আরও কম। মাঠে ক্লাস হলে প্রতিষ্ঠানপ্রধানের নজরদারি আরও পোক্ত হবে। সুযোগে শিক্ষার্থীদেরও পরিবেশসচেতন করা গেল।
যেসব স্কুলে জায়গা হবে না, সেগুলো খোলা জায়গায় স্থানান্তর করা যেতে পারে। তাও না হলে সেই কটি স্কুল বন্ধ করা হোক। সব স্কুল একেবারে বন্ধ হবে কেন? স্কুল-কলেজ খোলা থাকবে, এটা হবে নীতিগত সিদ্ধান্ত। ইউনিসেফও অনেক আগেই স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখার প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকায় সংক্রমণ বেড়ে গেলেও সেখানে ঠিকই স্কুল খোলা রাখা হয়েছে। বিধিনিষেধ ও টিকাদান কর্মসূচিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে তারা। বিগত ক্ষতির কথা চিন্তা করলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা আদৌ কোনো সমাধান হতে পারে না।
নাহিদ হাসান রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সাবেক সভাপতি। [email protected]