ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় যত ঘণ্টা আগে পূর্বাভাস দেওয়া যাবে, মানুষ তত বেশি প্রস্তুতি নিতে পারবে। উপকূলীয় জেলে ও কৃষির জন্য পূর্বাভাস জীবন–মরণের ব্যাপার। পূর্বাভাস যদি সাগর থেকে জেলেদের ফেরার বা ফসল বাঁচানোর সময় না দেয়, তাহলে অনেক মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি অনেক হয়।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পানের’ মাত্রা ৫ থেকে ৩–এ নেমে এসেছে। ঝড় মাপার সূচকে পঞ্চম শ্রেণির ঝড় ভয়াবহ। ১৯৯১ সালের প্রয়লংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পরে বঙ্গোপসাগরে এত শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আর সৃষ্টি হয়নি। বঙ্গোপসাগরের উষ্ণপানি অঞ্চলে ১৮ মে ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রের বায়ুর গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ২৬০ কিলোমিটার ও দমকা হাওয়া হিসাবে যা প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পৌঁছালেও বর্তমানে তা প্রায় ২০০ কিমিতে নেমেছে। উপকূলীয় তীরবর্তী শীতল পানির সংস্পর্শে এসে আম্পানের গতি আরও কমে আসতে পারে।
জলোচ্ছ্বাস ও বাতাসের বেগের বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এটা সিডরের কাছাকাছি। ফলে করোনা ও লকডাউনে পড়া উপকূলীয় জেলেসমাজ জীবিকার কঠিন সংকটে পড়বে বলে আশঙ্কা রয়েছে। গাণিতিক মডেলে এই ঝড় রাজশাহী পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ঘূর্ণিঝড় (প্রায় ১১৯ কিমি) হিসেবেই বিবেচিত বলে উত্তরাঞ্চলের আম ও বোরো ধানের ক্ষতির ভয় আছে।
আমাদের আবহাওয়া স্যাটেলাইট নেই
বঙ্গোপসাগরে একটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির সম্ভাবনার কথা প্রথম নির্দেশ করেছে আমেরিকান GFS মডেল। গত মাসের শেষ সপ্তাহে ঘনিয়ে ওঠা এই ঝড়ের ৪ মে স্থলভাগে আঘাত করার সম্ভাবনা ছিল। ভাগ্যিস ঘূর্ণিঝড়টি সেই সময় সৃষ্টি হয়নি। মে মাসের ১৪ তারিখে বঙ্গোপসাগরে বিভিন্ন দেশের অন্তত পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল এই পূর্বাভাস দিয়েছিল। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, সম্পূর্ণ নিখরচে পাওয়া এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে জানালে হাতে আরও সময় পাওয়া যেত। এ জন্য জনগণ ও সরকারকে যথেষ্ট সময় নিয়ে সতর্কতা জারি করতে পারে না। প্রস্তুতির সময় থাকে না বলে কৃষি ফলন, ধান কাটাসহ সার্বিক অর্থনীতি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাসে ব্যবহৃত দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রটি হলো কৃত্রিম উপগ্রহ। কিন্তু বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট শুধুই একটি টেলিযোগাযোগ স্যাটেলাইট। দুঃখের বিষয়, আমাদের একটা আবহাওয়া ও জলবায়ু পূর্বাভাসের উপযুক্ত স্যাটেলাইট নেই। বঙ্গবন্ধু–১ দিয়ে ছবি তোলা, ইমেজ প্রসেসিং, বন্যা পরিস্থিতি পরিমাপ, পানির উচ্চতা নির্ণয়, পানির তাপমাত্রা নির্ণয়, আবহাওয়া পূর্বাভাস, দূরত্ব পরিমাপ, নদীর নাব্যতা ও গতিপথ পর্যবেক্ষণ, জলাভূমির সংকোচন-প্রসারণ, রাস্তাঘাটের নিপুণ ডিজিটাল মানচিত্র, আর্থ অবজারভেটরি কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত কাজগুলো করা যাবে না। তবে আবহাওয়া অধিদপ্তরের একটি উচ্চমানের রাডার আছে মৌলভীবাজার জেলায়, পাশাপাশি বাংলাদেশ বিমানবাহিনী দুইটি রাডার পরিচালনা করে থাকে চট্টগ্রাম ও যশোর থেকে।
খুলনা–সাতক্ষীরার শীতল পানি সহায়
ঘূর্ণিঝড়টি ৩ মানের ঝড় হিসেবে উপকূলীয় এলাকায় আঘাত করবে বলে সর্বশেষ পূর্বাভাসে বলা হয়েছে। উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত সিআইএমএসএস আবহাওয়া উপগ্রহ সংস্থার সর্বশেষ পূর্বাভাস অনুসারে ঘূর্ণিঝড়টি যে পথে অতিক্রম করবে সেই স্থানের পানির তাপমাত্রা হবে প্রায় পুরো বঙ্গোপসাগরের মধ্যে প্রায় সর্বোচ্চ (৩০-৩২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড)। তবে আশার কথা, খুলনা ও সাতক্ষীরার উপকূলের পানি তুলনামূলক শীতল বলে ঝড়ের নতুন করে গতি প্রাপ্তির সম্ভাবনা কম।
ঘূর্ণিঝড় সম্ভাভ্যতা বা ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাব্য পথ বুঝতে সাহায্য করে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির তাপমাত্রা। ঘূর্ণিঝড় ও হ্যারিকেন সৃষ্টি হওয়ার জন্য প্রধানতম শর্ত হলো সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির তাপমাত্রা অবশ্যই ২৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা তার চেয়ে বেশি।
ঘূর্ণিঝড়টি পশ্চিমবঙ্গের দিকে কিছুটা সরে গেলেও আশান্বিত হওয়ার কিছু নেই। যেকোনো সময় আবারও বাংলাদেশের দিকে ঘুরে আসতে পারে। ইউরোপিয়ান ECMWF মডেলের ট্রপিক্যাল সাইক্লোন স্ট্রাইক প্রবাবিলিটি মানচিত্র অনুসারে ঘূর্ণিঝড়টির স্থলভাগে আঘাতের পথ কিছুটা উত্তর-পূর্ব দিকে বাংলাদেশের দিকে সরে যাবে। এখানে দেখা যাচ্ছে ঘূর্ণিঝড়টির অর্ধেকের বেশি অংশ সরাসরি খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলায় ওপর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের সম্ভাবনা শতকরা ৭০ শতাংশের বেশি।
সম্ভাব্য জলোচ্ছ্বাস ও বৃষ্টিপাত
আমেরিকার ওয়েভ ওয়াচ-৩ নির্দেশ করছে ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলে আঘাত হানার সময় ও পারে সমুদ্রের ঢেউয়ের উচ্চতা ২০ থেকে ৪০ ফুট উঁচু হতে পারে। ২১ মে অমাবস্যার রাত ও ঘূর্ণিঝড়টি অমাবস্যার রাতের দুই দিন আগে স্থলভাগে প্রবেশ করবে। এই সময়ে চন্দ্র-সূর্যের মিলিত টানে জোয়ার-ভাটার উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে। তাই ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পানের’ কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হবে, যার ফলে উপকূলীয় এলাকার অনেক অভ্যন্তরে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি প্রবেশ করবে ও অনেক এলাকা প্লাবিত হবে। ফলে নিশ্চিত করেই বলা যায় এই ঘূর্ণিঝড়টির কারণে কৃষি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে যদি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে স্থলভাগে প্রবেশ করে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ২২ মে পর্যন্ত সারা দেশের বৃষ্টিপাত হবে। ঈদের দিনেও দেশের অনেক অংশে বৃষ্টিপাত হবে।
প্রযুক্তি প্রাণ বাঁচায়
আবহাওয়া অধিদপ্তরের উচ্চ মানের একটি রাডার আছে মৌলভীবাজারে। কিন্তু রাডারটি বেশির ভাগ সময় বন্ধ থাকে। হাওরে ধান কাটতে গিয়ে বজ্রপাতে মারা গেল অনেকে অথচ এই রাডারটি ব্যবহার করে মোবাইল প্রযুক্তির মাধ্যমে ওই এলাকার কৃষকদের বজ্রপাতসহ কালবৈশাখীর পূর্বাভাস দিয়ে মৃতের সংখ্যা বেশ কমিয়ে আনা সম্ভব। বাংলাদেশ বিমানবাহিনী দুটি রাডার পরিচালনা করে থাকে যার একটি যশোর ও অন্যটি চট্টগ্রাম জেলায় অবস্থিত। ঘূর্ণিঝড় আম্পান উপকূলে আঘাত হানার কয়েক ঘণ্টা আগেই যশোর রাডারের মাধ্যমে তা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যশোর রাডার থেকে প্রাপ্ত চিত্র দেখে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা চিহ্নিত করে দ্রুত ত্রাণ পরিচালনা করতে পারেন।
মোবাইল মেসেজে আশ্রয় ও করণীয় জানানো
নিকটস্থ আশ্রয়কেন্দ্রের তথ্যসহ জরুরি সরকারি নির্দেশনা নিখুঁতভাবে মোবাইল সেবাদাতা কোম্পানি তার গ্রাহকদের জানাতে পারে। বিশেষ করে উপকূলীয় এবং ফলন নষ্টের ঝুঁকিতে থাকা এলাকার মানুষকে মেসেজের মাধ্যমে পাশে থাকা খুব কাজে দেবে। করোনাকালে এই বার্তায় যথাসম্ভব স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মানার বিষয়ও প্রাধান্য পেতে পারে। ঝড়ের পরে মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু রাখায় সর্বোচ্চ যত্ন রাখা হলে অনেক উপকার হবে।
পূর্বাভাস বিদ্যার হাল
বাংলাদেশে একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবহাওয়া পদার্থবিদ্যার ওপর অনার্স চালু করা হয়েছে ২০১৭ সালে—তা–ও একজনমাত্র শিক্ষক দিয়ে। আবহাওয়া অধিদপ্তরে আবহাওয়াবিদ হিসেবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিয়োগ দেওয়া হয় পদার্থ, রসায়ন ও পরিসংখ্যান স্নাতকদের। আবহাওয়াবিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি বা গবেষণাও কম। প্রায় ৩০ বছর আগের মানের পূর্বাভাস নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তথ্যের সঠিকতা প্রশ্নযুক্ত থাকায় পূর্বাভাস না মানার একটা সংস্কৃতি চালু হয়েছে, যা আরও খারাপ ফল বয়ে আনে। পূর্বাভাস শতভাগ সঠিক হয় না, তবে সম্ভাব্য বিপদের প্রস্তুতি নেওয়ার নাগরিক ও সরকারি চর্চা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মোস্তফা কামাল পলাশ: আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক পিএইচডি গবেষক। [email protected]
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক লেখক, গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ