আমাদের বর্ণবাদী মন

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

কয়েক সপ্তাহ আগে চট্টগ্রামে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ক্রিকেট খেলার সময় ঘটনাটি ঘটে। মাঠের প্রান্ত ঘেঁষে ফিল্ডিং করছিলেন দুজন কালো বর্ণের দক্ষিণ আফ্রিকার খেলোয়াড়। গ্যালারি থেকে কিছু দর্শক—তাঁদের মধ্যে ছেলে-বুড়ো সবাই ছিলেন—কুৎসিত ভাষায় তাঁদের দিকে মন্তব্য ছুড়ে দেন। কেউ কেউ তাঁদের ‘ব্ল্যাকি ব্ল্যাকি’ বলে সম্বোধন করেন। কাগজের ঠোঙা, কলার খোসাও থেকে থাকতে পারে। যাঁরা ‘ব্ল্যাকি ব্ল্যাকি’ বলে চেঁচাচ্ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই কৃষ্ণবর্ণের। ব্যাপারটা এত দূর গড়ায় যে দক্ষিণ আফ্রিকার খেলোয়াড়েরা জানিয়ে দেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে আসবেন। ম্যাচ আম্পায়ারও খেলা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল বর্ণবাদকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দেয় না, তা খেলার মাঠেই হোক বা বাইরে। শেষ পর্যন্ত ক্রিকেট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে খেলা বন্ধ হয়নি বটে, কিন্তু সেদিন সেই মাঠে সভ্য জাতি হিসেবে আমাদের সম্ভ্রম অনেকটাই হারিয়েছিলাম।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড তাদের ব্যাখ্যায় ব্যাপারটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ও কিছু ছেলে-ছোকরার কাণ্ড বলে উল্লেখ করে। দর্শকদের কাছে তাদের অনুরোধ ছিল, কেউ যেন এমন কিছু না করে, যার ফলে খেলাই পণ্ড হয়ে যায়। প্রথম আলোতে আনিসুল হক উপসম্পাদকীয় লিখে দর্শকদের কাছে অনুরোধ জানান, তাঁরা যেন এমন কিছু না করেন, যাতে দেশের বদনাম হয়।
ক্রিকেট বোর্ড সমস্যার গভীরে না গিয়ে তা এড়িয়ে গেছে। ব্যাপারটা যেমন শুধু ছেলে-ছোকরার নয়, তেমনই তাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়েও দেওয়া যায় না। কালোর প্রতি প্রবল বর্ণবিদ্বেষ আমাদের মজ্জাগত। কালোর প্রতি শুধু গভীর অপছন্দ নয়, সম্ভবত ঘৃণাও রয়েছে। আমাদের দেশে কালো মেয়ের বিয়ে হয় না, আর বিয়ে হলেও শাশুড়ির গঞ্জনার শেষ নেই। চৌপহর কানের কাছে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির বিজ্ঞাপন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কালো রং কতটা অপয়া। ছেলে হোক বা মেয়ে, ঘষে ঘষে নিজের কালো রং তুলে ফেলে ফরসা করার সবার কী প্রাণান্ত চেষ্টা!
কালোর প্রতি আমাদের এই অবজ্ঞা শুধু গায়ের রং নিয়ে নয়, পুরো একটা মহাদেশের মানুষের প্রতিই। আফ্রিকার কালো মানুষদের প্রতি আমাদের বৈষম্যপূর্ণ এই মনোভাব যে কত তীব্র, তা আরও স্পষ্টভাবে টের পাওয়া গেল সপ্তাহ দুয়েক আগে, এক সাংসদের ভাষ্য থেকে। ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ নামের এই সাংসদ কঙ্গোতে গিয়েছিলেন আমাদের শান্তিরক্ষী বাহিনীর কাজকর্ম সরেজমিনে তদারক করতে। ফিরে এসে সাংবাদিক ডেকে তিনি যা বললেন, তার মর্মার্থ এই রকম: আফ্রিকার মানুষ অসভ্য, এতটাই অসভ্য যে তারা নিয়মিত গোসল পর্যন্ত করে না। আমরা সেখানে গেছি বর্বর আফ্রিকানদের সভ্য করতে, তাদের যুদ্ধ ঠেকাতে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা সেখানে ছিলেন, কেউ প্রতিবাদে রা-টি পর্যন্ত করেননি।
সাংসদের এই বক্তব্য কেন ভ্রান্ত, তার ব্যাখ্যায় গিয়ে সে মূর্খতাকে সম্মানিত করতে চাই না। বস্তুত যে মনোভাব থেকে কোনো কোনো দেশের মানুষ আমাদের ‘মিসকিন’ বলে উড়িয়ে দেয়, ঠিক সেই মনোভাব থেকেই পুরো একটা মহাদেশের মানুষকেই তিনি অসভ্য বলে লেবেল দিয়ে বসলেন। একে অজ্ঞতা বলে হেসে উড়িয়ে দিতে পারি, যেমন ক্রিকেট দর্শকদের কুৎসিত ব্যবহারকে ছেলে-ছোকরার কাণ্ড বলে উড়িয়ে দিতে পারি। কিন্তু সত্যি কথাটা হলো, কালো রং এবং কালো মানুষের প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের আশৈশবলালিত। ছোটবেলা থেকেই আমরা জেনে এসেছি সাদা রং হলো সাহেবদের, অর্থাৎ তাঁদের, যাঁরা আমাদের ওপর ছড়ি ঘোরান। তাঁরা হতে পারেন মোগল বাদশাহ, বোম্বেটে ইংরেজ বা হারমাদ, পাঞ্জাবি। মুখে যতই তাঁদের বিরুদ্ধাচরণ করি না কেন, আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা ওই ছড়ি ঘোরানো সাহেব হতে। উপনিবেশবাদী শাসনের অবসান হয়েছে, কিন্তু মনের মধ্যে ওই উপনিবেশবাদী মানসিকতার অবসান হয়নি। অবসান হয়নি আমাদের লালিত হীনম্মন্যতাবোধ। রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত মায়ের কালো ছেলে বলে নিজেকে নিজেই উপহাস করেছেন।
বর্ণবাদের ভিত্তিতে থাকে উপনিবেশবাদী নিপীড়ন। নিজের বর্ণবাদী শ্রেষ্ঠত্বের যুক্তিতে হিটলার পুরো ইহুদি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলেন। এমনকি শ্বেত বর্ণের ও নীল চোখের মানুষ তৈরির এক প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। হিটলার গেছেন, উপনিবেশবাদেরও অবসান হয়েছে, কিন্তু রয়ে গেছে ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি। সুন্দর কী, সে মানদণ্ডটা অনেক আগেই ঠিক করে দিয়েছেন বিদেশি সাহেব, উপনিবেশবাদী শাসক, আর আমরা বিনা বাক্যে তা-ই মেনে নিয়েছি। সুন্দর হতে হলে গায়ের রং ফরসা হতে হবে, নাক হবে টিকালো, চোখের রং সম্ভব হলে নীল। নিজে কালো হলেও বউ যেন হয় ফরসা, তাহলে পরবর্তী বংশধরেরা কালো হওয়ার লজ্জা থেকে রক্ষা পাবে। অথচ সত্যি কথাটা হলো আমরা বাঙালিরা অধিকাংশই কালো। দ্রাবিড় জাতিভুক্ত মানুষ হিসেবে সেটাই আমাদের রং। যে দু-চারজন ফরসা বা বাদামি, তাদের বংশে রয়েছে বিদেশি রক্ত। এসব বিদেশির কেউ ইউরোপীয়, কেউ মধ্যপ্রাচ্যের।

>ঔপনিবেশিক প্রভুর হাতে যে বর্ণবাদের শুরু, তাকে টিকিয়ে রেখেছে হলিউড-বলিউড। চট্টগ্রামের ক্রিকেট মাঠের দর্শক অথবা মান্যবর সাংসদ—তাঁরা সবাই সে বর্ণবাদকে টিকিয়ে রাখতে যাঁর যাঁর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন

শুধু আমাদের দেশেই নয়, খোদ আফ্রিকাতেও সে মহাদেশের মানুষ কালোকে নয়, সাদাকেই সেরা বলে জানে। কোনো আফ্রিকান শিশুকে সাদা আর কালো, এই দুই রকম পুতুল দিন, দেখবেন সে হাত বাড়াবে সোনালি চুলের ফরসা পুতুলটির দিকে। মনে মনে নিজেকে সে পুতুলের মতো সুন্দর ভাবতে চায়। সাদা শ্রেষ্ঠ, এই কথাটা তার কানের কাছে, চোখের ওপর অবিরাম পুনরুক্তি করে যাচ্ছে টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, প্রতিটি তথ্যমাধ্যম। কালোকে—নিজেকে—সে যদি ঘৃণা করে, তাতে বিস্ময়ের কী থাকতে পারে!
কালো মানুষদের মনের মধ্যে কালো রঙের প্রতি ঘৃণা কত তীব্র, তার এক নির্মোহ বিবরণ রয়েছে টনি মরিসনের উপন্যাস ব্লুয়েস্ট আইতে। যে কালো কিশোরীকে ঘিরে এই উপন্যাসের কাহিনি, সে আজীবন এই শিক্ষাই পেয়েছে যে সুন্দর মানে হলো সাদা গায়ের রং, আর নীল চোখ। তার জন্য সাদা শুধু সুন্দর নয়, সাদা মানে সম্মান, ভালোবাসা ও সামাজিক মর্যাদা। সাদা মানে জাতে ওঠা। সেই বিশ্বাস থেকে নিজের গর্ভজাত কালো মেয়েকে পর্যন্ত সে ঘৃণা করে।
মনের মধ্যে এই যে বর্ণবাদী উপনিবেশ, তাকে পরাস্ত করব কীভাবে? আমেরিকার ও আফ্রিকার কালো মানুষেরা সে জন্য খুব সচেতনভাবে ‘কৃষ্ণ চৈতন্য আন্দোলন’ (ব্ল্যাক কনশাসনেস মুভমেন্ট) গড়ে তুলেছে। গত শতাব্দীর তিরিশ ও চল্লিশের দশকে আফ্রিকান ও ক্যারিবীয় লেখক-বুদ্ধিজীবীদের সচেতন চেষ্টায় প্রথম জন্ম নেয় নেগরিচুড মুভমেন্ট। ‘আমি কালো এবং কালোই সুন্দর’, লিওপোল্ডসেংঘর প্রথম এই কথা উচ্চারণ করেন। তাঁদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমেরিকায় উন্মেষ হয় ভিন্ন এক রেনেসাঁর, যার পেছনে ছিলেন ল্যাংস্টন হিউজ ও মার্কাস হার্ভের মতো কবি ও বুদ্ধিজীবী। আরও পরে, ষাটের দশকে সে আন্দোলন সাহিত্য-শিল্পের বাইরে নাগরিক অধিকার ও মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এক ভিন্ন শক্তিতে পরিণত হয়। এই আন্দোলনের শীর্ষে ছিলেন স্টিভ বিকো, যিনি পৃথিবীর সব কালো মানুষকে আহ্বান করেন তাদের নিজের কালো রং, কালো সত্তা নিয়ে গর্বিত হতে।
বিকো শুধু আফ্রিকার মানুষদের নয়, ঔপনিবেশিক শ্বেত সভ্যতার থাবার বাইরে অন্য সব মানুষকেই এক ভিন্ন চৈতন্যে উজ্জীবিত হতে আহ্বান করেছিলেন। তাঁর কথায়, কালো মানুষকে কালো মানুষ হিসেবেই আত্মসম্মান অর্জন করতে হবে। যতক্ষণ না এই আত্মসম্মানে সে উজ্জীবিত হচ্ছে, শ্বেত অপরাধের সে-ও অংশীদার হয়ে থাকবে। এভাবেই শুরু হলো কালো মানুষের আত্ম-আবিষ্কারের আন্দোলন, কালো মানুষদেরই হাতে। তারা বলল, ‘আমি যেমনই হই, সেটাই সুন্দর।’ কালো মানুষকে তার হৃত সম্মান পুনরুদ্ধারে বিকোর এই চেষ্টার জন্য তাঁকে কঠোর মূল্য দিতে হয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারের হাতে তিনি খুন হয়েছিলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান হয়েছে। আমেরিকায় কালো মানুষের সমানাধিকার কাগজে-কলমে মেনে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু মনের ভেতর শ্বেত শ্রেষ্ঠত্বের অবসান হয়নি। ঔপনিবেশিক প্রভুর হাতে যে বর্ণবাদের শুরু, তাকে টিকিয়ে রেখেছে হলিউড-বলিউড। চট্টগ্রামের ক্রিকেট মাঠের দর্শক অথবা মান্যবর সাংসদ—তাঁরা সবাই সে বর্ণবাদকে টিকিয়ে রাখতে যাঁর যাঁর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।
আমরা যদি এই মানসিক বর্ণবাদের অবসান চাই, তাহলে সে পরিবর্তনের সূচনা হতে হবে আমাদের মনের ভেতরে, যার জন্য চাই সচেতন উদ্যোগ। লেখক, কবি, শিল্পীদের সে কাজে রয়েছে সবচেয়ে বড় ভূমিকা। প্রতিবেশী ভারতে, যেখানে সাদা রঙের প্রীতি সর্বজনবিদিত, শিল্পী ও লেখকদের হাতে শুরু হয়েছে ‘ডার্ক ইজ বিউটিফুল’ আন্দোলন। অন্য অনেকের সঙ্গে অভিনেত্রী নন্দিতা দাশ সে আন্দোলনে হাত মিলিয়েছেন। সমাজে যারা সবচেয়ে নন্দিত, তারাই যদি সুন্দর কী, তা নতুন করে ভাবতে শেখায়, একসময় আমাদের মনের মধ্যেও সে ধারণা স্থান করে নেবে।
নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।