যে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে হামলার শিকার হলেন, পুলিশের মার খেলেন; তাঁদের মাথার ওপর এখনো মামলার খড়্গ ঝুলছে। অথচ গত বছর যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমেছিলেন, সেই বাসচাপার ঘটনায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া ও রাজীব হত্যা মামলার বিচার হয়েছে। বিচারিক আদালতে অপরাধীরা শাস্তিও পেয়েছেন।
শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছিলেন ন্যায়বিচার চেয়ে সড়কে নৈরাজ্য বন্ধের দাবি জানিয়ে। দিয়া-রাজীব হত্যা মামলার রায় এসেছে সেই আন্দোলনের পথ ধরেই। অথচ দুর্ভাগ্যজনকভাবে আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত কিছু শিক্ষার্থী ১৬ মাস ধরে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। মামলায় অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের তিনজন হাজিরা থেকে রেহাই পেলেও বাকি ২৫ জনকে প্রতি মাসে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। ঘটনার ১৬ মাস পার হলেও পুলিশ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। তারা আদালতে অভিযোগপত্রও দিতে ব্যর্থ হয়েছে। মামলা থাকায় অনেকে পাসপোর্ট করাতেও পারছেন না। এটি শুধু ন্যায়বিচারের পরিপন্থী নয়, মানবাধিকারেরও লঙ্ঘন।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দেশবাসীর সমর্থন পেয়েছিল। সাধারণ নাগরিকেরাও তাদের সমর্থনে রাস্তায় নেমে এসেছিল। অভিযুক্ত শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁদের প্রতি অনেকে সহানুভূতিশীল থাকলেও এখন আইনি লড়াইটা চালাতে হচ্ছে নিজেদেরই। মামলার খরচ চালাতেও অনেকে হিমশিম খাচ্ছেন।
গত বছরের ২৯ জুলাই জাবালে নূর পরিবহনের বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া খানম নিহত হওয়ার পর স্কুল–কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ৯ দফা দাবিতে আন্দোলনে নামেন। ৪ আগস্ট বিভিন্ন স্থানে সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হেলমেট পরে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালান। এর বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে অবরুদ্ধ অবস্থায়ই পুলিশের হামলার শিকার হন। এরপরও ‘সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ’ এনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ ছাত্রসহ শত শত শিক্ষার্থীকে আসামি করা হয়। অন্যদিকে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে মামলা হয় বুয়েটের শিক্ষার্থী দাইয়ান নাফিস প্রধানসহ ৪০ জন এবং অজ্ঞাতনামা অনেকের বিরুদ্ধে।
কেউ আইন ভঙ্গ করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমেছিল সড়কে আইন প্রতিষ্ঠার দাবিতে। তারা উল্টো পুলিশ ও সরকার সমর্থক হেলমেট বাহিনীর হামলার শিকার হয়েছেন। হেলমেট বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, কিন্তু মামলা হয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে। দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, শিগগিরই মামলার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে ১৬ মাস পার হয়ে গেছে। এই দীর্ঘ সময়েও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় এটাই পরিষ্কার যে মামলার পক্ষে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ নেই। ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কোনো কোনো মহল গুজব সৃষ্টি করেছিল, তা মিথ্যা নয়। কিন্তু দীর্ঘ সময় পার হলেও গুজব সৃষ্টিকারীদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। সন্দেহভাজন হিসেবে যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাঁদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগও প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটি ন্যায়সংগত ছিল বলেই সরকার তাঁদের দাবি বিবেচনায় নিয়ে নতুন সড়ক পরিবহন আইন করেছে। বিলম্বে হলেও সেই আইন কার্যকর শুরু হয়েছে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলার বিষয়টি সব মহলে গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে। সর্বোপরি বাসচাপায় দিয়া-রাজীবের মৃত্যুর ঘটনার বিচারও হয়েছে। এই সবগুলোই শিক্ষার্থীদের নিরাপদ ছাত্র আন্দোলনের সুফল। আমরা মনে করি, বর্তমান বাস্তবতায় শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো ঝুলিয়ে রাখার আর কোনো যুক্তি নেই। আমরা আশা করব, সরকার অবিলম্বে মামলাগুলো তুলে নিয়ে এই শিক্ষার্থীদের হয়রানি থেকে মুক্তি দেবে।