প্রতিবছর বন্যার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে
>বাংলাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ এবার বন্যার কবলে পড়েছে। বাংলাদেশের এ বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। এবারের বন্যার নানা দিক, বন্যা ব্যবস্থাপনা এবং ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের জন্য সহায়তা ও ত্রাণ কার্যক্রম নিয়ে এই সাক্ষাৎকার ছাপা হলো। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলামের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইফতেখার মাহমুদ
প্রথম আলো: এ বছরের বন্যার ধরনটি কেমন দেখতে পাচ্ছেন?
সাইফুল ইসলাম: বাংলাদেশে প্রতিবছরই ২০ থেকে ২৫ শতাংশ এলাকা বন্যায় ডুববে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে, এটাই এখানে স্বাভাবিক। কিন্তু যখনই তা ২৫ শতাংশের বেশি এলাকায় ছড়িয়ে যাবে, তখনই আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ি। আর বন্যার স্থায়িত্বকালও এক সপ্তাহের বেশি হলে তা আমাদের জন্য সমস্যা বাড়িয়ে দেয়। এ ধরনের বন্যা সাধারণত আমাদের এখানে ২ দশমিক ৩৩ বছর পর আসে। কিন্তু পাঁচ বছর ধরে আমরা দেখছি ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় নিয়মিতভাবে বড় বন্যা হচ্ছে। এ বছরও স্থায়িত্বের দিক থেকে ১৯৯৮ সালের পর সবচেয়ে বড় বন্যা হতে যাচ্ছে।
প্রথম আলো: কেন বন্যা বাড়ছে, মূল কারণ কী বলে মনে হয়?
সাইফুল ইসলাম: মূলত বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এটা হচ্ছে। বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে বৃষ্টি বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় পলি পড়ার পরিমাণ আগের চেয়ে বাড়ছে। ফলে নদীগুলোর পানি ধারণক্ষমতা কমে আসছে। এ কারণে উজানের ঢল এলেই তা দ্রুত বন্যায় পরিণত হচ্ছে। বুয়েটের এক সাম্প্রতিক গবেষণায় আমরা দেখেছি, সামনের দিনে ব্রহ্মপুত্রে বৃষ্টি ও পলি পড়ার পরিমাণ বাড়বে। ফলে আমাদের হয়তো প্রায় প্রতিবছরই এ ধরনের বন্যার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নিতে হবে।
প্রথম আলো: শুধু কি প্রাকৃতিক কারণে বন্যা বাড়ছে, নাকি আমাদের কোনো সরাসরি ভূমিকা আছে?
সাইফুল ইসলাম: জলবায়ু পরিবর্তন তো পরোক্ষভাবে মানুষের নানা তৎপরতার কারণেই হচ্ছে। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে আমরা নদীর মধ্যে এর প্রাকৃতিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে নানা অবকাঠামো নির্মাণ করে যাচ্ছি। ৫০ বছরে আমরা উপকূলীয় বেড়িবাঁধ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, উজানে বন ধ্বংস করা, দ্রুত নগরায়ণসহ নানা কারণে নদী অববাহিকাগুলোতে একটি বড় বদল হয়েছে। সেগুলো বন্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
প্রথম আলো: আমাদের এখানে বন্যার সময়কাল বৃদ্ধির জন্য নদীর মধ্যে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণকে অনেকে দায়ী করেন?
সাইফুল ইসলাম: আমাদের এখানে নদীর মধ্যে ৭ হাজার ৫৫৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আছে। নদীগুলোতে ৭ হাজার ৯০৭টি পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। ৩ হাজার ২০৫টি নিষ্কাশন নালা নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক রাখতে হলে আমাদের নদীগুলোকে নিয়মিত ও সঠিকভাবে খনন করতে হবে। উজানের দেশ ভারতের সঙ্গে যৌথ নদীগুলোর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। বন্যা পূর্বাভাস ব্যবস্থার আরও উন্নতি ও আধুনিকায়ন করতে হবে। আর বন্যা ব্যবস্থাপনার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষের জীবন বাঁচানো।
প্রথম আলো: আমাদের বন্যা অবকাঠামোগুলো বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে?
সাইফুল ইসলাম: না, পারছে না। অবকাঠামো নির্মাণভিত্তিক সমাধান সব সময় কাজ করছে না। কারণ, এসব অবকাঠামো আমাদের নদীগুলোর প্রাকৃতিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে বন্যার প্রবণতা অনেক ক্ষেত্রে বাড়িয়ে দিয়েছে। আর বন্যানিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের এখানে মূলত বড় শহর, বন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেটিরও দরকার আছে। কিন্তু আমাদের গ্রামের মানুষেরা কীভাবে বন্যার সঙ্গে বসবাস করবে, তার একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা আমাদের করতে হবে। আগে আমাদের এখানে বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোর মানুষেরা বাড়িঘর উঁচু করে নির্মাণ করত। বন্যা এলে যাতে বাড়িতে পানি ঢুকতে না পারে। এখন সেটি আমরা দেখছি না। সেটি করতে হবে। নদী-খাল ও অন্যান্য জলাশয়ের মধ্যে যে আন্তসংযোগ ছিল, তা পুনরায় স্থাপন করতে হবে। শুধু অবকাঠোমা নির্মাণ করে বন্যা মোকাবিলা করা যাবে না।
প্রথম আলো: সামনের দিনগুলোতে আমাদের বন্যার জন্য আর কী প্রস্তুতি নেওয়া দরকার?
সাইফুল ইসলাম: সবচেয়ে যে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে, তা হচ্ছে আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব মাথায় রেখে এখানে বন্যা ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। আগামী ১০০ বছরে আমাদের নদী অববাহিকাগুলোতে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে, তা মাথায় রেখে আমাদের অবকাঠামোগুলোকে পুনর্বিন্যাস করতে হবে, নদীর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে। আর বন্যা ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত না করে কোনো উদ্যোগ নিলে তা সফল হবে না।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
সাইফুল ইসলাম: আপনাকেও ধন্যবাদ।