‘কোনো কাজই ছোট নয়’—শৈশবে পাঠ্যবই থেকে মুখস্থ করা এই বাণীর মর্মার্থ বিশ্ববিদ্যালয় পার হওয়ার পর ভুলে যাওয়া এই দেশের একটি অতি প্রাচীন ‘রেওয়াজ’। এমএ পাস করে একটা চাকরির জন্য বছরের পর বছর ঘুরে জুতার সুকতলা ক্ষয় করাকে এখনো এই সমাজ কায়িক শ্রম বা অন্য যে কোনো ‘ছোট কাজ’ করার চেয়ে অধিক মর্যাদার আসনে বসিয়ে রেখেছে। চেয়ার-টেবিল, কম্পিউটার ইত্যাদি সজ্জিত একটি অফিসের বাইরেও যে একজন উচ্চশিক্ষিত লোকের কর্মস্থল হতে পারে, সে ধারণা এখনো এ দেশে প্রতিষ্ঠা পায়নি। ঔপনিবেশিক আমল থেকে শিক্ষার্থীকে পাঠমনস্ক করতে অভিভাবকেরা শুনিয়ে এসেছেন ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে’। সে কারণেই শিক্ষার্থীর মননে এ ধারণা প্রোথিত হয়ে যায়, ‘অফিসার হওয়াই শিক্ষার মূল মোক্ষ’।
অত্যন্ত আশার কথা, নতুন প্রজন্মের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে প্রকৃত শিক্ষার উন্মেষ দৃশ্যমান হচ্ছে। বহু তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেওয়ার পর গ্রামে ফিরে প্রান্তিক শ্রেণির উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছেন। কেউ মাছের খামার করছেন। কেউ একেবারে ছোট পরিসরে বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদ করছেন। কেউ কুটিরশিল্পের দিকে ঝুঁকছেন।
শিক্ষিত তরুণদের উজ্জীবিত করবে এমন উদাহরণ দেখিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার প্রাক্তন ছাত্র ইয়াসির আরাফাত এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করা শিক্ষার্থী আহামেদউল্যাহ।
ইয়াসির আরাফাত পড়াশোনা শেষ করে চাকরির পেছনে না ঘুরে শুরু থেকেই নিজে কিছু করার চেষ্টা করেছেন। তিনি এখন গরুর খামার ও ঘাসের চাষে ব্যস্ত। এখন তাঁর ঘরে বেড়ে উঠছে হাইড্রোফনিক ঘাস, মাঠে হচ্ছে চীন থেকে আনা দ্রুত বর্ধনশীল জারা-১ জাতের ঘাস আর খামারে ব্রাহামা জাতের গরু।
আহামেদউল্যাহ শুরু করেছেন মাছের ব্যবসা। তাঁর বাড়ি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের ইংরেজি ভাষা বিষয়ের সদ্য স্নাতক এই তরুণ ফেসবুকে ‘ইলিশের বাড়ি’ নামের একটি পেজ খুলে ইলিশ মাছের ব্যবসা শুরু করেছেন। শুরুতে পরিবার থেকেই আপত্তি উঠেছিল। কিন্তু তিনি দমে যাননি।
আরাফাত ও আহামেদউল্যাহর এই স্পৃহা বৃহৎ পরিসরের সমাজ পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার লক্ষ্য সম্পর্কিত সামাজিক ধ্যানধারণা বদলানোর জন্য যে দাবানল দরকার, আরাফাত ও আহামেদউল্যাহরা তার সূচনাকারী স্ফুলিঙ্গ। এই স্ফুলিঙ্গদের নির্বাপণ নয়, উদ্যাপন জরুরি।