জাতীয় সঞ্চয় প্রকল্পের অধীনে সঞ্চয়পত্র বিক্রির মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বল্প সঞ্চয়কারীদের বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি। বর্তমান এই প্রকল্পের অধীনে যেসব সঞ্চয়পত্র বিক্রি করা হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, পরিবার সঞ্চয়পত্র ও পেনশনার সঞ্চয়পত্র। এসব সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ব্যাংকিং খাত থেকে বেশি। কেবল খুদে নন, বৃহৎ সঞ্চয়কারীরাও এর প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন। একশ্রেণির ধনাঢ্য ব্যক্তি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে ব্যবসা করতেন বলেও অভিযোগ আছে। ফলে যাঁদের উদ্দেশ্যে এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, সেই স্বল্প সঞ্চয়কারী তথা অবসরভোগী ও স্বল্প আয়ের মানুষগুলো বঞ্চিত হন।
এই প্রেক্ষাপটে সরকার ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে প্রথম সঞ্চয়পত্রের বিক্রির লাগাম টেনে ধরে। ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) থাকা, অনলাইনে সঞ্চয়পত্র কেনা, মুনাফার ওপর কর আরোপ, এক নামে বেশি না কেনাসহ বিভিন্ন শর্ত আরোপ করা হয়। এসব বিধিনিষেধের বেশির ভাগই সমর্থনযোগ্য। স্বল্প সঞ্চয়কারীদের এই প্রকল্পে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা ভাগ বসাবেন, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তবে স্বল্প সঞ্চয়কারীদের কিছু বাস্তব সমস্যাও সরকারের আমলে নেওয়া উচিত বলে মনে করি। এক লাখ টাকার ওপর সঞ্চয়কারীদের ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নম্বর বা টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু যেসব অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষক ও নারী প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকেন, সেসব এলাকায় আয়কর অফিস বা অনলাইন–সুবিধা কোনোটিই নেই। তাঁদের টিআইএন নিতে শহরে যেতে হয়। ফলে তাঁরা চাইলেও টিআইএন সংগ্রহ করতে পারেন না। এ কারণেও সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমে থাকতে পারে। আরেকটি সমস্যা হলো সরকার পাঁচ লাখ টাকার ওপর সঞ্চয়পত্রের লাভের ওপর ১০ শতাংশ কর কেটে নিচ্ছে। এই সীমা বাড়িয়ে ১০ লাখ টাকা করলে স্বল্প সঞ্চয়কারীরা উপকৃত হবেন।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে দেখা যায়, এক বছরের ব্যবধানে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে ৩৫ হাজার ৫১১ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা। আর বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিক্রি হয়েছে ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। গত পাঁচ বছরে এটাই সবচেয়ে বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়া। করোনাকালে অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খেয়েছেন বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এটি সুখকর সংবাদ নয়। তাই স্বল্প আয়ের মানুষ তথা অবসরভোগী, নারী ও বয়স্ক ব্যক্তিদের কথা চিন্তা করে সরকারের উচিত হবে সঞ্চয়পত্র কিনতে জনগণকে উৎসাহিত করা। অবসরজীবনে কিংবা বৃদ্ধ বয়সে অনেকের এটাই প্রধান আয়ের উৎস।
অতএব, সঞ্চয়পত্রকে কেবল আয়-ব্যয়ের অঙ্কে দেখা সমীচীন হবে না। খুদে সঞ্চয়কারীদের কাছ থেকে সরকার যে অর্থ পায়, সেটি দেশের উন্নয়নের কাজেই ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্যাংকের মাধ্যমে সঞ্চয়পত্র কেনার যে সুবিধা সরকার করে দিয়েছে, তার ইতি-নেতি দুটোই আছে। ইতিবাচক দিক হলো সঞ্চয়কারীরা হাতের কাছেই সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগ পাচ্ছেন। তবে অনেক ব্যাংক সঞ্চয়পত্র কেনার সনদ দিতে দেরি করে বলে গ্রাহকদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়েও সরকারের দৃষ্টি দেওয়া উচিত।