কোভিড–১৯ মহামারি কার্যকরভাবে মোকাবিলার জন্য যা যা করা প্রয়োজন, তার সবই করার দায়িত্ব সরকারের। কারণ, রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার দায়িত্ব সরকারের হাতে এবং তার প্রশাসনিক-প্রাতিষ্ঠানিক সব কর্মকাণ্ডের ব্যয় নির্বাহ হয় জনগণের করের টাকায়। এই গুরুতর জাতীয় দুর্যোগে জনসাধারণ প্রধানত সরকারের ওপরেই ভরসা রাখতে চায়। প্রত্যাশা করে যে মানুষের জীবন বাঁচাতে সরকার আন্তরিকভাবে তৎপর হবে। এই প্রত্যাশা স্বাভাবিক এবং যথাযথ।
কিন্তু এটাও সত্য যে এত বড় জাতীয় দুর্যোগ কার্যকরভাবে সামাল দেওয়া সরকারের একার পক্ষে অত্যন্ত দুরূহ। তবে সরকার নিজে এটা উপলব্ধি করছে কি না তা বলা কঠিন। কারণ, সমাজের অন্যান্য শক্তিকে যুক্ত করার তেমন কোনো উদ্যোগ সরকারি তরফে দেখা যাচ্ছে না। এর একটা কারণ হতে পারে এই যে রোগ সংক্রমণ, আক্রান্তদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা ও মৃত্যু সম্পর্কে তথ্যপ্রবাহের নিয়ন্ত্রণ সরকার নিজের হাতে রাখতে চায়। এই মনোভঙ্গি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, সব ধরনের জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সঠিক তথ্যপ্রবাহের অপরিসীম গুরুত্ব দেশে দেশে কালে কালে প্রমাণিত হয়েছে।
সুতরাং সরকারকে একাই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অন্য সবাইকে সঙ্গে নিয়ে করোনাযুদ্ধে জয়ী হওয়ার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য বিমোচন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ নানা ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থা তথা এনজিও খাতের অবদান দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নে এনজিও খাতের অবদানের স্বীকৃতি মিলেছে নোবেল পুরস্কার অর্জনের মধ্য দিয়ে। পৃথিবীর বৃহত্তম বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রয়েছে বাংলাদেশেই। এ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে সামাজিক, অর্থনৈতিক নানা ক্ষেত্রে কাজ করছে ছোট–বড় অজস্র বেসরকারি সংস্থা। কোভিড–১৯ মহামারি মোকাবিলায় আমরা তাদের সক্ষমতা কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেব না কেন?
তেমন উদ্যোগ নিতে হলে সরকারকেই প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা দেখেছি, বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর মধ্যে গণ স্বাস্থ্য সংস্থা নিজে থেকে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষার কিট তৈরি করার প্রস্তাব দিয়েছে এবং সরকার তাদের তা করার অনুমোদন দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সরকারেরই উচিত এনজিওগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করা, কোন সংস্থা কোন ক্ষেত্রে সরকারকে কীভাবে সহযোগিতা করতে পারে, তা নির্ধারণ করে তাদের যুক্ত হতে আহ্বান জানানো। জাতীয় পর্যায়ে ব্র্যাকের সহযোগিতা কাজে লাগবে; সারা দেশের ইউনিয়ন পর্যায়ে তাদের কাজের নেটওয়ার্ক আছে। তারা অন্তত করোনাভাইরাসের বিপদ ও সামাজিক দূরত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজে সহায়তা করতে পারে। এই মহামারি মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা।
একই কাজে অবদান রাখতে পারে আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করে এমন সব এনজিও। পাকিস্তান ও ভারতে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নমুনা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্র খোলার খবর পাওয়া গেছে। বাংলাদেশেও এমন উদ্যোগ নেওয়া উচিত এবং এই কাজে এমন বেসরকারি সংস্থাগুলোর সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে, যারা স্থানীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে কাজ করে।
করোনাযুদ্ধের লড়াইয়ে আমাদের বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সহযোদ্ধা হিসেবে পেতে হবে। এ জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে, বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও নিজ নিজ অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহারের অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।