‘ভাইরাল হয়ে গেছে’—কথাটা এখন একটুও না কেঁপে কেউ কি বলতে পারে? দরজার হাতল, কাগজের বোর্ড, শাকসবজির ব্যাগ—এমন নির্দোষ জিনিসগুলোর দিকে তাকালেও এখন মনে হয় অদৃশ্য, অনাবৃত জীবাণু রয়েছে সেখানে, যা আমাদের ফুসফুসকে আঁকড়ে ধরার জন্য মুখিয়ে আছে।
আতঙ্কিত না হয়ে এখন কার পক্ষে লাফিয়ে বাসে চড়া বা বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানোর মতো বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করা সম্ভব? ঝুঁকির কথা না ভেবে কে ভাবতে পারে মামুলি আনন্দের কথা? আমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে আধা চিকিৎসক, ভাইরোলজিস্ট, পরিসংখ্যানবিদ বা ভবিষ্যদ্বক্তা নয়? এমন কোনো বিজ্ঞানী বা চিকিৎসক কি আছেন, যিনি গোপনে অলৌকিক কিছুর আশা করছেন না? কোন ধর্মীয় গুরু আছেন, যিনি অন্তত গোপনে বিজ্ঞানের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি? আর এই ভাইরাসের বিস্তারের মধ্যেই বিরান শহরে পাখির গান, রাস্তার ক্রসিংয়ে ময়ূরের নাচ ও আকাশের নীরবতা কাকে রোমাঞ্চিত করবে না?
কয়েক দিন আগেই সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে, মৃত্যুর সংখ্যাও ছাড়িয়েছে অর্ধলক্ষ। অনেক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, মৃত্যুর সংখ্যা লাখ ছাড়াবে, এমনকি তার বেশিও হতে পারে। বাণিজ্যপথ ধরে ভাইরাসটি নির্বিঘ্নে ছড়িয়ে পড়ছে আন্তর্জাতিক রাজধানী থেকে শুরু করে সর্বত্র। যে ভয়ংকর অসুস্থতা এটি নিয়ে এসেছে, তার ভয়ে দেশে দেশে, শহরে শহরে নিজেদের ঘরে আটকে পড়েছে মানুষ।
মূলধন প্রবাহের বিপরীতে গিয়ে এই ভাইরাস মুনাফা নয়, বিস্তার চায়। আর তাই কিছু দিক থেকে এটি মূলধন প্রবাহের দিক বদলে দিয়েছে। এটি অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ, বায়োমেট্রিকস, ডিজিটাল নজরদারিসহ তথ্য ও তথ্য বিশ্লেষণের (ডেটা অ্যানালিটিকস) সব ধরনকেই বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে এবং সজোরে আঘাত করেছে। তাই এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ও ধনী দেশগুলোর পুঁজিবাদী ইঞ্জিন থমকে গেছে। হয়তো অস্থায়ীভাবে। কিন্তু এর কলকবজা পরীক্ষা, এর সমস্যা ও সম্ভাবনা নিরূপণ করে এটি মেরামত করে চালানো হবে, নাকি আরও উন্নত কোনো ইঞ্জিনের খোঁজে নামতে হবে—সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এই সময়টুকুই আমাদের জন্য যথেষ্ট।
যেসব আমলা এখন এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন, তাঁরা সাধারণত যুদ্ধের কথা বলতেই ভালোবাসেন। তাঁরা রূপক অর্থে যুদ্ধকে ব্যবহার করেন না, আক্ষরিক অর্থেই যুদ্ধ করেন। আর যুদ্ধের কথাই যদি আসে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে আর কে বেশি এ জন্য প্রস্তুত? এমন যদি হতো, এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সামনের সারির সেনাদের মাস্ক বা গ্লাভসের বদলে বন্দুক, স্মার্ট বোমা, বাংকার বাস্টার, সাবমেরিন, ফাইটার জেট, পারমাণবিক বোমার প্রয়োজন হচ্ছে, তাহলে কি কোনো ঘাটতি থাকত?
রাতের পর রাত সারা বিশ্বের বহু মানুষ নিউইয়র্কের গভর্নরের বক্তব্য যে মুগ্ধতার সঙ্গে শুনছেন, তা ব্যাখ্যা করা মুশকিল। আমরা পরিসংখ্যানের কথা শুনছি। শুনছি রোগীর ভারে নুয়ে পড়া যুক্তরাষ্ট্রের সেই সব হাসপাতালের গল্প, যেখানে স্বল্প মজুরিতেই বাড়তি কাজ করে চলা নার্সরা ময়লা ফেলার পলিথিন বা রেইনকোট দিয়ে মাস্ক তৈরি করছেন; নিচ্ছেন অসুস্থদের রক্ষায় সব ধরনের ঝুঁকি। আমরা শুনছি যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে ভেন্টিলেটর নিয়ে চলা যুদ্ধের গল্প; শুনছি ভেন্টিলেটর কে পাবে, আর কে পাবে না—এ নিয়ে উভয়সংকটে পড়া চিকিৎসকদের কথা। আর আমরা নিজেদের ভেতরেই হঠাৎ চমকে উঠে বলছি, ‘হা ঈশ্বর, এই তবে আমেরিকা!’
এই বাস্তব ও মহাকাব্যিক ট্র্যাজেডি রাতারাতি নিজেকে উন্মোচিত করেছে আমাদের সামনে। তবে এসব নতুন কিছু নয়। এটি হচ্ছে সেই বিধ্বস্ত রেলগাড়ি, যা বছরের পর বছর ধরে একদিকে হেলে চলেছে। কার মনে নেই, হাসপাতাল থেকে রোগীকে গোপনে রাস্তার আস্তাকুঁড়ে ফেলে আসার কথা। যুক্তরাষ্ট্রের কম ভাগ্যবান নাগরিকদের জন্য হাসপাতালের দরজা প্রায়শই বন্ধ হয়ে যায়। তারা কতটা অসুস্থ বা তাদের কী হবে—সেসব কিছুই গ্রাহ্য করা হতো না। এমনকি এখনো, এই ভাইরাসযুগেও এর বদল হয়নি, যখন দরিদ্র কারও অসুস্থতা প্রভাব বিস্তার করতে পারে ধনী সমাজেও। এমনকি এখনো ‘সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা’-এর প্রচার চালিয়ে যাওয়া সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স এমনকি নিজ দলেই আলাদা হিসেবে বিবেচিত হন। তবে এখন আর এসব কিছু করার উপায় নেই।
ট্র্যাজেডি হচ্ছে এই যে সেই বিধ্বস্ত রেলগাড়ি যখন বহু বছর ধরে টেনে টেনে চলছিল, তখন আমার এই দরিদ্রবহুল দেশ ভারত আটকা পড়েছে সামন্তবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদ বা বর্ণবাদ ও পুঁজিতন্ত্রের মধ্যবর্তী কোনো স্থানে, শাসিত হচ্ছে উগ্র ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা।
ডিসেম্বরে চীনের উহান যখন ভাইরাসের মহামারি ঠেকাতে লড়ছিল, ভারত সরকার তখন ব্যস্ত ছিল আইনসভায় সদ্য পাস হওয়া মুসলিমবিরোধী বৈষম্যমূলক আইনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা হাজারো মানুষের আন্দোলন সামাল দিতে। প্রজাতন্ত্র দিবসে আমাদের সম্মানিত অতিথি হয়ে আসা আমাজন বনখেকো ও কোভিড-১৯ সংকট অস্বীকারকারী জায়ের বোলসোনারো দিল্লি ছেড়ে যাওয়ার কয়েক দিন পর ৩০ জানুয়ারি ভারতে প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগীর সন্ধান মেলে। তবে ফেব্রুয়ারিতে এসেও ভাইরাস নিয়ে কিছু করার সময় ছিল না শাসক দলের কাজের শিডিউলে। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত সফর করেন। গুজরাট রাজ্যের একটি খেলার মাঠে ১০ লাখ মানুষের সংবর্ধনা তাঁকে প্রলুব্ধ করে। এই সবই বিস্তর অর্থের সঙ্গে সঙ্গে অনেক সময়ও নিয়ে গেছে আমাদের কাছ থেকে।
এরপর হলো দিল্লির বিধানসভা নির্বাচন। সহিংস নানা আচরণ করেও হেরে গেল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। এতে তারা এক ভয়াবহ ও কলুষিত হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রচার শুরু করে, যা ছিল সহিংসতায় পরিপূর্ণ। হেরে গিয়ে শাস্তিটা দেওয়া হচ্ছিল দিল্লির মুসলিমদেরই। এই লজ্জার জন্য তাদেরই দোষারোপ করা হচ্ছিল। সশস্ত্র হিন্দুরা পুলিশের ছত্রচ্ছায়ায় উত্তর-পূর্ব দিল্লির শ্রমিকশ্রেণির এলাকাগুলোতে থাকা মুসলিমদের ওপর হামলা করে। মুসলমানদের বাড়িঘর, দোকানপাটে হামলা করা হয়; পুড়িয়ে দেওয়া হয়। হামলার শঙ্কায় থাকা মুসলিমরাও পাল্টা হামলা করে। নিহত হন প্রায় ৫০ জন মানুষ, যাঁদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলিম। স্থানীয় কবরস্থানে থাকা শরণার্থীশিবিরে হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় নেয়। সরকার যে সময় করোনাভাইরাসে করণীয় নিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকে বসল, সে সময়ও দিল্লিতে ড্রেন থেকে পচে যাওয়া অনেক লাশ টেনে তোলা হলো। তখনো ভারতের অসংখ্য মানুষ অবগত নয় কোভিড-১৯ সম্পর্কে।
মার্চও ছিল একটি ব্যস্ত মাস। প্রথম দুই সপ্তাহ গেল ভারতের মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস সরকারের পতন ও তার জায়গায় বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে। ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা করে। এর দুদিন পর ১৩ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলল, ‘করোনা এখনো হেলথ ইমার্জেন্সি নয়।’
অবশেষে ১৯ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে বক্তব্য দেন। সেদিন তিনি এ বিষয়ে খুব জ্ঞান নিয়ে আসেননি। ইতালি ও ফ্রান্সের অবস্থা দেখে কিছুটা আঁচ করে নেন। তিনি সামাজিক দূরত্বের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বললেন (যা ছিল বর্ণপ্রথা, এখনো মেনে চলা সমাজের জন্য সহজবোধ্য) এবং ২২ মার্চ জনতার কারফিউ জারি করলেন। সরকার এ বিষয়ে জনগণের জন্য কী করছে, তা নিয়ে তিনি কিছু না বললেও সারা দেশের মানুষকে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘণ্টা বাজিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের অভিবাদন জানানোর আহ্বান জানালেন। অথচ এই কথা একবারও বললেন না যে সেই মুহূর্ত পর্যন্ত শ্বাসযন্ত্রের সহায়ক সরঞ্জামসহ অন্য সুরক্ষা সরঞ্জাম ভারত রপ্তানি করছিল ভারতীয় স্বাস্থ্যকর্মী ও হাসপাতালগুলোর কথা না ভেবেই।
মার্চের ২৪ তারিখ রাত ৮টায় প্রধানমন্ত্রী আবার আসেন টেলিভিশনে জাতিকে এই জানাতে যে ওই দিন মধ্যরাত থেকে পুরো ভারতে লকডাউন জারি করা হচ্ছে। দোকানপাট বন্ধ থাকবে। সরকারি ও বেসরকারি কোনো পরিবহনকেই চলাচলের অনুমতি দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নন, পরিবারের বড় ভাই হিসেবে নিচ্ছেন। কোনো রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা না করে ১৩০ কোটির দেশে মাত্র ৪ ঘণ্টার নোটিশে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই এমন সিদ্ধান্ত আর কে নিতে পারে? তাঁর কাজ করার এই পদ্ধতি সবাইকে এই ধারণাই দেয় যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নাগরিকদের শত্রুশিবিরের বলেই গণ্য করেন।
এখনো আমরা লকডাউনে আছি। অনেক স্বাস্থ্য ও মহামারি বিশেষজ্ঞ সরকারের এই পদক্ষেপের প্রশংসা করছেন। হয়তো তত্ত্বীয়ভাবে তাঁরাই সঠিক। তবে অবশ্যই তাঁদের কেউ পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির অনর্থক অভাবকে সমর্থন করতে পারবেন না, যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় শাস্তিমূলক লকডাউনে পরিণত হয়েছে। অথচ এটি হওয়ার কথা ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। প্রদর্শনবাদী ব্যক্তিটি প্রদর্শনবাদিতার চূড়ান্ত করে ছাড়লেন। হতবাক বিশ্ব দেখছে, ভারত কীভাবে তার লজ্জা প্রকাশ করছে। তার কাঠামোগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের পাশবিকতা, ভুক্তভোগীদের প্রতি তার উদাসীনতা প্রকাশ হয়ে পড়েছে।
লকডাউন অনেকটা রাসায়নিক পরীক্ষার মতো হুট করে কাজ করছে; হঠাৎ করেই এটি গোপন বিষয়গুলোকে সামনে আনছে। দোকান, রেস্তোরাঁ, কারখানা, নির্মাণশিল্প সব বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিজেদের ঘরে আটকে ফেলেছে। আমাদের শহরগুলো, মহানগরগুলো তাদের খেটে খাওয়া মানুষদের, শহরে কাজের জন্য আসা মানুষদের অনাহূত অতিথির মতো বিতাড়িত করতে শুরু করে। অনেককে বাড়িওয়ালা বা কর্মক্ষেত্রের মালিক তাড়িয়ে দেন। আর দরিদ্র, ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত, অন্ধ, অসুস্থ মানুষগুলো কোনো যানবাহন না পেয়ে হেঁটে গ্রামের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। কয়েক দিন ধরে আগ্রা, আজমগড়, আলিগড়, লক্ষ্ণৌ, গোরখপুর দিয়ে কয়েক শ মাইল হেঁটে গেছেন; কেউ কেউ পথেই মারা পড়েছেন।
তাঁরা বিশ্বাস করেন, গ্রামে হয়তো খাবারের কষ্ট তুলনামূলক কম হবে। তাঁদের অনেকেই জানেন, এভাবে হয়তো তাঁরা ভাইরাস বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন, যা তাঁদের পরিবারকে সংক্রমিত করতে পারে, যেখানে রয়েছেন তাঁদের মা-বাবা, দাদা-দাদির মতো বয়োজ্যেষ্ঠরা। তবে তাঁরা নিরুপায় হয়ে একটু আশ্রয়, একটু খাদ্যের জন্য, ভালোবাসা না হোক একটু সম্মানের জন্যই গ্রামে ফিরতে শুরু করেন। এই হাঁটাপথেই মানুষগুলোর ওপর পুলিশি নির্যাতন চলে। পুলিশকে কঠোরভাবে কারফিউ কার্যকরের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। তরুণদের রাস্তায় হামাগুড়ি দিতে হলো, দিতে হলো ব্যাঙলাফ। কত মানুষ যে রাস্তায় মার খেল।
কয়েক দিন পর প্রশাসনের টনক নড়ে। তাদের মাথায় ঢোকে যে এই মানুষগুলো গ্রামে গ্রামে ভাইরাস ছড়াতে পারে। পরে সরকার রাজ্য সীমানাগুলো পথিকদের জন্যও বন্ধ করে দেয়। যে লোকজন কয়েক দিন ধরে হাঁটছিলেন, তাঁদের থামানো হলো এবং আবার শহরের শরণার্থীশিবিরে ফিরে যেতে বাধ্য করা হলো, যেখান থেকে তাঁদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রবীণদের স্মৃতির পটে হয়তো তখন ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়ের কথা ভেসে আসে। বর্তমান এই যাত্রা ধর্মবিভেদের জন্য নয়, বরং শ্রেণিবিভেদের জন্য। এমনকি এই মানুষগুলো ভারতের একদম দরিদ্র মানুষও নন। এই মানুষগুলো শহরে কাজের জন্য এসেছিলেন, যাঁদের ফেরার একটি জায়গা রয়েছে। কিন্তু বেকার, গৃহহীন সেই হতাশাগ্রস্ত মানুষেরা আজ কোথায়, যাঁরা থাকতেন শহরের পথে, শহরতলিতে, যেখানে এই হতাশার সৃষ্টি হয়েছিল চলমান ট্র্যাজেডিরও বহু আগে থেকে। আর এই ভয়ংকর সময়জুড়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে।
দিল্লি থেকে এই হাঁটা যখন শুরু হয়, তখন আমি একটি সাময়িকপত্রের প্রেস পাস নিয়ে দিল্লি ও উত্তর প্রদেশের সীমান্ত এলাকা গাজিপুরে যাই, বিষয়টি নিয়ে লেখার জন্য। ধারণাতীত এক পরিস্থিতি সেখানে। যে সামাজিক দূরত্বের জন্য এই লকডাউন, তার ঠিক উল্টো ঘটনা সেখানে। গায়ে গা লাগিয়ে সবাই জমাট বেঁধে আছে। ভারতের ছোট-বড় সব শহরের জন্যই অবশ্য এটি সত্য। মূল সড়ক হয়তো ফাঁকা। কিন্তু ঘিঞ্জি বস্তিগুলোয় দরিদ্ররা ঠাসাঠাসি করে থাকে। হেঁটে যাওয়া মানুষদের যাঁর সঙ্গেই কথা বলেছি, সবাই ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কের কথা বলেছেন। কিন্তু বেকারত্ব, ক্ষুধা ও পুলিশি নির্যাতনের কাছে সে ভয়ের অস্তিত্ব ক্ষীণ। রামজিত নামের একজনের সঙ্গে কথা হয়। নেপাল সীমান্তে গোরখপুরে হেঁটে যাওয়ার পরিকল্পনা করা এই ব্যক্তির কথা আমার বিশেষভাবে মনে আছে। তিনি বলেন, ‘এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মোদিজিকে সম্ভবত কেউ আমাদের কথা বলেনি। সম্ভবত তিনি আমাদের বিষয়ে জানেন না।’ এই ‘আমাদের’-এর সংখ্যা ৪৬ কোটি।
ভারতের রাজ্য সরকারগুলো (যুক্তরাষ্ট্রের মতোই) এই সংকটে কিছুটা সমঝদারি দেখিয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন, নাগরিক ও অন্য সংগঠনগুলো থেকে খাদ্য ও জরুরি রেশন বিতরণ করা হয়েছে। যদিও তহবিলের চেয়ে তাদের কাছ থেকে আসা মরিয়া আবেদনগুলোর উত্তর কেন্দ্রীয় সরকার খুব ধীরগতিতে দিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে যে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় ত্রাণ তহবিলে কোনো নগদ অর্থের প্রস্তুতি নেই। বরং শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ চলে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কেয়ার তহবিল নামের নতুন ও রহস্যজনক তহবিলে। মোদির ছবিসংবলিত খাবারের প্যাকেট এখন দৃশ্যমান হচ্ছে।
টানা দুই সপ্তাহ ধরে লকডাউন চলছে। সরবরাহব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। ওষুধ ও প্রয়োজনীয় জিনিসেরও সংকট তৈরি হয়েছে। অর্থনৈতিক সংকট শুরু হয়েছে। এর মধ্যে চলছে রাজনৈতিক সংকট। মূলধারার মিডিয়া, কোভিডের গল্পটিকে মুসলিমবিদ্বেষী প্রচারের সঙ্গে যুক্ত করেছে। লকডাউন ঘোষণার আগে দিল্লিতে তাবলিগ জামাতের একটি সমাবেশ হয়েছিল। এটি এখন এই ভাইরাসের ‘সুপার স্প্রেডার’ হিসেবে পরিণত হয়েছে। মুসলিমদের আঘাতের জন্য এখন এটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিষয়টা অনেকটা এমন দাঁড়াচ্ছে যে ভাইরাসটি মুসলমানরা আবিষ্কার করেছে এবং এটি ইচ্ছাকৃতভাবে জিহাদের মতো করে তারা ছড়িয়ে দিয়েছে।
কোভিড সংকটে এখনো অনেক বাকি। অথবা না–ও হতে পারে। আমরা জানি না। যখনই হোক, আমরা নিশ্চিত যে এটি ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণিকেন্দ্রিক সব প্রচলিত কুসংস্কার পুরোপুরিভাবে দূর করে মোকাবিলা করতে হবে। ২ এপ্রিল পর্যন্ত ভারতে কোভিড-১৯–এ আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজার; মারা গেছেন ৫৮ জন। এটি অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য নয়। অল্প কয়েকটি পরীক্ষার ভিত্তিতে এটি নির্ধারণ করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতেও পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক লাখ ছাড়াবে। অনেকে আবার বিশ্বাস করেন, খুব বেশি মানুষ মারা যাবে না। সংকটের আসল অবস্থা আমরা কখনোই হয়তো জানতে পারব না, এমনকি তা যখন আমাদের আঘাত করে, তখনো নয়। আমরা শুধু জানি যে হাসপাতালগুলোতে ছোটাছুটি এখনো শুরুই হয়নি। ভারতের সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো প্রতিবছর ডায়রিয়া, অপুষ্টিসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত ১০ লাখ শিশু সামাল দিতে হিমশিম খায়। সেই সঙ্গে রয়েছে লাখের ওপর যক্ষ্মারোগী। তাই এমনটা আশা করা যায় না যে তারা এই ভাইরাস মোকাবিলায় ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো রাতারাতি প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারবে।
মানুষ অসুস্থ হবে, দেখা যাবে বাড়িতেই মারা যাচ্ছে। আমরা হয়তো তাদের কথা জানব না। তাদের মৃত্যুর পরিসংখ্যানও হবে না। আমরা খালি আশা রাখতে পারি ওই সব গবেষণার ওপর, যেখানে বলা হচ্ছে এই ভাইরাসের বিস্তার ঠান্ডা আবহাওয়ায় বেশি হয় (যদিও অন্য গবেষকেরা এই মতে সন্দেহ পোষণ করেন)।
আমাদের সঙ্গে এ কী ঘটছে? হ্যাঁ, এটি একটি ভাইরাস, যার কোনো নৈতিকতার বোধ নেই। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই এটি (আমাদের কাছে) ভাইরাসের চেয়ে বেশি কিছু। কেউ কেউ বিশ্বাস করে যে ঈশ্বর আমাদের মতি ফেরাতে এই উপায় করেছেন। অনেকে বলছে, এটি বিশ্বজুড়ে চীনাদের ষড়যন্ত্র। যা–ই হোক না কেন, করোনাভাইরাস শক্তিশালীদের মাথা নত করতে বাধ্য করেছে এবং সারা বিশ্বকে এমনভাবে থমকে দিয়েছে, যা আগে কেউ পারেনি। আমাদের মন এখনো আশা করছে যে সব স্বাভাবিক হবে। এটি আমাদের চিন্তা করতে বাধ্য করছে, সেই ধ্বংসাত্মক যন্ত্রটি নিয়ে, যা নিজেদের জন্য তৈরি করেছি আমরাই। ঐতিহাসিকভাবে মহামারি সব সময় বিশ্বকে নতুনভাবে কল্পনা করতে বাধ্য করেছে। এটিও আলাদা নয়। এক বিশ্ব থেকে নতুন আরেক বিশ্বে যাওয়ার বাহক হলো করোনা।
আমাদের সংস্কার ও হিংসা, লালসা, আমাদের তথ্য ব্যাংক ও মৃত ধারণাগুচ্ছ, আমাদের মৃত নদী ও ধোঁয়াটে আকাশে বোঝাসহ আমরা এর মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে পারি। অথবা আমরা নতুন এক পৃথিবীকে কল্পনা করার প্রস্তুতি নিয়ে এসব বোঝা ছাড়াই এগোতে পারি এবং নিতে পারি এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি।
*অনুবাদ : শাকিলা হক