চরম পরীক্ষা, পাস করতেই হবে
সরকারের জন্য চরম পরীক্ষা। তবে পরীক্ষার ঘণ্টা কেবল বাজতে শুরু করেছে, সামনে আরও কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে এবং পাস করতে হবে। সরকার যদি ফেল করে, তার মূল্য শুধু সরকার দেবে না, জনগণকেও দিতে হবে, দেশকে দিতে হবে। কাজেই ফেল করার অবকাশ নেই। ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে এই পরীক্ষায় নিজেকে উজাড় করে দিয়ে ভালো ফল ঘরে তুলতে হবে।
শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বে সরকার ছিল ১৯৯৬-২০০১, মাঝে ৭ বছরের বিরতি, তারপর জানুয়ারি ২০০৯ থেকে। এর মধ্যে নানা কঠিন পরীক্ষা গেছে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১-এ একটা বড় বন্যা হয়েছিল। সে সময় সরকার ত্রাণকার্য পরিচালনা করেছিল দক্ষতার সঙ্গে। সুনাম হয়েছিল, দুর্নাম নয়। সেই সময়ের অভিজ্ঞতাটা এবার কাজে লাগানো দরকার। বলছিলাম, নানা ঝড়ঝঞ্ঝার কথা। জঙ্গি আক্রমণ হয়েছে। দেশ কেঁপে উঠেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন নয়, এই আওয়াজ তুলে বিরোধী দল লাগাতর কঠিন কর্মসূচি পালন করেছে। পেট্রলবোমার বিভীষিকা আমরা দেখেছি। দেখেছি বিভিন্ন সরকারের আমলে নানা ধরনের বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা। ঘটে গেছে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি।
কিন্তু এবারের পরীক্ষাটা চরম। এমন যদি হতো, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রবেশ করতেই পারল না, তবুও বাংলাদেশের মানুষকে অর্থনীতির মন্দার মুখে পড়তেই হতো। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান দুই উৎস—জনশক্তি ও তৈরি পোশাক সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী করোনার ছোবলে। তৈরি পোশাকের অর্ডার কমে যাবে। বিদেশে লোক পাঠানো বন্ধ, তাঁরা বেকার, বরং বিভিন্ন দেশ চাপ দিচ্ছে আমাদের মানুষদের ফেরত পাঠাতে।
কিন্তু আমাদের দেশেও এই ভাইরাস তার আক্রমণ এরই মধ্যে শুরু করে দিয়েছে। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। মানুষ মারা যাচ্ছে। এই অবস্থায় প্রতিটা মুহূর্ত ভীষণ দামি। সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই কঠিন।
আমাদের সর্বশক্তি নিয়োজিত করতে হবে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধ করার জন্য। পৃথিবীর কোনো দেশই করোনাভাইরাস বিস্তার হতে দেওয়ার পর চিকিৎসা দিয়ে পরিস্থিতি আর সামলাতে পারবে না। আমেরিকা পারছে না। ইতালি পারছে না। চিকিৎসাব্যবস্থা তো ভেঙে পড়বেই, একটু দেরি করে লকডাউন বড় দাম আদায় করে ছাড়বে। তার অর্থনৈতিক ক্ষতিও হবে বিশাল। প্রতিক্রিয়া হবে ভয়াবহ।
যা করার শুরুতে করতে হবে। এইখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া ভীষণ শক্ত। কারণ ছোট্ট দেশ, মানুষ বেশি। প্রতি চারজনে একজন মানুষ গরিব, যার সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। বহু মানুষ অনেক কষ্ট করে দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠেছে, তারা না আবার গরিব হয়ে যায়। দেশে যদি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড না থাকে, যারা দিন আনে দিন খায়, তাঁরা কী করবেন, খাবার পাবেন কোথায়? অর্থনীতির চাকা না ঘুরলে সর্বস্তরের মানুষের ওপরই তার কুফল পড়বে। আবার সমস্যাটা কেবল বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বের। এখন সরকার করোনাভাইরাসের ভয়াবহ ও অনিবার্য আক্রমণ ঠেকাতে কত দিন সবকিছু বন্ধ করে রাখবে? শেষে না অর্থনীতির মন্দার কুফল করোনাভাইরাসের কুফলের চেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয়।
এই সমস্যার কোনো সমাধান আমার কাছে নেই। তবে আমার পরামর্শ হলো, করোনার বিস্তার ঘটে গেলে চিকিৎসা দেওয়ার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই। আর ওষুধই যার নেই, সেই চিকিৎসা আর কত ভালো হবে। লক্ষ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হলে তিন হাজার আইসিইউ বেড লাগবে, আমাদের আছে সাকল্যে হাজারখানেক, করোনার রোগীর জন্য এক শর কিছু বেশি। আমরা চিকিৎসা দিতে পারব না। কোনো দেশই আসলে পারবে না, পারছে না। কাজেই প্রতিরোধে এখনই সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। লকডাউন ছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই।
লকডাউন করো বললেই তো হয়ে গেল না। সরকারের সেফটিনেট আছে। একমাত্র সরকারের পক্ষেই সম্ভব গরিব মানুষের ঘরে ঘরে সাহায্য পৌঁছে দেওয়া। এখানেই ১৯৯৬-২০০১-এর অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। অর্থ বরাদ্দ করা, খাদ্য বরাদ্দ করা থেকে শুরু করে নির্ভুলভাবে প্রতিটা অভাবী ঘরে তা পৌঁছে দেওয়া, কাজটা মহাযজ্ঞ। কঠিন। আবার মানুষকে এক জায়গায় জড়ো করে, ভিড় করে ত্রাণ বা সাহায্য দিলে হবে না। সোশ্যাল ডিস্টান্সিং বজায় রেখে তা করতে হবে।
এরই মধ্যে এলাকা থেকে খবর আসছে, চালের বস্তা সরিয়ে রাখার। দুর্নীতির। পুলিশ গিয়ে বস্তা উদ্ধার করছে, জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করছে। এই একটা ভীষণ স্পর্শকাতর কিন্তু বাস্তব সমস্যা আছে। আমাদের দেশে দুর্নীতি একটা বড় বাস্তবতা। দুর্নীতিবাজেরা মানুষের দুঃখ-দুর্দশার সুযোগও নিতে চায়। আর আওয়ামী লীগের জন্য এই দুর্নাম দুর্বহ। এই দুর্নাম যদি কাঁধে আসে, তাহলে পরীক্ষায় পাস করা যাবে না। কাজেই প্রধানমন্ত্রী যে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, গরিবের হক কাউকে আত্মসাৎ করতে দেবেন না, তা কাজে পরিণত করতে হবে। শুধু মুখের কথায় এই দুর্নীতিবাজেরা তাদের লোলুপ জিব বন্ধ করবে না। সিস্টেমটাই এমন করতে হবে, যাতে চুরির সুযোগ তারা না পায়। চুরি করার উপায় খোলা থাকলে চুরি হবেই। চুরি করার কোনো ফাঁকই দেওয়া যাবে না। আর দুর্নীতির প্রশ্নে জিরো টলারেন্স নীতিও গ্রহণ করতে হবে।
এরপর আরও কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষণ আসছে। আমরা কি কলকারখানা খুলে দেব? বাস-ট্রেন-লঞ্চ চালু করব? অফিস-আদালত চলবে? আমি নিজে বিশেষজ্ঞ নই। কাজেই কোনো রকমের সুপারিশ আমি করব না। তবে বলব, নিরাময়ের চেয়ে প্রতিরোধ ভালো। একবার ছেড়ে দিয়ে পরিস্থিতির অবনতি দেখে ভয় পেয়ে আবার লকডাউনে যাওয়ার চেয়ে শুরুর দিকে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া ভালো হতে পারে। বর্তমানে যা করা হচ্ছে, যেখানেই করোনা সেখানেই লকডাউন, সেটারও কিছুটা সুফল আমরা পাব। কিন্তু যখন রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, কলকারখানা বন্ধই আছে, তখন যেন লকডাউনের মতোই কড়াকড়ি করা হয়, শখ করে কেউ যেন ঘরের বাইরে না যেতে পারেন। সত্য বটে, বহু মানুষের বহু জরুরি প্রয়োজন আছে, খাবার-দাবার ওষুধ কিনতেও লোকজনকে বেরোতে হতে পারে, আর গরিব মানুষ, শ্রমজীবী মানুষ, কৃষকদের ঘরই কি আর বাহিরই কি। তবুও শহর এলাকাগুলোতে যেন লকডাউনই করা হয়। আমি এও জানি, সরকার লকডাউন কথাটাও বলছে না। কিন্তু ঘরে থাকতে তো বলছেই।
এখানে নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের এই আহ্বানে সাড়া দিতে হবে। আমরা কেউই বাইরে যাব না। ইবাদত বন্দেগিও ঘরে থেকে করব। প্রার্থনা আরাধনা ঘরে করব।
পাশাপাশি পরীক্ষা আরও বাড়াতে হবে। যত পরীক্ষা করা যাবে, তত রোগী শনাক্ত করা যাবে। তত আমরা সাবধান হতে পারব। তবে কোনো কোনো গ্রাম চমৎকার উদ্যোগ নিয়েছে। গ্রামবাসী তাদের গ্রামে চেকপোস্ট বসিয়েছে। বাইরের কেউ ঢুকতে পারবে না, ভেতরের কেউ বের হতে পারবে না। বাংলাদেশের প্রতিটা গ্রাম যদি এই মডেল গ্রহণ করে, তা-ও সুফল দেবে।
এরপর আছে চিকিৎসা। চিকিৎসকদের সুরক্ষার রসদ দিতে হবে। নিউইয়র্কের মতো জায়গায় বেশির ভাগ করোনা রোগীর পরীক্ষাই করা হচ্ছে না। হাসপাতাল প্রায় সবাইকেই ফিরিয়ে দিচ্ছে। বলছে, বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিন। আমাদেরও বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে করোনা রোগী দেখলে বাঘ দেখার মতো করে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তিন ফুট দূরে থাকলে করোনা রোগী কাউকে সংক্রমিত করবে না। মৃতদেরও ভয় পাওয়ার কিছু নেই। করোনায় আক্রান্ত মৃতদের দাফন-কাফন, সৎকারের স্টান্ডার্ড ম্যানুয়াল এখনই তৈরি করে সারা দেশের মানুষকে সচেতন করতে হবে। প্রত্যন্ত গ্রামে ঢাকা থেকে লোক গিয়ে দাফন-কাফন করতে পারবে না।
দেশের মানুষের মনোবল উঁচু রাখতে হবে। ডাক্তার, নার্স, হসপিটালের ব্যবস্থাপক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনোবল উঁচু রাখতে হবে। প্রশাসনের সবাইকে শক্ত থাকতে হবে।
আবার দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও শুরু করে দিতে হবে। চীনের উহান অবশ্য আমাদের জন্য একটা মডেল। কীভাবে তারা আবার স্বাভাবিক হয়ে আসছে, সেখান থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। এই মুহূর্তটাই ক্রিটিক্যাল। সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব কঠিন। এখনকার সঠিক সিদ্ধান্ত সামনের দিনগুলোকে সহজ করে দিতে পারে। কঠিনও করে তুলতে পারে। দেশে দেশে যোগাযোগ রাখা ভালো। ভারত কী করছে, পাকিস্তান কী করছে, শ্রীলঙ্কা কী করছে, পরস্পরের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময় করে নেওয়া যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, চার/পাঁচ মাস আগেও পৃথিবীতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বলে কিছু ছিল না। কাজেই এই পরিস্থিতি সবার জন্যই নতুন। সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সবাই সবার পাশে দাঁড়াবে, এটাই কাম্য।
সরকারের জন্য করণীয় তালিকায় আছে ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া, সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ রাখা, প্রশাসনকে দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করে গরিব মানুষের দুয়ারে দুয়ারে খাদ্য-অর্থ পৌঁছে দেওয়া, সারা দেশে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের প্রবাহ অব্যাহত রাখা, আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে সুশৃঙ্খলা আনা, করোনা ছাড়া অন্য রোগের চিকিৎসা যাতে মানুষ পায়, তা নিশ্চিত করা, মা-শিশু ও প্রসূতিরা যেন স্বাস্থ্যসেবা পান, তা নিশ্চিত করা। মানুষকে আশা দেওয়া। ভরসা দেওয়া। আবার দেশের অর্থনীতিকেও চালু রাখতে হবে।
আবারও দেশের অর্থনীতিকে দাঁড় করানোর জন্য গৃহীত পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। আশা করি, এইবার বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে দেবেন কৃষকেরা। তাঁরা তো আর উৎপাদন বন্ধ করবেন না। আরেকটা জায়গায় আশা রাখতে চাই। যেকোনো দুর্যোগ একটা নতুন সুযোগও তৈরি করে। এমনও হতে পারে, করোনা-উত্তর পৃথিবীতে বাংলাদেশ দ্রুতই উন্নতি করতে শুরু করল।
আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক