স্মৃতির ঘরে ঘরে তোমার গান, এন্ড্রু কিশোর
এন্ড্রু কিশোরের কথা মনে পড়লে প্রথম গান শোনার স্মৃতির কথা মনে পড়ে।
মাঠের পারে দুটি বাড়ি। মাঠটা শেষ হয়ে ঝাঁপ দিয়েছে বড় এক পুকুরে। দুটি বাড়ির একটি মাঠ থেকে একটু ভেতরে—বাঁশঝাড়ে ঢাকা। অন্যটা পুকুর ঘেঁষে। আমার প্রথম গান শোনার স্মৃতি পুকুরপাড়ের বাড়িটায়। বয়স বড়জোর চার বছর হবে। দুপুরবেলা মা গোসল-খাওয়াদাওয়া সেরে হয়তো ঘুম দিতেন কখনো কখনো। সেই ফাঁকে আমি ছেলেটার স্বাধীনতা। আঙিনার কোণে একটা কুয়া সারা আকাশ কীভাবে বুকে ধরে রাখত, সেই রহস্যে চোখ রাখতাম। ভয়ও পেতাম। ঠিক দুক্কুরবেলা যখন ভূতে মারে ঢেলা, গা ছমছম করা সেই নির্জন দুপুরে কিছুতেই একা থাকতে পারতাম না। তারপর হয়তো টুকটুক করে চলে যেতাম পুকুরপাড়ের ওই বাড়িতে। নাম মনে নেই সেই বাড়ির বন্ধুটার। ওদের কয়েকটা বোন ছিল মনে আছে। আর ছিল রেডিও।
আমার প্রথম গান শোনার স্মৃতি ওই বাড়িটায়, ওই সব দুপুরে—মাঠের ধারে পুকুরপাড়ে। মনে আছে, ওদের বাইরের ঘরটায় চিত হয়ে বিছানায় শুয়ে গান শুনছি। সম্ভবত বন্ধুর বোনেরাই শুনত। নইলে আমাদের মতো পিচ্চির রেডিওতে গান শোনার কথা না। তখন রেডিও ভরপুর থাকত নতুন নতুন সিনেমার গানে। দুপুরবেলা রেডিওর ঘোষক জোরেশোরে আওয়াজ করে ঘোষণা করতেন, ‘শ্রোতা ভাই–বন্ধু–বোনদের অনুরোধের গান নিয়ে আসছে অনুরোধের আসর’ কিংবা সন্ধ্যাবেলা শোনা যেত, ‘এখন আপনারা শুনবেন সৈনিক ভাইদের জন্য অনুষ্ঠান দুর্বার’। অথবা চলত, ‘বিজ্ঞাপন তরঙ্গ’ কিংবা ‘গানের ডালি’। অনুরোধের আসরে দেশের কত কত জায়গা থেকে দর্শকেরা প্রিয় গানগুলো শোনানোর জন্য অনুরোধ করতেন চিঠি লিখে। তরুণ-তরুণীরাই বেশি ছিল সেসব অনুরোধের হোতা। চিঠি পাঠানো ব্যয়বহুল ছিল মনে হয়, তাই এক চিঠিতে বেশ কয়েকজনের অনুরোধ একসঙ্গে পাঠানো হতো। মনে পড়ে, খালিশপুর জায়গার নামটা বোধ হয় এ রকম কোনো অনুরোধ-পাঠানো চিঠির ঠিকানা থেকে জেনেছিলাম।
এ রকমই কোনো এক দুপুরে বোধ হয় শুনেছিলাম, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’। গানটা কার গাওয়া, কার লেখা কিচ্ছু তখন জানা ছিল না। খেয়ালও করা হয়নি। কিন্তু সুরটা মনে হয় কানে লেগে ছিল। গরমের দিনের দুপুরবেলা বিছানায় চিত হয়ে কয়েকটা শিশু ও তরুণী গান শুনছে, রেডিওতে যাঁর গলা বাজছে (পরে জেনেছি) তিনি এন্ড্রু কিশোর। আমার প্রথম গান শোনার স্মৃতির জনক সেই এন্ড্রু কিশোর গতকাল সোমবার প্রয়াত হলেন।
গান শুনলেই মাথায় গায়কের ছবি ভাসে না? ভাসে। আমার এখনো ভাসে। এন্ড্রু কিশোরের গলা শুনে মনে হতো মানুষটা দেখতে জানি কেমন। সত্যি বলছি, গলার সঙ্গে চেহারার মিলের সাধন কোনো দিন আমি করতে পারিনি। এন্ড্রু কিশোরের উদাত্ত রোমান্টিক বেহাগের সঙ্গে মোটেই তাঁর বাদশাহ শাহজাহান মার্কা দাড়ির ছবি মানাত না আমার মনে। তাঁকে রোদের দিনের উজ্জ্বল নায়ক মনে হতো। মনে হতো, বিবাগি কেউ যেন চলে যাচ্ছে অনেক দূরে। তাঁর যাওয়ার পথে রেখে যাচ্ছে সুরের ঝলমলে ফিতা। যতই করুণ সুরের গান গাইতেন না কেন, এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠের তাজা ভাবটা মোটেই মিলাত না। যেন একজন দুঃখের গরবে গরবিত কেউ পৃথিবীর দেওয়া দুঃখকে তুচ্ছ করে রোদের দিনের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে দূরে।
আরও পরে, যখন স্কুলে পড়ি, তখনকার একটা গান মনে ধরেছিল: ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, রইব না আর বেশি দিন তোদের মাঝারে’। এখানেও সেই চলে যাওয়ার বিষাদ। তবে স্কুলে আমরা এই গান নিয়ে মজাই করতাম। খেলার পিরিয়ডে কারও বাথরুম চাপলে সে গাইত, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে...’।
রেডিওর দিনের পরে আমাদের শৈশব তখন টিভিময়। শুক্রবার সকালে আমরা দেখতাম ‘টারজান’, আর মা-বাবারা রাতে দেখতেন ‘ছায়াছন্দ’। ঢাকাই সিনেমার গানের অনুষ্ঠান। সেখানেও দুটি গানের স্মৃতি খুব জ্বলজ্বলে, শাম্মী আক্তারের গাওয়া ‘ওই চাঁদ ডাকে ওই রাত ডাকে, আজ তুমি কোথাও’ আর এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলেই ঠুস’। শিল্পীদের নাম তো পরে জানা, তবে মনে রাখার কারণ বোধ করি দুটি গানেরই আধিভৌতিক আমেজ। আমার মনে হতো, কেউ মারা গেছে, চাঁদ আর রাত মিলে ডেকেও তাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। হায়রে মানুষ রঙিন ফানুসও মৃত্যুচিন্তার গান। কিশোর বয়সে বোধ হয় একবার করে মৃত্যুচিন্তা সবারই আসে। আমার মৃত্যুচিন্তার উদ্বোধনী সংগীত, সেই অর্থে, এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া।
এভাবে বেড়ে ওঠার একেকটি বেলায় এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া একেকটি গান আমার মতো অনেকের হাঁটি হাঁটি পায়ের একেকটি পদক্ষেপের দাগ ধরে আছে। যেমন তাঁর গাওয়া ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়, কেউ পায় কেউবা হারায়, তাতে প্রেমিকের কী আসে-যায়’ অনেক দিন হয়ে ছিল কচি তারুণ্যের বিষাদের কাব্য। কচি মনে এই গান এই বোধ জুড়েছিল যে, ভালবাসা কেবল পাওয়ার না, দেওয়ারও। কিশোরের গান আমাদের শৈশবের, তারুণ্যের একেকটি পর্বকে চিহ্নিত করে আছে। আমাদের কিশোরবেলার গানের রাজকুমারের নামটা তাই এন্ড্রু কিশোর। ঢাকাই সিনেমার গান মানেই তাই এন্ড্রু কিশোর। তাঁর একটা গান থাকলেই সিনেমা অনেকটা হিট। একটা সময় তো সুরকার আলম খান আর এন্ড্রু কিশোরের গলা, দুজনে দুজনার হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু এহেন রাজকুমারকেও চিকিৎসার জন্য হাত পাততে হয়েছে। তাঁকে মুম্বাইয়ে রেখে দিতে চেয়েছিলেন উপমহাদেশের গানের মায়েস্ত্রো আর ডি বর্মন। কিন্তু তিনি সে প্রস্তাব ফিরিয়ে ঢাকাইয়া শিল্পী হিসেবেই থেকে যেতে চেয়েছেন এবং সেটাই থেকে গেছেন আমৃত্যু। মুম্বাইয়ে গিয়ে তিনি দেখেছেন জনপ্রিয় গীতিকার, সুরকার, গায়ক-গায়িকার কী প্রতাপ, কী শানশওকত। অথচ এই ঢাকা আমাদের রাজকুমার আমাদের রাজকন্যাদের কী দিয়েছে? জনগণের অফুরান ভালোবাসা তাঁরা পেয়েছেন সত্য, কিন্তু জনসমক্ষে না থাকলেই সেই ভালোবাসাও মুখ লুকিয়েছে। রেডিও-টিভি ও ক্যাসেটের যুগে শীর্ষে থাকতেন এন্ড্রু কিশোর। একজন তো বলেইছেন, এন্ড্রু কিশোরের গান শোনার জন্য দেশে রেডিও বিক্রির ব্যবসা চাঙা হয়েছিল।
আমাদের সাবিনা ইয়াসমীন, রুনা লায়লা, আব্দুল জব্বার, সুবীর নন্দী, এন্ড্রু কিশোর, আব্দুল হাদী, খুরশিদ আলম, নীনা হামিদদের মধ্যে এন্ড্রু কিশোর ছিলেন রক আর মেলডি মেশানো বাংলার রোমান্টিক বিরহী ঘরানার শিল্পী। আফসোস, বাংলা গানের অপর দিগন্ত, পশ্চিম বাংলা এই উদয়ভূমির ‘উদিত দুঃখের দেশের গান’ খুব একটা চিনল না। ‘চিনলাই না তুমি চিনলাই না।’ এন্ড্রু কিশোরের তুলনা করতে হলে আরেক কিংবদন্তি কিশোর কুমারের সঙ্গেই হয়। বাংলা গানের মুক্তির একটা সুর যাকে তারা বলে পুর্ব বাংলা, তা সেই বাংলাদেশেই হয়েছে। এটা মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়েই হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর লোকের মুডই অন্য রকম হয়ে গেছে এই দেশে। সেই সপ্রাণতার, তেজবান গায়কি, একধরনের মুক্তির আসওয়াদ এন্ড্রু কিশোরের গলায় পাওয়া যায়। যেন বিরাট কোনো দুঃখ দিগন্তকে বাজায়ে চলে যাচ্ছে, কিন্তু তাঁর গলায় ফুর্তির, মুক্তির সুর। এন্ড্রু কিশোরের গান ঢাকার আধুনিকতার খুব লাবণ্যময় ও ধারালো গলার স্বাক্ষর। কবি আবুল হাসানের উদিত দুঃখের দেশে, ‘নবীন কিশোর’, তোমাকে বিদায়।
ফারুক ওয়াসিফ: কবি ও লেখক। প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক।
[email protected]