যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে তিন লাখ সৈন্যকে অত্যাধুনিক সামরিক শিক্ষা দিয়েছে। ৮৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। ন্যাটোর দেওয়া আরও অতিরিক্ত ৭০ মিলিয়ন ডলার ব্যবহৃত হচ্ছিল তাদের আরও চোস্ত চৌকস করার জন্য। অস্ত্রশস্ত্রেরও কমতি নেই। লক্ষ্য ছিল এমন এক সেনাবাহিনী তৈরি করা, যারা তালেবানের আক্রমণে গর্জে উঠবে ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’।
আপেল পাড়ার মতো পটাপট প্রাদেশিক শহরগুলোর দখল নিচ্ছিল তালেবান। কাবুল রক্ষায় ব্যাপক তোড়জোড় ও ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ দেখে অনেকেই ভেবেছিলেন কাবুল দখল সহজ হবে না। অথচ হলো কী? প্রেসিডেন্ট গনি দেশত্যাগ করেছেন। তিনি তাজিকিস্তানে। দোহায় আফগান সরকারের শীর্ষ মহল ও কূটনীতিকেরা তালেবানের সঙ্গে শান্তি চুক্তি এবং শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য প্রতীক্ষারত। এ মুহূর্তে তাঁরা অনেকটাই তালেবানের করুণা ও সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। সামরিক বাহিনী কোথাও কোনো প্রতিরোধ গড়েনি। রাষ্ট্রীয় বাহিনী কি আসলেই কোনো প্রতিরোধ গড়তে পারত না? পারত। তারা চায়ইনি। নামেওনি। বেশ কিছু ক্ষেত্রে তালেবানের সঙ্গে সৈন্যরা যেন একাত্মই হয়ে আছে।
প্রশিক্ষিত সামরিক শক্তি কেন নামেনি? কারণ, গনি সরকারের ‘লেজিটিম্যাসি’ বা বৈধতা ছিল না। নির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে দ্বিতীয় দফায় গনি সরকারের আগমন সাধারণ জনতা ভালোভাবে নেয়নি। আগ্রাসী তালেবানকেই তাই আমজনতার বড় অংশ স্বাগত জানিয়েছে। রাস্তায় জনগণ তালেবানের সঙ্গে কোলাকুলিরত। সেনাবাহিনীর সদস্যরাও সেই সব দৃশ্য দেখছেন। সেনাবাহিনীর দ্বিধাদ্বন্দ্বময় নৈতিক অবস্থান হয়ে পড়েছে—আমরা কেন জনগণের বিপক্ষে দাঁড়াব? আমরা তো শাসকের পেটোয়া বাহিনী নই, দেশের সেবক। আমাদের দেশেই থাকতে হবে। ‘রাজা যায় রাজা আসে’ সেনারাও যাওয়া-আসারত রাজরাজড়ার অনুগত-অধীনস্থ—এই সেনা-নৈতিকতার বাঁধন প্রায় আড়াই শ বছর আগের ফরাসি বিপ্লবের পরই আলগা হয়ে গেছে। সেনাজগৎ এখন আর রোমান ‘প্রিটরিয়ান গার্ড’দের জগৎ নয়। স্যামুয়েল ফাইনার বর্ণিত ‘ম্যান অন দ্য হর্সব্যাক’ও নয়। এটি এখন শাসনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। সেনাদের নিষ্ক্রিয়তাকে ব্যর্থতা হিসেবে দেখার সুযোগ কম। বরং সেনাদের প্রাতিষ্ঠানিকতা ও পেশাদারিও বলা যেতে পারে।
গনি সরকারের ‘লেজিটিম্যাসি’ বা বৈধতা ছিল না। নির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে দ্বিতীয় দফায় গনি সরকারের আগমন সাধারণ জনতা ভালোভাবে নেয়নি। আগ্রাসী তালেবানকেই তাই আমজনতার বড় অংশ স্বাগত জানিয়েছে। রাস্তায় জনগণ তালেবানের সঙ্গে কোলাকুলিরত। সেনাবাহিনীর সদস্যরাও সেই সব দৃশ্য দেখছেন।
তা ছাড়া আশরাফ গনি সরকারের সবচেয়ে কাছের ও নির্ভরযোগ্য নীতিনির্ধারকদের জনসম্পৃক্ততা ছিল না। তাঁরা ছিলেন এলিট ঘরানার। তাঁরা দারি ও পশতু ভাষাতেও তেমন দক্ষ ছিলেন না, যতটা দক্ষ ছিলেন ইংরেজিতে। তাঁদের প্রত্যেকের আছে বিদেশি পাসপোর্ট। জনগণ জানত তারা বিপদে পড়লে নীতিনির্ধারকেরা ঠিকই থাকবেন পগার পার। বাস্তবতাটি সেনাবাহিনী এবং জনগণ উভয় পক্ষেরই জানা।
দীর্ঘ যুদ্ধের ক্লান্তি অশেষ। ‘ওয়ারফেয়ার ফ্যাটিগ’ বা ‘কম্ব্যাট ফ্যাটিগ’ও আফগানিস্তানের বাস্তবতা। দুই দশকের যুদ্ধে লোক ও সম্পদ ক্ষয়ের দৃশ্য সেনা-জনতা-তালেবান কারও জন্যই দৃষ্টিনন্দন বা সুখকর ছিল না। সেনারা সম্ভবত আর অনর্থক লোক ও সম্পদ ক্ষয় চায়নি। তবু তারা হয়তো প্রতিরোধে নামত, যদি সরকারের বৈধতা থাকত। তারাও প্রত্যক্ষ করেছে যে তালেবানরা স্পষ্ট বক্তব্যে জানিয়েছে যে তারাও আর লোকক্ষয়-সম্পদ ক্ষয় চায় না। ঘোষণা দিয়েছে, প্রতিপক্ষ আত্মসমর্পণ করলে দায়মুক্তি দেওয়া হবে। ভিন্নমতাবলম্বীদের যারাই কাবুল ছেড়ে যেতে চাইছে, সবাইকে নিরাপদ প্রস্থানের সুযোগ করে দেওয়ার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।
শীর্ষ সেনা নীতিনির্ধারকদের মনে হতে পারে যে তালেবানরা হয়তো তাদের মৌলবাদী অবস্থান হতে সরে আসবে। তালেবান শাসন চালু হলে কৌশলগত বা বাস্তবমুখী কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আসা হয়তো অসম্ভব কিছু নয়। দেরিতে হলেও শান্তির প্রত্যাশা বা বোধোদয় ঘটা একটি মানবিক স্বাভাবিকতা। নারীদের স্বাধীনতা ও সম্মান প্রদান এবং নমনীয় আধুনিক শাসন প্রতিষ্ঠায় তালেবান প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিষয়টিকে খানিকটা সন্দেহ সীমায় রাখলেও তালেবানি দর্শনে একটি বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে মনে করা যেতে পারে। এমনও ঘটা অসম্ভব নয় যে তালেবান পুনরায় আগ্রাসী ও ক্ষতিকর হয়ে উঠলে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করবে। সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে আফগানিস্তানে সেনাশাসনের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তলে তলে যুক্তরাষ্ট্রেরও সে রকম পরিকল্পনা বা হিসাব-নিকাশ থাকা অসম্ভব নয়। গনি সরকারের বৈধতার সংকট ভবিষ্যতে আফগানিস্তানকে আরও কতটা সংকটে ফেলবে, সেটি আগামী দিনগুলোর ঘটনাপরম্পরা এবং সময়ই বলে দেবে।
নারীদের স্বাধীনতা ও সম্মান প্রদান এবং নমনীয় আধুনিক শাসন প্রতিষ্ঠায় তালেবান প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিষয়টিকে খানিকটা সন্দেহ সীমায় রাখলেও তালেবানি দর্শনে একটি বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে মনে করা যেতে পারে।
১১ আগস্টের ‘ফরেন পলিসি’তে অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক নিল ও’ডোনেল কয়েকটি বিষয়কে চমৎকারভাবে তুলে এনেছেন। লেখাটি লিখেছিলেন আরও দু-তিন দিন আগে। তখন পর্যন্ত ১০টি শহর তালেবানের কবলে। তবু তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন অন্যান্য শহরই শুধু নয়, কাবুলও পতনের কবলে পড়তে পারে। কারণ, এই নয় যে সেনা-প্রশিক্ষণ ব্যর্থ হয়েছে। অস্ত্রশস্ত্রেরও কোনো ঘাটতি নেই। বরং সত্য এটিই যে আফগানিস্তান আরও শক্তিশালী ও পেশাদার যোদ্ধা তৈরি করতে পেরেছে।
ক্ষয়ের কারণ আশরাফ গনি সরকারের বৈধতার সংকট এবং দুর্নীতি। তার স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র বিভাগ অনিয়ন্ত্রণযোগ্য দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল। স্বরাষ্ট্র বিভাগের অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের কয়েক মাসের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা যায়নি। তারাও সংক্ষুব্ধ। সেনাদের সরকারের পক্ষে দাঁড়ানোও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সেনাদের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন করে তুলতে পারত।
সরকারের ভেতরকার এসব সংকটের বীজও গনি সরকারের বৈধতাহীনতার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল। সরকারের ভেতরকার বৈধতার সংকটই যে আফগানিস্তানে তালেবানের পুনরুত্থানের পথ তৈরি করে দিয়েছে, তাতে আর সন্দেহের অবকাশ নেই।
চীনের সঙ্গে তালেবানের মাখামাখি ও সখ্য ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
এখন দেখার বিষয়, তালেবানের পুনরাগমন দক্ষিণ এশিয়া ও এশিয়ার ভূরাজনীতিতে কী রূপ প্রভাব ফেলে। আফগানিস্তানে ক্ষমতার এই পালাবদল বাংলাদেশে তালেবানপন্থী গোপন রাজনীতি উসকে দেওয়ার কারণ হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশে আশ্রিত বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিয়েও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কারণ হয়ে উঠতে পারে।
হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়