ভারসাম্যহীন লকডাউনের বিষয়ে সতর্কতা
‘এই ভাইরাস থামাতে যদি অন্য কোনো উপায় না থাকে, তবে আমার উপোস থাকতে কোনো আপত্তি নাই। কিন্তু এ কথা আমি আমার সন্তানদের কীভাবে বোঝাই?’ আমরা এই মর্মভেদী কথাগুলো মাত্র দুদিন আগে শুনছিলাম। কথাগুলো বলছিলেন ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের লাতেহার জেলার দাম্বি গ্রামের নেমি দেবী। তাঁর স্বামী ও ছেলে দুজনই পরিযায়ী শ্রমিক, যাঁরা লকডাউনের কারণে ফিরতে না পেরে বহু দূরে মাঝপথে আটকা পড়েছেন। আমরা লোকালয় ঘুরে দেখেছি, মানুষজনের সঙ্গে কথা বলেছি, গ্রামের পর গ্রাম বহু মা-বোন আমাদের কাছে একই ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা জানিয়েছেন। এমনকি এসব কথা প্রধানমন্ত্রী মোদির আকস্মিক ২১ দিনের লকডাউনের ঘোষণার আগে থেকেই। এটি গত বুধবারের (১৯ মার্চ) ঘটনা। ভারতের ওপর করোনাভাইরাসজনিত সংকটের সর্বাত্মক প্রভাবμক্রমে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। আপনার কিংবা আমার জন্য এটি এখনো ভবিষ্যতের বিষয়। কিন্তু অনেক অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের ওপর ইতিমধ্যেই এই সংকটের প্রভাব পূর্ণমাত্রায় পড়েছে। সংকটগুলো হলো, একদিকে কাজ না পাওয়া, অন্যদিকে খাদ্যসামগ্রী যৎসামান্য যা ছিল, তা দ্রুতই ফুরিয়ে যাচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেল সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির মানুষেরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্যসামগ্রী মজুত করার ফলে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম গেল বেড়ে।
আশা করি, কেন্দ্রীয় সরকার সমগ্র ভারতে যে ২১ দিনের লকডাউনের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে, তা সঠিক ছিল বলে প্রমাণ করতে পারবে। কিন্তু এই লকডাউনের (কার্যত কারফিউ) কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতি সশব্দে জানান দিচ্ছে যে এখনই ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করা জরুরি। এ কার্যক্রমে দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য নগদ সহায়তা অতি প্রয়োজন। সহায়তার মধ্যে রয়েছে পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের (পিডিএস) অধীনে রেশন ব্যবস্থা চালু করা। জাতীয় খাদ্যনিরাপত্তা আইন অনুযায়ী দুই-তৃতীয়াংশ ভারতীয় পরিবারের খাদ্য সহায়তা পাওয়ার কথা। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ গ্রামের এবং ৫০ শতাংশ শহরের অধিবাসী পরিবার অন্তর্ভুক্ত। দরিদ্র রাজ্যগুলোসহ অধিকাংশ রাজ্যে দেখা যায়, পিডিএস কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কাজ না করলেও অন্তত বিশাল জনগোষ্ঠীকে অনাহারে থাকা থেকে বাঁচিয়েছে।
বাড়তি মজুত করা খাদ্যের ব্যবহার
বর্তমান পরিস্থিতিতে পিডিএস কার্যক্রম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই মুহূর্তে এটি সচল রাখাই গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এটির সম্প্রসারণও জরুরি। তা দুভাবে হতে পারে: এর আওতা ও বরাদ্দের পরিমাণ দুটোই বাড়িয়ে। সৌভাগ্যবশত ভারতে বিপুল পরিমাণ খাদ্য মজুত রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, ২০ বছর ধরে এ দেশে অতিরিক্ত খাদ্য মজুত আছে। বর্তমানে মজুতের পরিমাণ স্বাভাবিক আপৎকালীন সঞ্চয়ের দ্বিগুণ রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতেই এটির সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব। ভারত সরকার যদি আগামী তিন থেকে ছয় মাসের জন্য পিডিএস রেশনের পরিমাণ দ্বিগুণ করে, তবে এমন সিদ্ধান্ত থেকে কেউ তাকে সরাতে পারবে না। তবে এই সিদ্ধান্ত নিলেও অধিকাংশ দরিদ্র মানুষের আয়ের ক্ষতিপূরণ হবে না। কিন্তু এর ফলে তারা অন্তত স্বস্তি পাবে এ কারণে যে, তাদের ঘরে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় খাদ্য থাকবে।
পিডিএসের খাদ্যবণ্টন ব্যবস্থা আরও কার্যকর করার জন্য কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, আঙুলের ছাপের বায়োমেট্রিক যাচাইপদ্ধতি আপাতত মুলতবি রাখা দরকার। কারণ, এই পদ্ধতি অনেক প্রাপককে বাদ দেয় ও স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। বিতরণব্যবস্থা ও তত্ত্বাবধান সুশৃঙ্খল হতে হবে, যাতে রেশন কেন্দ্রগুলোতে ভিড় ও প্রতারণা এড়ানো যায়। যেসব পরিবেশক প্রতারণা করতে গিয়ে ধরা পড়বে, তাদের দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এসব বাস্তবায়ন করা এখন পর্যন্ত সাধ্যের মধ্যে রয়েছে। আসল কাজ আর দেরি না করে মজুতগুলো থেকে সরবরাহ শুরু করে দেওয়া।
ওপরের কথাগুলো বলার পরও বলতে চাই, পিডিএস কার্যক্রম যথেষ্ট নয়, কারণ অনেক দরিদ্র মানুষ এর থেকে বাদ পড়েছে। আরও যেগুলো এ কার্যক্রমে যুক্ত করা জরুরি সেগুলো হলো, বড় ধরনের নগদ অর্থ হস্তান্তর। এর যাত্রা শুরু হতে পারে পেনশনের টাকা অগ্রিম ছাড় এবং পেনশনের মাসিক ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা দরকার, ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পেনশন বাবদ মাথাপিছু মাসিক ২০০ রুপিতে আটকে আছে সেই ২০০৬ সাল থেকে। এ ছাড়া আরও একটি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। সেটি হলো পেনশনের অর্থ ছাড়ের পদ্ধতি। অনেক পেনশনভোগী পেনশনের টাকা গ্রহণ করেন ‘বাণিজ্যিক প্রতিনিধি’র মাধ্যমে, যারা এক ধরনের মানুষরূপী এটিএম মেশিন, তারা ব্যাংকের হয়ে গ্রহীতাদের অর্থ হস্তান্তর করে। এখানে সমস্যা হলো, স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে পেনশনগ্রহীতার পরিচয় যাচাইয়ের বিকল্প থাকা সত্ত্বেও বাণিজ্যিক প্রতিনিধিরা অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে বায়োমেট্রিক যাচাই করে। অথচ আমরা হরহামেশাই টাকা তোলার ক্ষেত্রে এটিএম মেশিন ব্যবহার করছি, সেখানে বায়োমেট্রিক যাচাইয়ের প্রয়োজন পড়ে না। অধিকন্তু গণহারে বায়োমেট্রিক পদ্ধতির ব্যবহার নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ আরও বাড়িয়ে তুলবে।
অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা
নীতিগতভাবে বায়োমেট্রিক যাচাইয়ের পদ্ধতি এখন বাদ দেওয়া দরকার। যদি তা না-ও করা হয়, তবে বাণিজ্যিক প্রতিনিধিরা এই সময়ে করোনা সংক্রমণের ভয়ে উধাও হয়ে যেতে পারে। অধিকাংশ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি অত্যন্ত কম বেতনে চাকরি করেন ছোটখাটো ব্যক্তিমালিকানধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। সেগুলোর ওপর সরকারি নজরদারি খুব দুর্বল। এই দুই পক্ষের চিত্রেই অন্তত এটি পরিষ্কার যে এমন কিছু করতে হবে, যার মাধ্যমে ব্যাংকের পক্ষ থেকে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে নিরাপদে সামলানোর একটি ব্যবস্থা তৈরি করা যায়। চাইলে পেনশনের টাকা দেওয়ার নতুন ব্যবস্থাও চালু করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, পেনশনের অর্থ নগদ প্রদান করা যেতে পারে মাসের একটি নির্দিষ্ট দিনে পঞ্চায়েত ভবনে। এটা সবাইকে ব্যাংকে দৌড়ানো থেকে রেহাই দিতে পারে। ভারতের ওডিশায় এ রকম কয়েক বছর থেকে করা হচ্ছে, তার বেশ ভালো ফল পাওয়া গেছে।
নগদ অর্থ ছাড়ের পদ্ধতিতে আরও প্রয়োজনীয় সুরক্ষা তৈরি করা যায় গ্রামাঞ্চলের শিশু যত্নকেন্দ্র অঙ্গনওয়ারি ও স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপগুলোর মাধ্যমে। নগদ অর্থ পাওয়ার ব্যবস্থা পেনশনভোগী পর্যন্তই সীমিত রাখা দরকার। পিডিএস ও সামাজিক সুরক্ষার পেনশন স্কিমের পুনর্গঠন একটি দীর্ঘমেয়াদি বিষয়। কিন্তু বেশ বড়সংখ্যক অরক্ষিত জনগোষ্ঠী এই পুনর্গঠন বাস্তবায়নের লম্বা সময়ের ফাঁকে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অধিকন্তু রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্য সরবরাহ একজনকে কেবল ক্ষুধা থেকে বাঁচাতে পারে, কিন্তু মনে রাখতে হবে, এ ছাড়া মানুষের অন্য অনেক মৌলিক চাহিদা রয়েছে। এই ব্যাপক কর্মহীনতার মুহূর্তে তাঁদের নগদ অর্থেরই বেশি প্রয়োজন পড়বে।
পেনশন স্কিমের এই পদ্ধতি ছাড়াও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে নগদ সহায়তা পৌঁছানোর কয়েকটি পন্থা আছে। উদাহরণস্বরূপ, মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্টের (এমজিএনআরইজিএ) আওতায় কার্ডধারীদের হিসাবে সরাসরি টাকা পাঠিয়ে দেওয়া। আরও পথ আছে, যেমন প্রধানমন্ত্রী কিষান সম্মান নিধিভুক্ত (সংক্ষেপে পিএম-কিষান, এটি ভারতে পয়লা ফেব্রুয়ারি ২০১৯ থেকে চালু হয়, যেখানে কৃষক মাথাপিছু বছরে ন্যূনতম ছয় হাজার রুপি আয় সহায়তা পাবেন, যা তাঁদের ব্যাংক হিসাবে সরাসরি চলে যায়) কৃষকদের অথবা পিডিএস কার্ডধারীদের কাছে সুবিধা পৌঁছানো। এসব তালিকার সর্বোত্তম ব্যবহার কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে কিংবা এগুলো সম্মিলিতভাবে কীভাবে কাজে লাগানো যাবে, তা পরিবেশ-পরিস্থিতির বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমার মতে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এটা শুরু করা যেতে পারে এমজিএনআরইজিএর আওতায় কার্ডধারীদের তালিকা ধরে।
সম্ভাব্য জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের বিবেচনায় উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি নাম ওপরে উল্লেখ করা হলো। আরও অনেক পরামর্শের কথা বলা যায়। যেমন মিড-ডে মিলস, কমিউনিটি কিচেনস ও আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ত্রাণ ক্যাম্প। সংকট মোকাবিলার প্রথম পদক্ষেপ হতে হবে ত্রাণ কার্যক্রমকে লকডাউন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিবেচনা করা। এটি করতে না পারলে লকডাউনের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক প্রভাবের চেয়ে নেতিবাচক ফলই বেশি বয়ে আনবে। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় বলি, একটি ক্ষুধার্ত ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর পক্ষে কার্যকরভাবে ভাইরাস মোকাবিলার সক্ষমতা কম। জনগণকে ভেড়ার পালের মতো বিবেচনা করা সম্পূর্ণ ভুল।
একটি গঠনমূলক লকডাউনের সিদ্ধান্ত জনগণকে সম্মিলিতভাবে লড়াই করার সক্ষমতা দেয়। সবশেষে, কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক রাজ্যের সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অনেক মূল্যবান উদ্যোগ গ্রহণ করলেও সেগুলো সার্বিক বিচারে অপর্যাপ্ত। কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সিদ্ধান্তই এসব উদ্যোগকে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। পর্যাপ্ত ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার থেকে দরকার বড় অঙ্কের অর্থ (এক লাখ কোটি রুপির প্রয়োজন)। যা-ই হোক, বরাদ্দের পর বাস্তবায়নের নেতৃত্ব রাজ্যগুলোকেই দিতে হবে। প্রতিটি রাজ্যের সেসব কাজে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে আলাদা ধরনের বাস্তবায়নপদ্ধতিও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের চেয়ে বেশি দক্ষ নয়। কেন্দ্রীয় সরকার যদি রাজ্যের বিলের পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেয়, তাহলেই এর শুভসূচনা হতে পারে।
* জঁ দ্রেজ ভারতের রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অতিথি অধ্যাপক।
ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন আহমেদ জাভেদ।
(অনুবাদ আহমেদ জাভেদ দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। বাঙলার পাঠশালা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি।)
[ অধ্যাপক জঁ দ্রেজের ইংরেজি লেখাটি ছাপা হয় ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকায় ২৬ মার্চ ২০২০। আজ তাঁর লেখার দ্বিতীয় কিস্তি ছাপা হলো]
[প্রথম কিস্তিতে অধ্যাপক জঁ দ্রেজের ইংরেজি লেখাটি ছাপা হয় ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকায় ২৩ মার্চ ২০২০। ৩ পর্বের এই লেখা আগামী পর্বে সমাপ্ত হবে]