২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

আফগানিস্তানে সন্ত্রাসের মূল দায় যুক্তরাষ্ট্রের

কাবুল দখলে নেওয়ার পর রাস্তায় তালেবান যোদ্ধাদের প্রহরা
ফাইল ছবি: এএফপি

যুক্তরাষ্ট্র ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে যুদ্ধ চালিয়ে, ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে এবং হাজার হাজার মানুষের জীবনহানি করে শেষমেশ সবকিছু গুটিয়ে ফিরে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষ্ফল প্রত্যাবর্তনের পর অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষক বলেছেন, ‘আমরা কিছুই অর্জন করতে পারিনি।’ কিন্তু তাঁদের এই কথা ভুল। তাঁদের বলা উচিত, ‘আফগানিস্তানের মাটি যাতে সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর না হয়, সেই জন্য আমরা সেখানে অভিযান চালিয়েছিলাম। আমরা সে জায়গাটাকে যেভাবে পেয়েছিলাম, এখন তার চেয়ে অনেক খারাপ অবস্থায় রেখে এসেছি। অনেক নিকৃষ্ট অবস্থায় তাদের রেখে চলে এসেছি।’

গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া একজন মানুষ এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ বিষয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি বহুবার বলেছি, কোনো অন্যায় ও অবিচার বিশ্বের সবচেয়ে উদার ও সহিষ্ণু মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দিলে শেষ পর্যন্ত তারাও কট্টরপন্থী হয়ে উঠতে পারে। বহু বছর ধরে আমি আমার জাতি বসনিয়ানদের চরমপন্থী হওয়ার প্রবণতার ওপর পড়াশোনা ও গবেষণা করে আসছি। বসনিয়ার মুসলমানরা বিশ্বের সবচেয়ে সহিষ্ণু মুসলমান হিসেবে অনেক আগে থেকেই পরিচিত। কিন্তু সেই বসনিয়ানদের মধ্যে ক্রমে সালাফি ধারা ঢুকছে। বসনিয়ার মুসলমানদের মধ্যে কট্টর দর্শন ঢুকছে এবং তারা আল-কায়েদা, আইএস অথবা বোকো হারামের মতো দর্শনের প্রতি ঝুঁকে যাচ্ছে। কিন্তু কেন?

এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে আমাদের ১৯৯১ সালে ফিরে যেতে হবে। সে বছর সার্ব নেতা রাদোভান কারাদজিচ (আন্তর্জাতিক আদালতে যিনি গণহত্যাকারী হিসেবে ইতিমধ্যে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন) বসনিয়ানদের বলেছিলেন, বসনিয়া হার্জেগোভিনা থেকে মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হবে। সেই কথামতো তিনি ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় মুসলমানদের ওপর নির্বিচার গণহত্যা চালান। তিনি সার্ব বাহিনী নিয়ে বসনিয়ায় ঢুকে স্থানীয় সার্বদের সহায়তায় মুসলিম নিধন শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ তা চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখেছিল।

সেই দৃশ্য যে বসনিয়ান দেখেছে, তার মনে স্থায়ীভাবে মানসিক আঘাতের ক্ষত তৈরি হয়েছে। সে সময় আমি আমার পরিবারের সঙ্গে বসনিয়ার বিহাকে থাকতাম। একদিন আমাদের বাড়ির পাশেই সার্বদের বিমান থেকে বোমা ফেলা হলো। আমি এবং আমার আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুরা প্রাণভয়ে দিগ্‌বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছুটতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর জাতিসংঘের একটা গাড়ি দেখে দৌড়ে গাড়ির কাছে গেলাম। আমি ভেবেছিলাম, গাড়িটা আমাদের উদ্ধার করতে এসেছে। কিন্তু দেখলাম গাড়ি থামল না। আমাদের অসহায়ভাবে ফেলে গাড়িটা চলে গেল। তখন মনে হচ্ছিল, আমরা মরি বা বাঁচি, তা নিয়ে পশ্চিমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এরপর আমার বাবা এবং তঁার বন্ধুরা মিলে আমাকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। সেখানে পড়াশোনা করা এবং সম্মানজনক জীবন-জীবিকার মধ্য দিয়ে আমার সেই মনের ক্ষত হয়তো সেরেছে। কিন্তু যে হাজার হাজার বসনিয়ান পীড়নের শিকার হয়েছে, তাদের মধ্যে সেই ক্ষত সারানোর জন্য পশ্চিমা বিশ্ব কী করতে পেরেছে? সেই বঞ্চনার অনুভূতিই বিশ্বের সবচেয়ে সহিষ্ণু মুসলমানদের মনে চরমপন্থার ভাবনা জাগিয়ে তুলছে।

এবার আফগানিস্তানের দিকে তাকান। সেখানে যুগের পর যুগ সাধারণ মানুষ সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছে। তারা প্রতিবারই দেখেছে, বাইরের শক্তিগুলো তাদের ‘সহায়তা’ করতে এসে শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসঘাতকতা করে চলে যায়। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য তাদের গ্রাস করে আছে। তাদের শিশুরা পড়াশোনা করার সুযোগ পাচ্ছে না। ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত কয়েক কয়েক লাখ আফগান নাগরিক মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের হিসাব অনুযায়ী, গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে ৩৩ হাজার শিশু নিহত হয়েছে। সর্বশেষ ঘটনায় গত আগস্টে আইএসকের ঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্র বিমান হামলা চালায় বলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। দেখা গেছে, ওই হামলায় এমন একটি পরিবারকে বোমা মেরে শেষ করে দেওয়া হয়েছে, যাদের সঙ্গে আইএসকের দূরতম সম্পর্কও নেই।

যুক্তরাষ্ট্র যাদের সন্ত্রাসী বলে নির্বিচার মেরেছে, তারা আফগানদের চোখে কেবলই সন্ত্রাসী নয়। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ তাদের মা, কেউ বাবা, কেউ ভাই, কেউবা বোন। শীতল যুদ্ধের সময় আফগানিস্তানে প্রথম যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করে। ১৯৭৮ সালে সোভিয়েত-সমর্থিত কমিউনিস্ট পার্টি আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করার পর যুক্তরাষ্ট্র এখানে নাক গলাতে শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র অশিক্ষিত ও ধর্মপ্রাণ মুসলমান আফগানদের সোভিয়েতের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে সহযোগিতা দেয়। নব্বইয়ের দশকের শেষে সোভিয়েতবিরোধী তালেবান ক্ষমতা দখল করে। এরপর সেই তালেবানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালে যুদ্ধ করে তালেবান সরকারের পতন ঘটায়। এরপর থেকে সেখানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী কথিত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে হাজার হাজার মানুষ মেরেছে।

এই রক্তপাত ২০ বছর ধরে আফগানদের দেখতে হয়েছে। বারবার পশ্চিমাদের নেতিবাচক আচরণে সাধারণ আফগানদের মধ্যে পশ্চিমাদের সম্পর্কে অনাস্থা তৈরি হয়েছে। ২০০১ সালে, অর্থাৎ আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন যখন আফগানিস্তানে ছিলেন, তখন বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের সূচকে দেশটি ১৬ নম্বরে ছিল। আজ সেই দেশ সন্ত্রাসের তালিকায় ১ নম্বরে উঠে এসেছে। আর এর দায় আমাদেরই।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • আমরা সাবিক এল রায়েস কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও লেখক