ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বেঠিক প্রতিক্রিয়া ও 'অনুকরণের' ভয়
লকডাউনের মধ্যেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাওলানা জুবায়ের আনসারির জানাজায় লাকো মানুষের সমাবেশ ঘটেছে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বিশ্লেষণ চলছে। এ রকম একটি নজরকাড়া ঘটনার বিশ্লেষণ চলাই স্বাভাবিক। না চলাই বরং জনগণকে বেশি ধাঁধায় ও অস্বস্তিতে ফেলবে। কিন্তু বিশ্লেষণের আড়ালে কিছু বিপজ্জনক সামাজিক সংবেদনহীনতারও যে বিস্তার ঘটছে, সে বিষয়ে সতর্কতা দরকার। সামাজিক মাধ্যমেই যেহেতু বিষয়টি বেশি সাড়া ফেলেছে, বিপজ্জনক ভাবনাগুলোর উৎপত্তিও ঘটছে সেখানেই।
একদল সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সব অধিবাসীকে নিয়ে কৌতুক-রগড়-ট্রলিং করছেন। এসব মজা-মাস্তিকে খোলা চোখে নির্দোষ কৌতুক মনে করা হলেও বেশ কিছু লেখায় আঞ্চলিকতাবাদী ভেদবুদ্ধিজনিত ঘৃণাভাবটি, কিছু লেখায় মাদ্রাসাবিরোধী এবং ইসলামবিদ্বেষী ঘৃণাভাবটি প্রকট। অনেক কৌতুক মাত্রা ছাড়িয়ে বর্ণবাদী ঘৃণায় রূপ নিচ্ছে। অনেকেই জেলাটিকে অপরাধপ্রবণ, আইনবিরোধী এবং হানাহানি ও বিবাদমনস্ক একটি অন্য ধাতের সমাজরূপে দেখানোর চেষ্টা করছেন। এই অঞ্চলের মানুষের স্বভাবে আরও নানা রকম নেতিবাচকতা জুড়ে দিয়ে একটি আঞ্চলিক জনগোষ্ঠীর বিচিত্রতর চরিত্রচিত্রণের প্রতিযোগিতায়ও নেমেছেন কেউ কেউ।
নৃবিজ্ঞানে ‘এথনোসেন্ট্রিজম’ বা ‘স্ব-সংস্কৃতিশ্লাঘা’ বলে যে ধারণাটি আছে, ঠিক সেটিরই প্রকাশ ঘটছে নানা উদাহরণে। এ রকম শ্লাঘার চরিত্রই এমন যে এথনোসেন্ট্রিক ব্যক্তি নিজেকে ‘উচ্চ সংস্কৃতি’র ধারক ধরে নিয়ে ‘আদার’ বা অন্যকে ‘নীচু সংস্কৃতির’ ধারক দেখানোর একধরনের চেষ্টা চালান। এই ‘আদারিং’ বা ‘অপরকরণের’ সামাজিক কুফল অনেক। এমনিতেই বাংলাদেশের মতো ছোট্ট একটি অঞ্চলেই নোয়াখালী, বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেট, উত্তরবঙ্গ, ঢাকাইয়া ইত্যাদি–সংক্রান্ত আঞ্চলিকতাবাদনির্ভর পূর্বধারণা ও কুসংস্কারের কমতি নেই। একটি জানাজাকে উপলক্ষ করে এথনোসেন্ট্রিজম যেন নতুন রূপে ঝাড়ে-বংশে বেড়ে উঠতে না পারে, সেই সংবেদনশীলতাটি অত্যন্ত প্রয়োজন।
লক্ষণীয়, নরসিংদী, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম এবং ঢাকা থেকেও অনেক মানুষ জানাজায় শরিক হয়েছেন। তাঁরা সবাই ফরজে কেফায়ার মতো একটি গৌণ ফরজ আদায় করতেই এতটা ঝক্কি-ঝামেলা সয়েছেন—এই অনুসিদ্ধান্তে বিশ্বাস রাখা কষ্টসাধ্য। গায়েবি জানাজাও পাঠ করা যায়। অনলাইনে লাইভস্ট্রিম করে সবাইকে নিজ নিজ ঘরে রেখেও হয়তো জানাজাটি পড়ানো যেত!
একটি জিজ্ঞাসার উত্তর খোঁজা যাক। খোলা চোখে আমাদের ভাবনা এই, সব মানুষই শুধু জানাজায় শরিক হতে গিয়েছেন। ধারণাটি কি সম্পূর্ণ নির্ভুল? সম্ভবত না। ‘ক্রাউড সাইকোলজি’ বা জনসমাগমের মনস্তত্ত্বকে বিবেচনায় নিলে হয়তো দেখা যাবে, অনেকেই জানাজার উদ্দেশ্যে যাননি। হতে পারে লকডাউন নামের বিনা অপরাধে শাস্তির মতো দমবদ্ধ ও একঘেয়ে অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে খোলা বাতাসে যাওয়ার সুযোগটি নিয়েছেন। কেউ কেউ হয়তো জরুরি টাকাপয়সা লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের চুক্তির সময় মানা, দলিলে বা দরকারি কাগজপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে আনা বা অসম্পূর্ণ রয়ে যাওয়া কাজ শেষ করার ঝামেলাগুলো মিটিয়ে নিয়েছেন জানাজার সমাবেশের সুযোগে।
এ রকম ধারণা করার সমাজবিজ্ঞানসম্মত কারণ রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লকডাউনের ঘোষণার অব্যবহিত পর হতেই বিশ্বের সেরা ৪০ জন মনোবিজ্ঞানী লকডাউনের প্রতি মানুষের প্রতিক্রিয়ার একটি অ্যাকশন রিসার্চ (শিক্ষণ গবেষণা) চালিয়ে যাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া ও ব্রাজিলের এই ডাকসাইটে সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণাটির শিরোনাম ‘কোভিড-১৯ প্রতিরোধে সমাজবিদ্যা ও আচরণশাস্ত্রের প্রায়োগিক সহযোগিতা’ (ইউজিং সোশ্যাল অ্যান্ড বিহ্যাভিয়ারাল সায়েন্স টু রেসপন্স কোভিড-১৯ প্যান্ডেমিক সাপোর্ট)। গবেষণাটির এই পর্যন্ত পাওয়া সিদ্ধান্ত এই যে ‘যদি লকডাউন পদ্ধতিকে দারুণ অর্থবহ ও গ্রহণযোগ্য করা না যায়, যেকোনো ছুঁতো, সুযোগ বা ফাঁকফোকর পেলেই মানুষ লকডাউন ভাঙবে। বাইরে বেরোবে।’
গবেষণাটি জানাচ্ছে, লকডাউন অর্থবহ ও গ্রহণযোগ্য করা এবং টিকিয়ে রাখা সম্ভব দুই উপায়ে। এক, ঘরবন্দী হয়ে থাকার পুরস্কার (রিওয়ার্ড) থাকতে হবে। যাতে বিষয়টিকে যন্ত্রণাদায়ক মনে না হয়। দুই, ‘প্রত্যাশামুখী পক্ষপাত’ (অপ্টিমিজম বায়াস) তৈরি করতে হবে। অর্থাৎ, লকডাউনের ফলাফল হবে খুবই আশাব্যঞ্জক এবং নতুন কিছু পাওয়ার মতো—এই বোধটি বিশ্বাসযোগ্যভাবেই তৈরি করতে হবে। নইলে শুধু মৃত্যুর ভয়, সংক্রমণের ভয় বা সামাজিক দায়িত্বের মধুবাণী দিয়ে মানুষকে লকডাউনে রাখা যাবে না। তা ছাড়া বেশ কিছু অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থকরী কাজকর্ম আছে, যেগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা সামান্য সুযোগ পেলেই কোয়ারেন্টিন ভাঙবে।
জানাজার আয়োজকেরা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, তাঁরা নিরুৎসাহিত করার পরও মাওলানা যোবায়ের আহমদ আনসারীর ভক্ত ও শিষ্যরা শুধু আবেগ ও ভালোবাসায় ভর করে চলে এসেছেন। ভাষ্যটি বিশ্বাসযোগ্য। ভাটি অঞ্চলে তাঁর জনপ্রিয়তা রয়েছে। একজন পুণ্যবান মানুষের জানাজায় অংশ নিলে তাঁর দোয়ার বরকতে হয়তো করোনার আক্রমণ ঘটবে না—এ রকম বিশ্বাসে ভর করা মানুষও যে অসংখ্যই আছেন, সেটিও সত্য। শৃঙ্খলা ও আনুগত্য মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গ। মাদ্রাসাগুলোর ছাত্ররা প্রিয় শিক্ষকের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানানোর আবেগীয় তাগিদ হয়তো আসলেই সামলাতে পারেনি। লকডাউনে মাদ্রাসা বন্ধ থাকায় অনেকে বাড়ি চলে গিয়েছিল। সেসব শিশু-কিশোর ছাত্র নিরাপত্তার প্রয়োজনে হয়তো বাবা, বড় ভাই বা অন্য দায়িত্বশীল আত্মীয়ও সঙ্গে এসেছে। ফলে জনসমাগমটি অনেক বড় হয়েছে।
জমায়েতটি করোনা সংক্রমণে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করেছে—কথাটি সত্য। এ রকম ঘটনা আরও ঘটার এবং এ রকম জমায়েত আরও হওয়ার সম্ভাবনাও যে তৈরি হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন, তারও সত্যতা আছে। করোনা প্রতিরোধের কর্মকৌশল ঠিক করার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা এই সম্ভাবনা মাথায় রাখবেন নিশ্চিত। আয়োজনটি দ্বারা সৃষ্ট বিপদের ব্যাপকতা বিবেচনায় নিয়ে তাঁদের উচিত হবে সামনের দিনগুলোর জন্য এমন ব্যবস্থা নেওয়া, যাতে বাংলাদেশে নতুন কোনো ‘কপিক্যাট সিনড্রোম’, অর্থাৎ একই আচরণের জন্ম না হয় এবং আঞ্চলিকতাবাদ ও ঘৃণাবাদী ভাব-ভাবনা ছড়িয়ে না পড়ে। অদূর ভবিষ্যতে সম্মানিত ব্যক্তিদের মৃত্যুতে গায়েবানা জানাজা এবং অনলাইননির্ভর রিয়েল-টাইম প্রার্থনার ব্যবস্থা করা যায় কি না, সেই ভাবনা এখনই শুরু হওয়া প্রয়োজন। একই পদ্ধতিতে তারাবিহ জামাত পরিচালনাও সম্ভব করা যায় কি না, বিজ্ঞ ইসলাম ধর্মবেত্তারা আলোচনা করে দেখতে পারেন।
হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোশিওলজি; নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।