যেকোনো রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহার হলো জনগণের কাছে তাদের ওয়াদা। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের (সেই নির্বাচন যেভাবেই হোক না কেন) মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সরকারের তিন বছর পূর্ণ হলো। আগের তিন মেয়াদে (১৯৯৬-২০০১, ২০০৯-২০১৪, ২০১৪-২০১৮) আওয়ামী লীগ জোটসঙ্গীদের নিয়ে সরকার গঠন করলেও এবার করেছে এককভাবে। ফলে তিন বছরে সফলতার কৃতিত্ব যেমন, তেমনি ব্যর্থতার দায়ও এককভাবে আওয়ামী লীগের।
২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহারের মূল কথা ছিল ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ দেশবাসীর কাছে কী ওয়াদা করেছিল, সেই ওয়াদার কত অংশ পূরণ হয়েছে, কত অংশ হয়নি, সেসবের একটি বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা প্রয়োজন।
ওই নির্বাচনী ইশতেহারের ৩.১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল: বিগত ১০ বছরে জাতীয় সংসদই ছিল সব রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের চলমান প্রক্রিয়াকে আরও জোরদার করব। সংসদকে আরও কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। একই সঙ্গে মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, গণমাধ্যম, বিচার বিভাগকে আরও শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
কিন্তু গত তিন বছরে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ কিংবা জাতীয় সংসদকে ‘আরও কার্যকর’ করার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। মনে আছে, নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর যখন বেসরকারি টিভি চ্যানেল ছিল না, জাতীয় সংসদের ধারাবিবরণী সরকারি প্রচারমাধ্যম রেডিওকে প্রচার করা হলে রাস্তাঘাটেও মানুষ ভিড় জমাত। গাড়ির চালকেরা গাড়ি থামিয়েও সেই বিতর্ক শুনতেন। এখন জাতীয় সংসদের বিতর্ক নিয়ে জনগণের কোনো আগ্রহ নেই। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব গণতন্ত্রকে এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে।
ইশতেহারে আওয়ামী লীগ মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বলেছিল। গত এক যুগে কমিশন একটি অথর্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। অধ্যাপক মিজানুর রহমান চেয়ারম্যান থাকাকালে মানবাধিকার কমিশনকে কিছু কিছু বিষয়ে আওয়াজ তুলতে দেখা যেত। এখন একেবারে নীরব। আওয়ামী লীগ দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বলেছে। দুদক ছোট ও মাঝারি দুর্নীতিবাজদের ধরলেও রাঘববোয়ালেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের অনেক সাফল্য আছে। পদ্মা সেতুসহ অনেক বড় বড় প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলেছে। বাস্তবসম্মত নীতি-পরিকল্পনার কারণে করোনার ধাক্কাও অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যে মূল ভিত্তি গণতন্ত্র, তা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আরও দুর্বল হয়েছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এটাই আওয়ামী লীগের ওয়াদার বড় বরখেলাপ বলে মনে করি।
ইশতেহারের ৩.২ অনুচ্ছেদের ভাষ্য ছিল: সর্বজনীন মানবাধিকার সুনিশ্চিত করার পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেকোনো প্রচেষ্টা প্রতিহত করা হবে। গত তিন বছরে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে র্যাব এবং এর সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, যা বাংলাদেশে অতীতে কখনো ঘটেনি। এতে দেশের ভাবমূর্তি সমুন্নত হয়েছে না ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই বিচারের ভার আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে ছেড়ে দিলাম।
আওয়ামী লীগের ইশতেহারে জঙ্গিবাদ, মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রাখা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছিল। আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তি চালুর মাধ্যমে দুর্নীতির পরিধি ক্রমান্বয়ে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছিল। সরকারের ঘোষিত নীতির প্রতিফলন গত তিন বছরে দেখা যায়নি। এই সময়ে দুর্নীতি কমেছে, এ কথা সরকারের অন্ধ সমর্থকও বলবেন না। কক্সবাজারে সরকারের তিনটি প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণসংক্রান্ত দুর্নীতি তদন্ত করতে গিয়ে দুদক কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিনকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। দুদক চেয়ারম্যান এই কর্মকর্তাকে নিরাপত্তা না দিয়ে চাকরিচ্যুত করেছেন। রাজনীতিকেরা না আমলারা বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত, তা নিয়ে সরকারি পর্যায়েই বিতর্ক হচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী কানাডায় যাঁরা সেকেন্ড হোম বানিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আমলার সংখ্যা বেশি।
ইশতেহারের ৩.৬ অনুচ্ছেদে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও মাদক নির্মূলের কথা বলা হয়েছে। জঙ্গিবাদ দমনে সরকার সফল হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তারা সত্যি সত্যি শূন্য সহিষ্ণুতা দেখিয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবেও জঙ্গিগোষ্ঠী দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু সন্ত্রাস ও মাদকের ক্ষেত্রে শূন্য সহিষ্ণুতার কোনো প্রতিফলন নেই। মাদক নির্মূলের নামে বন্দুকযুদ্ধে যঁারা নিহত হয়েছেন, পরবর্তীকালে দেখা গেছে তঁাদের অনেকেই নিরীহ মানুষ। অপরাধী হলেও বিচার করেই শাস্তি দেওয়া যেত। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিনহা হত্যার বিষয়টি ফাঁস হওয়ার আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী স্বীকারই করেনি যে বিচারবহির্ভূত হত্যা হয়েছে। সিনহা হত্যার পর বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা অনেকটাই কমে এসেছে।
আওয়ামী লীগের ইশতেহারে পাঁচ বছরে ১ কোটি ২৮ লাখ কর্মসৃজনের পরিকল্পনা নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। সে ক্ষেত্রে তিন বছরে প্রায় ৮০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হওয়ার কথা। অর্থনীতিবিদদের মতে, বছরে ৭ থেকে ৮ লাখের বেশি লোকের চাকরি হয়নি। বর্তমানে দেশে সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠীর নাম বেকার। তদুপরি সরকার যেসব মেধাবী তরুণ বিসিএস পরীক্ষায় পাস করেছেন, তাঁদের একাংশকে চাকরি দিচ্ছে না রাজনৈতিক কারণে। মেধাবী তরুণদের প্রতি এটি নিষ্ঠুরতাই বটে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল পার্বত্য শান্তি চুক্তির যেসব ধারা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি, সেগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে। চুক্তি হয়েছে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর। এখনো উদ্যোগ নেওয়ার মধ্যে সরকারের কার্যক্রম সীমিত। সেখানকার ভূমির মালিকানা সমস্যার নিষ্পত্তিতে গঠিত ভূমি কমিশন এখন পর্যন্ত কাজ শুরু করতে পারেনি। আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুত জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন কিংবা সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব ধরনের আইন ও ব্যবস্থার অবসানও হয়নি।
ইশতেহারের ৩.৩ অনুচ্ছেদে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চর্চায় সাংবাদিকদের উৎসাহ প্রদান ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, পেশাগত দায়িত্ব পালনে সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং গণমাধ্যমবান্ধব আইন করার কথা বলা হয়েছিল। সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে কোনো আইনের অপপ্রয়োগ হবে না বলেও অঙ্গীকার ঘোষণা করেছিল দলটি।
কিন্তু বাস্তবতা হলো যতই দিন যাচ্ছে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা দূরে থাক, সাংবাদিকতা করাই করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। তথ্য অধিকার আইন করে সরকার সাংবাদিকদের তথ্য পাওয়ার যেটুকু সুযোগ দিয়েছিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে এ মামলা করা হলেও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেই বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকার অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের প্রতি কী ধরনের আচরণ করে, প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রাখা, হয়রানি করা, অফিশিয়াল সিক্রেসি আইনে মামলাই তার প্রমাণ।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের অনেক সাফল্য আছে। পদ্মা সেতুসহ অনেক বড় বড় প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলেছে। বাস্তবসম্মত নীতি-পরিকল্পনার কারণে করোনার ধাক্কাও অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যে মূল ভিত্তি গণতন্ত্র, তা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আরও দুর্বল হয়েছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এটাই আওয়ামী লীগের ওয়াদার বড় বরখেলাপ বলে মনে করি।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি