২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

আর কত ক্ষমতা পেলে আমলাদের চাওয়া শেষ হবে

গত বছর জরুরি কাজে সিলেট যেতে হয়েছিল। সার্কিট হাউসে রুম বরাদ্দের জন্য দফায় দফায় ডিসির সঙ্গে টেলিফোন, খুদে বার্তা, চিঠির মারফত যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি আমি। এনডিসির সঙ্গে কথা বললে বলে ডিসিকে অবহিত করতে, কিন্তু ডিসি সাহেব না ধরেন ফোন, না করেন কলব্যাক, না পাই চিঠি বা ফ্যাক্সের জবাব। শেষমেশ একটা হোটেলে উঠতে বাধ্য হয়েছিলাম আমি। একই ঘটনা ঘটেছে আমার নিজ জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও। আমি একে তো বিরোধী দলের সাংসদ, তার ওপর সংসদে গেছি প্রথমবার, আমলাদের আস্ফালন আমাকে সহ্য করতেই হয়, পদমর্যাদায় আমার অবস্থান সিনিয়র সচিবের ওপরে হলেও তাঁদের কিছুই আসে যায় না। তবে অবাক বিস্ময়ে দেখলাম ভুক্তভোগী শুধু আমি একা নই।

সংসদে সরকারের অতি আমলানির্ভরতা নিয়ে মন্তব্য করে সরকারদলীয় অভিজ্ঞ, ঝানু পার্লামেন্টারিয়ান তোফায়েল আহমেদও কিছুদিন আগে আলোচনায় এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়ে জাতীয় পার্টির সিনিয়র সাংসদ কাজী ফিরোজ রশিদ বলেছিলেন ‘...মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ডিসিদের সাথে কথা বলেন। আর এমপি সাহেবরা পাশাপাশি বসে থাকেন, দূরে। তারপর বলে ডিসি সাব, আমি একটু কথা বলব প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে।’ দেশে সরকারের সঙ্গে যুক্ত কয়েকবারের সাংসদদের যখন এই অবস্থা, তখন আমি তো কোন ছার!

দেশে বর্তমানে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা ভোগ করছেন আমলারা, কোনো মন্ত্রী বা এমপি নন। কিন্তু এতেও সন্তুষ্ট নন তাঁরা, চান আরও বেশি ক্ষমতা। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া ডিসি সম্মেলন সেই বাস্তবতা আমাদের সামনে আবার এনেছে। জেলা পর্যায়ে ডিসিদের সাধারণ কার্যাবলির মধ্যেই রয়েছে ৬২টি বিষয়। এসব কার্যক্রম তদারকির পাশাপাশি আরও ক্ষমতা চান ডিসিরা। দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর ২২৮ ধারা মোবাইল কোর্ট আইনের তফসিলে অন্তর্ভুক্তের প্রস্তাব করেছেন ডিসিরা, যাতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সময় অসহযোগিতাকারীদের তাৎক্ষণিকভাবে জেল-জরিমানা করতে পারেন তাঁরা। মোবাইল কোর্টের যতটুকু ক্ষমতা আছে তাঁদের হাতে, সেটুকুই আমাদের বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার সঙ্গে চরমভাবে সাংঘর্ষিক, কিন্তু তাঁরা চান আরও বেশি ক্ষমতা।

দেশের সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিন্ডিকেট বা পরিচালনা কমিটিতে ডিসিরা তাঁদের অন্তর্ভুক্তি, জেলার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষক নিয়োগেও নিজেদের সম্পৃক্ততা, জাতিসংঘ শান্তি মিশনে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তার সুযোগ সৃষ্টি, অস্ত্রের লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে পুলিশি প্রতিবেদনের পাশাপাশি ইউএনওদের মতামত গ্রহণ, ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে সমন্বয়ের জন্য ডিসিকে প্রধান করে জেলা কমিটি গঠন, ক্ষুদ্রঋণদাতা এনজিওগুলোর ডিসির প্রত্যয়নপত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক করা, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কার্যক্রমে ডিসিদের সম্পৃক্তকরণ, প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাবকালে ডিসির মতামত গ্রহণ, অবৈধ গ্যাস–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য ডিসির নেতৃত্বে জেলা কমিটি গঠন, ডিসির নেতৃত্বে সব জেলায় শ্রমিক-মালিক সংকট নিরসনে সমন্বয় কমিটি গঠন, বাণিজ্য মেলা আয়োজনে ডিসির অনুমতি নেওয়ার বিধান যোগ করার মতো ক্ষমতা চেয়েছেন তাঁরা। সরকারকে দেওয়া তালিকাটা অনেক দীর্ঘ, কলেবর আর বাড়াতে চাই না।

প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কার্যক্রমে সম্পৃক্ততার মতো কিছু দাবি এর মধ্যেই নাকচ করা হয়েছে। অনেক দাবি নিশ্চয়ই অন্তত এ যাত্রা বিবেচনা করা হবে না। কিন্তু একটা বিষয় খুব স্পষ্ট, ডিসিরা মনে করছেন এসব দাবি করা যায়। এই দাবি করা দিয়েই তাঁদের মানসিকতা পরিষ্কার। জেলার নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে একেকজন হয়ে উঠতে চাইছেন ‘জেলা প্রধানমন্ত্রী’।

সাম্প্রতিক কালে সরকারি দলের ভেতরেই আমলাদের নিয়ে নানামুখী সমালোচনা সাবেক আমলা পরিকল্পনামন্ত্রীর ভালো লাগেনি। আমলাদের অপরিহার্যতা বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ফেরাউনও আমলাতন্ত্রের বিকল্প বের করতে পারে নাই।’ মজার ব্যাপার হলো, তাঁর দলের লোকজন কিংবা আমরা কেউ কিন্তু আমলাতন্ত্রের বিকল্প বের করতে বলিনি। আমরা চেয়েছি এটা নিশ্চিত করতে, আমলারা থাকবেন তাঁদের ক্ষমতার চৌহদ্দির মধ্যে।

ইউএনওরাই বা পিছিয়ে থাকবেন কেন, তাঁরা হতে চান ‘উপজেলা প্রধানমন্ত্রী’। উপজেলা পরিষদ আইনের তৃতীয় তফসিলে ১২টি মন্ত্রণালয়ের উপজেলাধীন ১৭টি বিভাগকে উপজেলা পরিষদের কাছে কর্মকর্তা, কর্মচারী ও তাঁদের কার্যালয়সহ হস্তান্তর করা হয়েছে। আইনকে বিবেচনায় না নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর বিভিন্ন সময়ে পরিপত্র জারি করছে। এর মাধ্যমে উপজেলার সব বিভাগের কার্যাবলি নিষ্পত্তির জন্য গঠিত প্রায় শতভাগ কমিটিতে ইউএনওকে সভাপতি করা হয়েছে। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের অনুমোদন ছাড়া সব কাজ কমিটি প্রধানের ক্ষমতাবলে নিয়ন্ত্রণ করছেন ইউএনও। উপজেলা চেয়ারম্যান এবং পৌরসভার মেয়ররা মূলত আওয়ামী লীগের নেতা হলেও তাঁদের ক্ষমতায়িত করতে আপত্তি কেন সরকারের? আমলাতন্ত্র কি সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বাধ্য করছে দাবি মেনে নিতে?

সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কথা ছিল, ‘প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ ওদিকে ‘স্থানীয় শাসন’বিষয়ক অনুচ্ছেদ ৫৯ অনুযায়ী সংবিধান বলছে, ‘নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা’ এবং তাদের হাতে ‘প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কার্য, জনশৃঙ্খলা রক্ষা, জনসাধারণের কার্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন’–এর দায়িত্ব থাকবে। কয়েক মাস আগে উচ্চ আদালত উপজেলা চেয়ারম্যানদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে ইউএনওকে সাচিবিক দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিলেও এখনো সেটা কার্যকর করেনি সরকার।

সাম্প্রতিক কালে সরকারি দলের ভেতরেই আমলাদের নিয়ে নানামুখী সমালোচনা সাবেক আমলা পরিকল্পনামন্ত্রীর ভালো লাগেনি। আমলাদের অপরিহার্যতা বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ফেরাউনও আমলাতন্ত্রের বিকল্প বের করতে পারে নাই।’ মজার ব্যাপার হলো, তাঁর দলের লোকজন কিংবা আমরা কেউ কিন্তু আমলাতন্ত্রের বিকল্প বের করতে বলিনি। আমরা চেয়েছি এটা নিশ্চিত করতে, আমলারা থাকবেন তাঁদের ক্ষমতার চৌহদ্দির মধ্যে। কিন্তু সেই চৌহদ্দি পেরিয়ে তাঁরা অনেকে আগেই অনেক দূরে চলে গেছেন।

২০১৪ সালের পর থেকে জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে সরকার অতি আমলানির্ভর হয়ে পড়তে শুরু করে। এরপর ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হয় ২০১৮ সালের নির্বাচনে আমলাদের তত্ত্বাবধানে ‘রাতের ভোটে’ নির্বাচনে জিতে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। এর মাশুল এখন দেখা যাচ্ছে সর্বত্র; আমলাদের কাছে সরকারি দলের প্রভাবশালীদেরই কোনো মূল্য নেই এখন। সংসদে বলা সরকারদলীয় সাংসদ নাজিম উদ্দিন আহমেদের জবানিতেই তা স্পষ্ট, ‘পিয়ন পর্যন্ত আমাদের দাম দেয় না। স্যারডা না বইলা পারে না। আমলাতন্ত্রের হাতে আমরা জিম্মি হয়ে গেছি।’

পরিকল্পনামন্ত্রীর মন্তব্যের প্রসঙ্গ ধরে বলতে চাই, বরং ওই রকম আমলাতন্ত্রের জন্যই ফেরাউন ছিলেন বিকল্পহীন। সম্রাট শাসিত সেসব রাজ্যে তখন সব কাজই ছিল আমলানির্ভর। সেখানে একটা আধুনিক রাষ্ট্রের মতো ‘ক্ষমতার পৃথক্‌করণ’ বা ‘সেপারেশন অব পাওয়ার’ ছিল না। নানা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ছিল না, ছিল না রাজ্যের বিভিন্ন স্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে গঠিত স্থানীয় সরকার। বাংলাদেশে এসব কাজির গরু কিতাবে থাকলেও গোয়ালে নেই। সে কারণেই এই অতি আমলানির্ভরতা। তাই প্রশ্ন চলেই আসে, সরকার কি তবে মিসরের সেই প্রাচীন আমলাতান্ত্রিক শাসন বজায় রাখতে চায়? নাকি তেমন হতে সরকারকে বাধ্য করছে তাকে ক্ষমতায় আনা এবং সেটা টিকিয়ে রাখার সর্বময় ক্ষমতাবান আমলাতন্ত্র?

রুমিন ফারহানা বিএনপিদলীয় সাংসদ ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী