বিষু বাওয়ালী ওরফে টলা বিষুর চোলাই ছাড়া চলেই না। সে ফুলটাইম বেকার। বিষুর বউ হরিদাসি লোকের বাড়ি দাসিবাদির কাজ করে কিছু আনে। তাই দিয়ে সংসার চলে। বিষু রোজ বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে বউকে বোঝায়, আজ রোজগার করে ফিরবে। কিন্তু এখন তার দু শো টাকা লাগবে। হরিদাসি ধারদেনা করে টাকা দেয়। কিন্তু টলা বিষু সেই টাকায় নেশা করে মাঝ রাত্তিরে টলতে টলতে ফেরে। এক সময় হরিদাসির সব বোঝা হয়ে যায়। সে আর বিষুর কথায় ভোলে না। টাকাও দিতে চায় না।
একদিন বিষু হরিদাসিকে বলল, ‘চললাম। আজ হাজার টাকা কামাই করে বাজার নিয়ে ফিরব।’
হরিদাসি হাসি হাসি মুখ করে বলল, ‘সত্যি!’
বিষু বলল, ‘হ্যাঁরে, সত্যি। আজ টাকা কামাই না করে ফিরব না। কিন্তু এখন তুই আমাকে অন্তত দু শ টাকা দে।’
হরিদাসী বলল, ‘উঁহু, টাকা দিলে তুই মাল খেয়ে উড়িয়ে আসবি।’
বিষু মাথা দুলিয়ে বলল, ‘কাভি নেহি!’
বিষুর আত্মবিশ্বাসে ভরা কাঁধ ঝাকানির কায়দা দেখে ভরসা পেয়ে হরিদাসি আঁচলের গিঁট খুলে দু শ টাকা তার হাতে তুলে দিল।
রাত ১২টা নাগাদ যথারীতি টলতে টলতে বিষু বাড়ি ফিরল।
হরিদাসি চিৎকার করে বলল, ‘আজকেও তুই আমার টাকা উড়িয়ে মাল গিলেছিস?’
বিষু বলল, ‘গিলেছি। কিন্তু তোর টাকায় না। নিজের কামাই করা টাকায় গিলেছি।’
হরিদাসি বলল, ‘ওমা, তাই নাকি? তা কত কামাই করলি? কী করে কামাই করলি?’
বিষু বলল, ‘শোন, সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় আসতেই একটা মোটরবাইক দেখি আমার দিকে ছুটে আসছে। আমি ঝট করে সরে গেলাম। সরে গেলাম মানে বিরাট একটা অ্যাক্সিডেন্ট থেকে বেঁচে গেলাম। একবার ভেবে দ্যাখ, যদি বাইকটা ধাক্কা দিত, তাহলে আমার কিছু না হলেও একটা পা ভাঙত। আমাকে পঙ্গু হাসপাতালে যেতে হতো। সিএনজির খরচ লাগত ২০০ টাকা। হাসপাতালে ডাক্তার ওষুধ মিলিয়ে দেড় হাজারের কমে হতো না। ভাঙা পা নিয়ে তো আর হেঁটে আসতে পারতাম না। বাড়িতে আসতে হতো সিএনজিতে। সেখানে যেত আরও ২০০ টাকা। সব মিলিয়ে দুই হাজার টাকার মামলা। কিন্তু আমি বুদ্ধি করে লাফ দিয়ে সরে গেলাম বলেই তো আর সেই মোটরসাইকেলে চাপা পড়তে হলো না। সোজা দুই হাজার টাকা বেঁচে গেল। মানে নগদ কামাই হলো দুই হাজার টাকা। আর যে লোক এক দিনে দুই হাজার টাকা কামাই করতে পারে, সে সেখান থেকে মাত্র দুই শ টাকার মাল খেতে পারবে না? এইটা কোনো কথা!’
আমাদের ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের কথাবার্তা শুনে সরকারকে হরিদাসি, ওয়াসাকে টলা বিষু আর পাবলিককে হরিদাস পাল মনে হচ্ছে। কেন মনে হচ্ছে, ছোট্ট করে বলছি। সঙ্গে থাকুন।
২০০৯ সালে নিয়োগ পাওয়ার পর আর পদ ছাড়তে হয়নি তাকসিম এ খানকে। দেশে তাঁর মতো যোগ্য লোক দুটি না মেলায় ষষ্ঠবারের মতো তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয় ২০২০ সালে। একদিকে এই ১৩ বছরে তাঁর মাসিক বেতন বেড়েছে ৪২১ শতাংশ (এখন তিনি মাসে মাইনে পান ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা) ; অন্যদিকে, ওয়াসার পানির দাম বেড়েছে ১৪ বার। গত ফেব্রুয়ারিতে ১৫ তম দফায় দাম বাড়াতে যাচ্ছিল ওয়াসা। দাম বাড়ানোটা কেন দরকার তা খোলাসা করতে গিয়ে তিনি বলছিলেন, ‘বর্তমানে প্রতি ১ হাজার লিটার পানিতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ১০ টাকা। ভিক্ষা করে কোনো সংস্থা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না।’ তিনি স্বীকার করে নিয়েছিলেন, ওয়াসা সরকারের কাছ থেকে ভিক্ষা নিয়ে চলে।
অতি বিনোদনের কথা, সেই ওয়াসাই ‘শত ভাগ লাভজনক’ প্রতিষ্ঠান হিসাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাড়ে তিনটি করে মূল বেতন ‘পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ড’ হিসেবে বোনাস দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এই বোনাস দিতে খরচ হবে মাত্র ১৯ কোটি টাকা।
তাকসিম এ খানের বর্তমান বেসিক বেতন—মানে, মূল বেতন ২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। সে হিসেবে তিনি বোনাস পাচ্ছেন মাত্র ১০ লাখ ১ হাজার টাকা। একটা ‘ভিক্ষুক’ সংস্থার এই পারফরম্যান্সে যাতে কারও গায়ের লোম খাঁড়া না হয়ে যায় এবং কেউ যাতে এখানে কোনো নয়ছয় হয়েছে বলে সন্দেহ না করেন, সে জন্য ওয়াসার উপপ্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা এ এম মোস্তফা তারেক বলেছেন, ‘ঢাকা ওয়াসা কোনো বিধিবহির্ভূত কাজ করছে না। ওয়াসা বোর্ড সর্বসম্মতিক্রমে এই বোনাস দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
তারপরও পানির দামে আগুন ধরিয়ে পারফরম্যান্স বোনাস দেওয়াকে পাবলিকের সঙ্গে উপহাসের শামিল বলে অনেকে যখন গাঁইগুঁই করছেন, ঠিক সে মুহূর্তে মুখ খুলেছেন তাকসিম এ খান। ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক আমাদের বলে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সেরা। এটা বলার কারণ, আমরা ১০০ ভাগ লাভজনক।’
ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক আমাদের বলে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সেরা। এটা বলার কারণ, আমরা ১০০ ভাগ লাভজনক।’
তাকসিম এ খানকে ডেইলি স্টার প্রশ্ন করেছিল, ‘আপনি বলেন ভিক্ষা করে চলতে হয়। ভিক্ষা করে চলা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বেতন কেন ৬ লাখ বা সাড়ে ৬ লাখ টাকা হবে?’ জবাবে তিনি বলেছেন, ‘এটা অস্বাভাবিক প্রশ্ন তো। ভুলে যাচ্ছেন কেন, ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম তো সারা পৃথিবীতে যা, আমরাও তাই। সেই জন্যই আমাদের ওই প্রফিটটা হচ্ছে। বেতন, বোনাস তো সে কারণেই।’ অর্থাৎ সরকার ভর্তুকি (তাকসিম এ খানের ভাষায় যা ‘ভিক্ষা’) দিচ্ছে, আর তাই দিয়ে ওয়াসা বিরাট লাভ করে যাচ্ছে। তারপর এডিবি সেটিকে ‘দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সেরা’ প্রতিষ্ঠান বলছে। সেই সেরা প্রতিষ্ঠানের সেরা কর্মীরা শতভাগ লাভ করার মতো হাই পারফরম্যান্স দেখানোর পর এইটুকু পারফরম্যান্স বোনাস নেবে না?
কর্মকর্তারা আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছেন, ‘ঢাকা ওয়াসা কোনো বিধিবহির্ভূত কাজ করছে না। ওয়াসা বোর্ড সর্বসম্মতিক্রমে এই বোনাস দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ অর্থাৎ সবকিছু হচ্ছে ‘বিধি’র মধ্যে থেকে। এই ‘বিধি’ এমন এক জিনিস যা দিয়ে পাবলিকের টাকাকে ‘সরকারি টাকায়’ কনভার্ট করা হয়; তারপর সেই সরকারি টাকাকে ‘বিধি মোতাবেক’ ভর্তুকি তথা ভিক্ষা হিসেবে সরকারেরই একটা প্রতিষ্ঠানকে বছরের পর বছর দেওয়া হয়। পাবলিকের টাকা নিয়ে তার বদলে তাঁদের দুর্গন্ধযুক্ত পানি সরবরাহ করার পারফরমেন্স দেখিয়ে এবং ভিক্ষার টাকা নিয়ে শুধুমাত্র ‘বিধি’র জোরে তারা ‘লাভজনক’ প্রতিষ্ঠান হয় এবং পারফরম্যান্স বোনাস হিসেবে ১৯ কোটি টাকা নিয়ে যায়। ‘বিধি’ বলছে, এটিকে লুটপাট বলার কোনো সুযোগ নেই।
ওয়াসা বলছে, তারা শতভাগ লাভজনক প্রতিষ্ঠান। এক শ টাকা লাভ করলে ১০ টাকা নিতে দোষটা কোথায়?
এর পর আর কথা চলে না। বুঝতে পারি, টলটলায়মান চোখে টলতে টলতে টলা বিষু তো হরিদাসিকে ঠিকই বলেছিল, ‘যে লোক দিনে দুই হাজার টাকা কামাই করতে পারে, সে সেখান থেকে মাত্র দুই শ টাকার মাল খেতে পারবে না!’
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ই-মেইল: [email protected]