ধান কাটা: ধন্যবাদ জেলা প্রশাসক সুনামগঞ্জ
বাংলাদেশের মোট চাহিদার পাঁচ ভাগের এক ভাগ খাদ্যের (ধান) জোগান আসে হাওর থেকে। হাওরের সাত জেলার অন্যতম সুনামগঞ্জ। বলা হয়, দেশে ধান কাটা শুরু হয় সুনামগঞ্জ থেকে। পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জ তলায় সবার আগে। তাই লকডাউনের মধ্যেই সুনামগঞ্জে ধান কাটা শুরু আর শেষ করতেই হবে। ইতিমধ্যেই আগাম জাতের ধান কাটা শুরু হয়েছে। এখনো তেমন পানি আসেনি। তবে যেকোনো দিন পাহাড়ি ঢল নামতে পারে। ১১ এপ্রিলের ঝড়বৃষ্টিতে সেই আলামতের গন্ধ পেয়েছেন কৃষকেরা। প্রায় সারা দেশে একই বেগে ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টির এমন ঝাপটা সনাতন কালবৈশাখীতে বিরল।
সীমান্তের ওপারে এ রকমের বৃষ্টি পরপর দু-তিন দিন হলেই হাওরের নদী, শাখা নদী আর নদীরেখায় বান ডাকবে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আগামী সপ্তাহে আরও ঝড়বৃষ্টির ইঙ্গিত। কালবৈশাখীর অবিচ্ছেদ্য ধারাপাত, শিলাবৃষ্টি আর বজ্রপাতের ভয় নিয়েই ধান কাটতে হয়। নাটোরের বড়াইগ্রামে শিলাবৃষ্টিতে পতিত করোনাভাইরাসসদৃশ শিলার ছবি ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে গেছে সারা দুনিয়ায়। সেটা কোনো ফটোশপের কেরামতি কি না, গোয়েন্দারা বুঝবেন। তবে মানুষ বেশ ভয় পেয়েছে শিলার আকৃতি দেখে। সেই সঙ্গে আছে অতি ছোঁয়াচে করোনার ভয়।
স্থানীয় পত্রপত্রিকা, অনলাইন সংবাদ সূত্র প্রথম থেকেই ইঙ্গিত দিচ্ছিল, ‘করোনাভাইরাসের আতঙ্কে জমিতে ধান কাটতে আগ্রহ নেই স্থানীয় শ্রমিকদের।’ প্রায় দুই দশক ধরে বাইরের শ্রমিক, তথা রংপুর, গাইবান্ধা, জামালপুর, সিরাজগঞ্জের মৌসুমি শ্রমিকদের ধান কাটতে হাওরে যাওয়ার তেমন কোনো গরজ দেখা যাচ্ছে না। এসব শ্রমিকের চিহ্নিত করার জনপ্রিয় স্থানীয় প্রতিশব্দ ‘ভাগালু-দাওয়াল’ নতুন প্রজন্মের কাছে অপরিচিত বা হারিয়ে যাওয়া শব্দ। জেলখানায় বসে বঙ্গবন্ধু তাঁর ডায়েরিতে (অসমাপ্ত আত্মজীবনী—শেখ মুজিবুর রহমান, দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, প্রথম প্রকাশ ২০১২, পৃষ্ঠা ১০৩-১০৫ দেখুন) দাওয়ালদের সুখ-দুঃখের কথা লিখতে গিয়ে বলেছেন ‘...এরা না গেলে জমির ধান তুলবার উপায় থাকে না। এক সঙ্গেই প্রায় সব ধান পেকে যায়, তাই তাড়াতাড়ি কেটে আনতে হয়। স্থানীয়ভাবে এত কিষাণ এক সাথে পাওয়া কষ্টকর। বহু বৎসর যাবৎ এই পদ্ধতি চলে আসছিল...।’
করোনাকালে দূরের অভাবী জেলাগুলো থেকে শ্রমিকদের আনতে না পারলে দেশের সার্বিক খাদ্য নিরাপত্তা আবার একটা হুমকির মুখে পড়বে। যিনি যা-ই বলুন না কেন, ধান-চাল-গম এবার আর ভিক্ষা করেও পাওয়া যাবে না। সবাই সংকটে থাকবে। আমাদের ধান-চাল আমাদের রক্ষা করতে হবে যেভাবে সম্ভব।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক তাঁর সীমিত ক্ষমতার মধ্যেই একটা সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা করছেন।
স্থানীয় কৃষকদের ধান কাটার সব রকমের প্রস্তুতির কাজ শেষ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। সব ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানদের অনুরোধ করেছেন, তাঁরা যেন প্রয়োজনে স্থানীয়ভাবে মাইকিং করে হলেও কৃষকদের ধান কাটা শুরু করার জন্য আহ্বান অব্যাহত রাখেন। এই ধান কাটার প্রস্তুতিতে যাতে কোনো ছেদ না পড়ে, সে জন্য হাওরাঞ্চলে কৃষি যন্ত্রপাতি (ধান কাটার মেশিন, মাড়াই যন্ত্র, কাঁচি) মেরামত করার জন্য ওয়ার্কশপ খোলা রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন।
শ্রমিকসংকটের আশু সমাধানের জন্য করোনাজনিত লকডাউনের কারণে বন্ধ জেলার সব বালু ও পাথরমহালের শ্রমিকসহ রোজগার হারানো জেলার রিকশাচালক, ভ্যানচালক, ঠেলাগাড়িচালকসহ শ্রমজীবীদের ধান কাটায় যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এই সময় যাঁরা হাওরে ধান কাটতে আসবেন, তাঁদের করোনাকালীন ত্রাণের সুবিধা দেওয়া হবে। অর্থাৎ হাওরের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ঘোষিত ত্রাণ তৎপরতার আওতায় তিনি ধান কাটাকে আগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছেন। ইতিমধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ও ত্রাণ বণ্টনের ক্ষেত্রে কৃষিশ্রমিকদের কথা মনে রাখার জন্য জেলা প্রশাসকদের অনুরোধ জানিয়েছে।
সরকারি আহ্বানে জেলার অন্য পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা ধান কাটতে হাওরাঞ্চলে এলে তাঁদের নিরাপদ আশ্রয় দরকার। সেই লক্ষ্যে প্রশাসন হাওরের সব বিদ্যালয়কে সামাজিক দূরত্ব মেনে রাতে শ্রমিকদের স্কুল ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন।
জেলার অন্য এলাকার কতজন মানুষ কত দিনের জন্য ধান কাটতে আসবেন? কোথায়, কোন ইউনিয়নের কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কীভাবে থাকবেন? এসব প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া না গেলে জেলা প্রশাসনের ওয়াদামতো তাঁদের ত্রাণ ও যথাযথ নিরাপত্তা সহযোগিতা দেওয়া সম্ভব হবে না। এ কাজে জেলা প্রশাসনকে সহযোগিতা করবেন ইউপির চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা।
অধস্তন আমলা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং জনগণের সার্বিক সহযোগিতা পেলে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন একটা দৃশ্যমান ও গুণগত সাফল্য অর্জন করতে পারবেন। রোজগার হারানো জেলার রিকশাচালক, ভ্যানচালক, ঠেলাগাড়িচালক বালু ও পাথরমহালের শ্রমিকদের অনেকেরই হয়তো ধান কাটার পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। তা ছাড়া তাঁদের আবাসস্থল ও কাজের জায়গায় করোনাভাইরাস ঝুঁকিমুক্ত রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেহমান শ্রমিকেরা থাকবেন, সেসব প্রতিষ্ঠানে এবং খোলায় সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে। কোনো অবস্থাতেই যেন একজনের গামছা আরেকজন ব্যবহার না করেন, সে ব্যাপারে সবাইকে সচেতন রাখা খুবই জরুরি। অর্থাৎ কাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি কিছু সচেতনতামূলক কাজ করতে হবে। এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য বিভাগ এবং ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য সিভিল সার্জনের সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় হাত ধোয়ার স্থায়ী ও টেকসই ব্যবস্থা স্কুল খোলার আগেই তৈরি করার এটাই একটা সুযোগ। জেলা প্রশাসক চাইলে সবাইকে আস্থায় নিয়ে সহজে কাজটা করতে পারবেন। এভাবেই পারবেন একটা উদাহরণ তৈরি করতে, যে উদাহরণ সারা দেশে কেবল মান্যই হবে না, অনুসরিতও হবে।
লেখক: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক গবেষক
[email protected]